১৫ আগস্ট স্বাধীনতার ৭৫ বছর উদযাপন করতে চলেছে দেশ। কিন্তু অতিমারি পরিস্থিতিতে দেশের প্রাপ্তবয়স্কদের ৭৩ শতাংশেরও বেশি এখনও একটি টিকাও পাননি। সরকারের কো-উইন পোর্টালের তথ্য অনুযায়ী, প্রাপ্তবয়স্ক জনসংখ্যার মাত্র ১০ শতাংশ দু’টি ভ্যাক্সিন পেয়েছেন। কেন্দ্রীয় সরকারের দাবি, করোনা মোকাবিলায় নাগরিকদের টিকা নিয়ে কোনও সমস্যা নেই, প্রতিটি রাজ্যে পর্যাপ্ত টিকা পাঠানো হয়েছে। কিন্তু বাস্তব কী বলছে?
করোনা অতিমারি দেড় বছরে পড়লেও এবং দেশের লক্ষ লক্ষ লোক বেঘোরে প্রাণ হারালেও নাগরিকদের জন্য অপরিহার্য টিকাকরণ করে উঠতে পারছে না বিজেপি সরকার। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, টিকাকরণের গতি বাড়াতে না পারলে করোনার তৃতীয় ঢেউয়ের মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। এখনকার মতো ঢিমেতালে টিকাকরণ চললে আগামী দু’বছরেও সকলে টিকা পাবে না। মানুষ হন্যে হয়ে ছুটছে করোনার প্রতিষেধক ভ্যাক্সিন নিতে। কিন্তু পাচ্ছে না। স্বাধীনতার ৭৫ বছরেও সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্যের সুরক্ষা দিতে দেশের সরকার যে পুরোপুরি ব্যর্থ তা আবারও প্রমাণ হল।
বাজেটে ভ্যাক্সিনের জন্য মাত্র ৩৫ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছিল। এখনও পর্যন্ত খরচ হয়েছে মাত্র ৯,৭২৫ কোটি টাকা। করোনা সংক্রমণে, বিনা অক্সিজেনে, বিনা ওষুধে, করোনা-পরবর্তী রোগে ভুগে লক্ষ লক্ষ মানুষ মারা গেল, অথচ বরাদ্দ অর্থ সরকার ভ্যাক্সিনন এবং চিকিৎসা কোনও কাজেই লাগাতে পারল না। দেশীয় ভ্যাক্সিননের উৎপাদন যুদ্ধকালীন তৎপরতায় বাড়িয়ে, বিদেশ থেকে প্রয়োজনীয় ভ্যাক্সিন আনিয়ে এবং বৈষম্য না করে রাজ্যগুলিকে প্রয়োজনের ভিত্তিতে ভ্যাক্সিন সরবরাহ করে নাগরিকদের এই মারণ ভাইরাসের হাত থেকে বাঁচাতে যে তৎপরতা দরকার ছিল তার ছিটেফোঁটাও সরকারের মন্ত্রীদের মধ্যে দেখা যাচ্ছে না। অথচ ‘সাফল্য’ প্রচারে কোটি কোটি টাকা খরচ করে চলেছে সরকার।
স্বাস্থ্য মন্ত্রক সুপ্রিম কোর্টকে হলফনামা দিয়ে জানিয়েছিল, ডিসেম্বরের মধ্যে ১৮ বছরের বেশি বয়সী সকলের দুই ডোজ টিকা দেওয়া হবে। কিন্তু ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলিকে যা জোগান দেওয়ার কথা ছিল, তার থেকে দু’কোটিরও বেশি ডোজ টিকার জোগানই দেয়নি কেন্দ্রের বিজেপি সরকার।
ভ্যাক্সিনের অভাবে সর্বত্র মানুষ রাত জেগে লাইনে দাঁড়িয়েও পাচ্ছেন না। অথচ কেন্দ্রীয় সরকার বলছে কোনও রাজ্যেই প্রতিষেধকের ঘাটতি নেই। পশ্চিমবঙ্গ, মহারাষ্ট্র, দিল্লি সহ বেশ কিছু রাজ্যে ভ্যাক্সিনের অভাবে মাঝেমাঝেই টিকাকরণ বন্ধ রাখতে হয়েছে। বহু বেসরকারি হাসপাতাল বা নার্সিংহোমে হাজার হাজার টাকা খরচ করে ভ্যাক্সিন নিতে বাধ্য হচ্ছেন বহু মানুষ। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে টিকা অতিরিক্ত পরিমাণে থাকলেও সরকারি হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যেখানে বিনামূল্যে টিকা নিতে হাজার হাজার মানুষ লম্বা লাইন দিচ্ছেন, সেখানে তার অভাব। ‘বন্ধু’ কর্পোরেট স্বাস্থ্যব্যবসায়ীদের টিকা নিয়ে মুনাফা করার সুযোগ করে দিতেই এমন ব্যবস্থা। চাহিদা ও জোগানের ফারাক তৈরি করে উৎপাদক কর্পোরেট কোম্পানিগুলি মোটা অঙ্কের মুনাফা ঘরে তুলছে।
সরকার ঠিকমতো পরিকল্পনা করলে সকলকে টিকা দেওয়ার বন্দোবস্ত অনায়াসেই করতে পারত। কর্পোরেট পুঁজির স্বার্থেই তা করল না। এর ফল দেশের মানুষকে ভুগতে হচ্ছে জীবন দিয়ে।
পশ্চিমবঙ্গে ভোটের প্রচারে এসেও প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, বিজেপি জয়ী হলে বিনামূল্যে টিকার ব্যবস্থা করবেন। শুধু জয়ী হলে কেন? দেশের সব মানুষকে টিকা দেওয়া কি সরকারের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না? আসলে তা ছিল নির্বাচনী জুমলা। ঠিক যেমন বিজেপি ২ কোটি বেকারকে কাজ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, সকল নাগরিকের অ্যাকাউন্টে ১৫ লক্ষ টাকা ফেরত দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, পরিযায়ী শ্রমিকদের নিরাপদে বাড়িতে ফিরিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, কৃষকদের ফসলের উপযুক্ত দাম দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, মহিলাদের নিরাপত্তা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল– নানা সময়ে নির্বাচনে সুবিধা আদায় করতে তারা দেশের মানুষকে বিভিন্ন প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। পরে এ সমস্তই তারা জুমলা বা কথার কথা বলে উড়িয়ে দিয়েছে। আজ ভ্যাক্সিনন দেওয়ার ক্ষেত্রেও বিজেপি নেতাদের নানা প্রতিশ্রুতিও দেশবাসীর কাছে কথার কথাই রয়ে গেছে।