দেশের গরিব, নিম্নবিত্ত সাধারণ মানুষের সাথে প্রতারণার আরও একটি নজির তৈরি করল কেন্দ্রের বিজেপি সরকার। ১ এপ্রিল থেকে নতুন অর্থবর্ষ শুরুর আগের রাতে হঠাৎই কেন্দ্রের বিজেপি সরকার এক নির্দেশিকা জারি করে স্বল্প সঞ্চয়ের উপর থেকে এক ধাক্কায় ১১০ বেসিস পয়েন্ট পর্যন্ত সুদের হার কমানোর ঘোষণা করে দিল এবং দেশজুড়ে বিশেষত পশ্চিমবাংলায় দ্বিতীয় দফা ভোটের দিন প্রবল জনঅসন্তোষের আশঙ্কা করে পরের দিনই তড়িঘড়ি আবার তা তুলে নেওয়া হল। সরকারের ঘোষিত নির্দেশিকা অনুযায়ী সুদ কমানোর কথা বলা হয় ১-৫ বছরের মেয়াদি আমানত, ৫ বছরের রেকারিং ডিপোজিট, মাসিক আয় প্রকল্প, এনএসসি, কিসান বিকাশপত্র, সুকন্যা সমৃদ্ধি যোজনার মতো সব প্রকল্পেই। উল্লেখ্য, স্বল্প সঞ্চয়ের সুদের হার গত বেশ কয়েক বছর ধরেই সরকার কমিয়ে চলেছে। এ বার এক ধাক্কায় অনেকখানি কমাতে চলেছে সরকার।
নির্দেশিকাটি জানতে পেরেই পরদিন সাধারণ মানুষের মধ্যে ক্ষোভ প্রবল হয়ে ওঠে। গরিব, নিম্নবিত্ত, স্বল্প আয়ের মানুষেরাই মূলত স্বল্প সঞ্চয়ে টাকা জমা রাখেন। অবসরপ্রাপ্ত মানুষদের বড় অংশ সারা জীবনের সঞ্চয়ের উপর এই সুদ থেকেই জীবিকা নির্বাহ করেন। এমনিতেই লকডাউনের কারণে বিরাট অংশের মানুষ কাজ হারিয়ে বেকার হয়ে গিয়েছেন। নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রতিটি জিনিসের দাম বাড়ছে লাফিয়ে। পেট্রল-ডিজেল-রান্নার গ্যাস-কেরোসিনের দাম বিজেপি সরকার বাড়িয়েই চলেছে। লাফিয়ে বাড়ছে ওষুধের দাম এবং চিকিৎসার খরচ। এই অবস্থায় স্বল্প সঞ্চয়ে সুদের হার কমিয়ে বিজেপি সরকার জনসাধারণের জীবনের ভাল-মন্দ সম্পর্কে কতখানি বেপরোয়া– এই সিদ্ধান্তে সেই মনোভাবটিকেই স্পষ্ট করে দিল।
কিন্তু নির্দেশিকাটি জারি করে মুশকিলে পড়ে গেলেন বিজেপি নেতারা, কারণ পাঁচটি রাজ্যে ভোট চলছে। ১ তারিখেই ছিল পশ্চিমবাংলার দ্বিতীয় দফা ভোট। এমনিতেই পেট্রল-ডিজেল-রান্নার গ্যাস-কেরোসিনের দাম বাড়ার কারণে বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভ তুঙ্গে। কৃষিনীতির বিরুদ্ধে ক্ষোভে ফুঁসছে কৃষকরা। এই অবস্থায় বিজেপি নেতারা আর সুদ কমানোর ঝুঁকি সওয়ার মতো অবস্থায় নেই। বিজেপির অন্দরমহলে ‘থামাও থামাও’ রব– যা হবে ভোটের পরে, এখন নয়। এরই ফল পর দিনের অর্থমন্ত্রীর টুইট– ‘‘পিপিএফ সহ স্বল্প সঞ্চয়ে সুদ কমছে না। জানুয়ারি থেকে মার্চে যে সুদ মিলছিল, আপাতত তা-ই পাওয়া যাবে।”
নির্দেশিকাটি জারি হয়ে গিয়েছিল না হয় ভুল করে, কিন্তু নির্দেশিকাটি তো ভুল নয়। এমন নির্দেশিকা তো কেউ ভুল করে তৈরি করে ফেলতে পারে না। সরকারি সূত্র উদ্ধৃত করে সংবাদমাধ্যম জানাচ্ছে, সব স্তরে আলোচনা করে মোদি সরকারের শীর্ষ স্তরের অনুমোদনের ভিত্তিতেই নতুন সুদ সংক্রান্ত নির্দেশিকা জারি হয় এবং এবারও তাই হয়েছে। কোনও কারণে নির্দেশিকাটি শুধু অসময়ে বেরিয়ে পড়েছে!
যে সিদ্ধান্তের সাথে সাধারণ মানুষের, গরিব মানুষের স্বার্থ জড়িত তা কি সত্যিই মন্ত্রীদের নজর এড়িয়ে বেরিয়ে যেতে পারে? সত্যিই যদি নজর এড়িয়ে বেরিয়ে যায় তবে তার জন্য কে বা কারা দায়ী তা তাঁরা দেশের মানুষকে জানাচ্ছেন না কেন? বাস্তবে এই নির্দেশিকা জারি যে কোনও নজর এড়ানোর ব্যাপার নয়, তা প্রত্যাহারের নির্দেশিকায় ‘আপাতত’ কথাটির ব্যবহার থেকেই স্পষ্ট। অর্থাৎ সুদ কমানোর সিদ্ধান্তটি তাঁরা প্রত্যাহার করছেন না, প্রবল জনরোষের চাপে, ভোট হারানোর ভয়ে স্থগিত রাখছেন মাত্র। ভোট চলে গেলেই তাঁরা এটি আবার জারি করবেন।
পুঁজিপতি শ্রেণির ‘পলিটিক্যাল ম্যানেজার’ হিসাবে বিজেপি সরকার গত সাত বছরে জনগণের স্বার্থকে প্রতিটি ক্ষেত্রে পুঁজিপতিদের পায়ে বিসর্জন দিয়েছে। সেই পুঁজিপতি শ্রেণিকে সস্তায় ঋণ দিতেই স্বল্প সঞ্চয়ের উপর সুদ কমিয়ে চলেছে বিজেপি সরকার। কিন্তু যে সরকার সাধারণ মানুষ, গরিব মানুষ, অবসরপ্রাপ্ত মানুষের স্বল্প সঞ্চয়ের সুদ কমিয়ে অর্থনীতিতে খরচ বাঁচাতে চায়, আয় বাড়ানোর অন্য কোনও উপায় খুঁজে পায় না, সেই সরকার একই সাথে যেমন অমানবিক, তেমনই পুরোপুরি অপদার্থ। যারা আজ বিজেপির পিছনে অন্ধের মতো ছুটছেন, এই বিষয়গুলি তাঁদের গভীর ভাবে ভেবে দেখা দরকার।