প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছেন, ‘পড়াশোনার উদ্দেশ্য শুধু চাকরি নয়’। পড়াশোনার যে বহুমুখী উদ্দেশ্য রয়েছে সে কথাটা কে না জানে? কিন্তু প্রধানমন্ত্রী বললেন কী উদ্দেশ্যে? তাঁর ভেতরের কথাটা কী আসলে– শিক্ষিত বেকাররা আর চাকরি চেয়ে সরকারকে লজ্জা দেবেন না! বছরে ২ কোটি বেকারের চাকরি দেওয়ার প্রতিশ্রুতির মালিক প্রধানমন্ত্রীর গলায় হঠাৎ এই সুর কেন?
মানেটা বোঝা গেল আর্থিক উপদেষ্টা সংস্থা সিএমআইই-র সাম্প্রতিক প্রকাশিত রিপোর্ট সামনে আসতেই। এই রিপোর্ট দেখাচ্ছে শুধু জুন মাসেই দেশে ১ কোটি ৩০ লক্ষ মানুষ কাজ হারিয়েছেন। ২০২২-এর প্রথম ৬ মাসেই ২৫ লক্ষ বেতনভুক কর্মচারী ছাঁটাই হয়েছেন। এ বছর শুধু স্টার্ট-আপ সংস্থা থেকেই চাকরি গেছে ১২ হাজার মানুষের। এই অবস্থায় কাজ না পেয়ে কাজ খোঁজাই ছেড়ে দিয়েছেন কয়েক কোটি মানুষ। কেন চাকরি যাচ্ছে? কেন নিয়োগ হচ্ছে না? কেন্দ্রীয় সরকারের ৩০ লক্ষ পদ খালি পড়ে রয়েছে, নিয়োগ হচ্ছে না। প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত স্বাধীনতার ‘অমৃতকালে’ এই হতাশাজনক পরিস্থিতি কেন?
বাস্তবে বেকারত্বের প্রকৃত হার সরকার ঘোষিত হারের থেকে অনেক বেশি। সরকারের স্ট্যাটিসটিক্যাল অফিস (এনএসও) জানাচ্ছে, দেশের কর্মক্ষম মানুষের মাত্র ৩৭ শতাংশ কিছু কাজ পান, ৬৩ শতাংশ কিছুই পান না। কিন্তু সরকার দেখাচ্ছে বেকারত্বের হার মাত্র ৭ শতাংশ। আসলে কাজ চেয়ে নাম লিখিয়েছেন যারা, এই শতাংশটা তাদের। প্রকৃত বেকার সংখ্যা নয়।
সরকারি রীতি শিরোধার্য করেই সিএমআইই জানাচ্ছে, হরিয়ানায় বেকারত্বের হার ৩০.৬ শতাংশ, রাজস্থানে ২৯.৮, আসামে ১৭.২, বিহারে ১৪ শতাংশ। অর্থাৎ এই বিপুল সংখ্যার নথিভুক্ত কর্মপ্রার্থী কোনও কাজই পাননি। নথিভুক্ত নয় সেই বিপুল সংখ্যার হিসাব নেই।
সরকারি কর্তাদের দাবি, এই সময় কৃষি মরসুম নয়, তাই কাজ কম। জুলাই মাসে মাঠে কাজ শুরু হলেই বাড়বে কর্মসংস্থান। শুধু কৃষিক্ষেত্রেই কি কর্মহীন মানুষের সংখ্যা বেড়েছে? শহরাঞ্চলে কিংবা মফঃস্বলে কর্মহীন মানুষের সংখ্যা কি কমেছে? তা হলে ২০২১ সালের সরকারি রেকর্ড অনুযায়ী প্রথম তিন মাসেই শুধু ২৬ শতাংশ বেকার-বৃদ্ধি হল কী করে? গত এক বছরে কর্মসংস্থানের হার সর্বনিম্ন হল কী করে? যুক্তি তোলা হচ্ছে, পরিযায়ী শ্রমিকদের সারা বছর কাজ থাকে না। তাই এ সময় বেকারের সংখ্যা বেশি। জুন মাসে যে শ্রমিকের কাজ নেই, জুলাই-আগস্ট মাসে তার কাজ থাকবে, সেটা তারা নিশ্চিত ভাবে বলছেন কী করে?
প্রধানমন্ত্রীর না জানার কথা নয় যে, এই চরম বেকারত্বের কারণে পিএইচডি, মাস্টার ডিগ্রিধারী যুবক-যুবতীরা ঝাড়ূদার থেকে ডোমের কাজের জন্য লাইন দিচ্ছেন। ভারত জুড়েই এই চিত্র। এই বেকারত্বের দুঃসহ জ্বালায় অভাবগ্রস্ত পরিবারগুলির অনাহার, অর্ধাহার আজ কোনও গোপন তথ্য নয়। এ দেশের ৯৭ কোটি মানুষ যে সুষম খাদ্যটুকু পান না, তাও কি প্রধানমন্ত্রী জানেন না!
এমন তো নয় এ দেশে মানুষের প্রয়োজনীয় সব কিছু এত তৈরি হয়েছে যে আর তা উৎপাদনের প্রয়োগন নেই! তাই কাজের সুযোগও কমে যাচ্ছে! বরং উল্টোটাই তো সত্য যে, কোটি কোটি মানুষ তাঁদের নূ্যনতম প্রয়োজনীয় জিনিসও পান না। তা হলে তা জোগাতে হলে আরও উৎপাদন চাই। তাতে আরও মানুষের কাজের সুযোগই তো হওয়ার কথা। হচ্ছে না কেন?
আসলে মানুষের যতই প্রয়োজন থাক, ক্রয়ক্ষমতা না থাকায় সাধারণ মানুষ কিনতে পারছে না। অবিক্রিত পণ্য গুদামে জমে যাচ্ছে। ফলে মজুর কাজ করতে চাইলেও তার শ্রমশক্তিকে কাজে লাগানো যাচ্ছে না। মুনাফা অটুট রাখতে যতটুকু উৎপাদন না করলে নয়, মালিকরা তার বেশি করবে না। মুনাফার স্বার্থে একচেটিয়া মালিকরা চড়া দামে বিক্রি করছে অবিক্রিত পণ্য, মূল্যবৃদ্ধি হচ্ছে ব্যাপক হারে। শিল্প-কারখানায় শ্রমিক নির্ভরতা কমিয়ে যন্ত্রনির্ভরতা বাড়ানো হচ্ছে। পরিণামে বেশি বেশি করে শ্রমিক ছাঁটাই হচ্ছে। এই রাষ্ট্র পরিচালনা করছে যে পুঁজিপতি শ্রেণি, তারা তাদের মুনাফার জন্য যতটা প্রয়োজন শ্রমিক নিয়োগ করছে, তাকে খাটাচ্ছে, কাজ ফুরোলে ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছে।
অন্য দিকে যে সরকারই ক্ষমতার মসনদে থাকুক– কংগ্রেস বা বিজেপি তারাই বেসরকারিকরণের নীতি প্রয়োগ করছে। জনসাধারণের ভোটে নির্বাচিত সরকারগুলি বেকারদের কাজ দেওয়ার দায়দায়িত্ব ঝেড়ে ফেলছে অবলীলায়। সরকারের মালিক তোষণ নীতির ফলে সরকারি-বেসরকারি দপ্তরে, কলে-কারখানায় প্রয়োজনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নতুন পদ তৈরি হচ্ছে না, উল্টেহাজার হাজার পুরনো পদ বিলোপ করা হচ্ছে। অনিবার্য পরিণামে বেকারের সংখ্যা বেড়ে চলেছে। গ্রামে চাষবাসও বাজার-অর্থনীতির এই নিয়ম মেনেই হয়। ফলে সেখানেও কৃষি-মজুর উদ্বৃত্ত হচ্ছে, গ্রামীণ বেকাররা শহরে কোনও একটা কাজের খোঁজে চরকিপাক খাচ্ছে।
শাসক দলগুলি চায়, সঙ্কটগ্রস্ত পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অনিবার্য পরিণাম যে বেকার সমস্যা, অনাহার, দারিদ্র সেই সত্যটা যেন সাধারণ মানুষ না বোঝে। তা হলে প্রকৃত শত্রুকে চিনতে পারবে মানুষ। লড়াইটাও হবে পুঁজিবাদী এই সমাজ ব্যবস্থা ও তার রক্ষক ক্ষমতামত্ত দলগুলির বিরুদ্ধে সচেতন শ্রমিকের সংঘবদ্ধ লড়াই। তাতেই এত আতঙ্ক। আসলে এই ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখতে যত দিন খেটে খাওয়া মানুষকে দিয়ে তা সইয়ে নেওয়া যায় ততদিনই লাভ শাসক দলের, তাদের প্রভু পুঁজি মালিকদের। সে জন্যই সঙ্কটের আসল কারণকে প্রকাশ না করে তাকে চাপা দেওয়ার সর্বাত্মক চেষ্টা।