সম্প্রতি রাজপুতানার ইতিহাস সম্পর্কিত একটি বই প্রকাশ অনুষ্ঠানে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বলেছেন, ভারতের অধিকাংশ ইতিহাসবিদ পাণ্ড্য, চোল, মৌর্য, গুপ্ত সহ বহু সাম্রাজ্যের গৌরবময় কাহিনিকে উপেক্ষা করে শুধুমাত্র মুঘলদের ইতিহাস চর্চা করেছেন ও প্রাধান্য দিয়েছেন। তিনি সুলতান ও মুঘল শাসকদের বিরুদ্ধে রাজপুতানা, অহম (আসাম) সহ ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের রাজাদের লড়াইকে সংস্কৃতি, ভাষা এবং ধর্ম রক্ষার যুদ্ধ বলে চিহ্নিত করেছেন। সেই সঙ্গে তিনি আরও বলেছেন, এখন সত্য ইতিহাস লেখা থেকে কেউ আর আমাদের আটকাতে পারবে না, আমরা এখন স্বাধীন। আমরা আমাদের ইতিহাস নিজেদের মতো লিখতে পারি।
ইতিহাস সম্পর্কে শাহের মন্তব্যে কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন ওঠে। সত্যই কি তিনি স্কুল-কলেজের সিলেবাসে মৌর্য, গুপ্ত, চোল, পাণ্ড্য, সাতবাহন প্রমুখ আঞ্চলিক রাজাদের ইতিহাস খুঁজে পাননি? না কি খুঁজে দেখার চেষ্টা করেননি? অথবা দেখেও না দেখার ভান করেছেন? তাঁর মতে স্কুল ও স্নাতক স্তরের ইতিহাস পাঠ্যসূচিতে কেবলই মুঘলদের ইতিহাস পড়ানো হয়। ইতিহাসবিদ ও গবেষকগণ নাকি তাঁদের গবেষণায় গুরুত্ব দিয়েছেন মুঘল রাজাদের।
বাস্তবে মন্ত্রীমশাই একটু সময় খরচ করে পাঠ্যসূচির দিকে তাকালেই দেখতে পেতেন, দেশের হাজার হাজার বছরের ইতিহাসে মুঘলরা কেবল সাড়ে তিনশো বছর রাজত্ব করেছেন। বাকি সময়ে কারা রাজত্ব করেছেন সে প্রশ্নের উত্তর অবশ্য তিনি নিজেই দিয়েছেন– মৌর্য, গুপ্ত, মৌখরি, পাল, সেন থেকে শুরু করে বিভিন্ন রাজবংশ রাজত্ব করেছে। ইতিহাসবিদদের গবেষণায় তাদের কাহিনী লিপিবদ্ধ আছে। এই বংশগুলি নিয়ে গবেষণা হয়নি, ইতিহাসবিদরা গুরুত্ব দেননি এ-ও সঠিক তথ্য নয়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিজে এবং তাঁর বিভাগের কর্তাদের দিয়ে একটু খোঁজ নিলে দেখতে পেতেন, দেশের খ্যাতিমান গবেষকরা প্রাচীন ও মধ্যযুগের ভারতবর্ষের রাজবংশ ও তাদের সংস্কৃতি নিয়ে কত বস্তুনিষ্ঠ আলোচনা করেছেন। বিখ্যাত ইতিহাসবিদ কে এ নীলকান্ত শাস্ত্রী, কে ভ্যালুথাট সহ বহু আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ইতিহাসবিদ গবেষক দক্ষিণ ভারতের ইতিহাস নিয়ে বস্তুনিষ্ঠ চর্চা করেছেন। একই ভাবে মুঘল পূর্ববর্তী প্রাচীন ভারতের ও আদি মধ্যযুগ নিয়ে এইচ সি রায়চৌধুরী, এ এল ব্যাসাম, আর এস শর্মা, রাধাকুমুদ মুখার্জি ও রমেশ চন্দ্র মজুমদারের মতো ইতিহাসবিদরা মৌলিক ইতিহাস চর্চা করে গিয়েছেন। নতুন নতুন তথ্যের আলোকে রোমিলা থাপার, ইরফান হাবিবের মতো আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ইতিহাসবিদরা ওই সময়ের ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে পথিকৃতের ভূমিকা পালন করে চলেছেন। নিত্যনতুন তথ্যের আলোকে শ্রমসাধ্য পরিশ্রম করে গবেষকরা যে কাজ করে চলেছেন তাতে বহু অজানা বিষয়, অজানা কাহিনীর আবরণ উন্মোচিত হচ্ছে।
মুক্ত মনে ইতিহাস পাঠ করলেই দেখতে পাওয়া যাবে, মৌর্য, গুপ্ত, চোল, পাণ্ড্য, পল্লব ইত্যাদি বিভিন্ন বংশের রাজত্বের সময়কালে বড় রাজ্য এবং ছোট রাজ্যের মধ্যে যুদ্ধবিগ্রহ লেগেই থেকেছে। আবার সুলতানি ও মুঘল শাসকদের বিরুদ্ধেও আঞ্চলিক রাজাদের লড়াই হয়েছে। কিন্তু এতে কখনও সংস্কৃতি, ভাষা বা ধর্ম রক্ষার লড়াই যুক্ত ছিল না। ছিল না কোনও আদর্শগত সংঘাতের প্রশ্নও। এর সঙ্গে যুক্ত ছিল কেবল রাজনৈতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম। যদি আদর্শের সংঘাত হত, তাহলে আকবরের বিরুদ্ধে সংঘাতে রানা প্রতাপের সেনাপতি হাকিম খান সুর হতেন না, কিংবা আকবরের সেনাপতি মানসিংহ হতেন না। শিবাজি তার সেক্রেটারি হিসেবে মৌলবি হায়দার খানকে নিয়োগ করতেন না। ঔরঙ্গজেব তার সেনাপতি হিসেবে জয়সিংহকে নিয়ে আসতেন না। ওই সময়ের বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাসচর্চা প্রমাণ দেয় উভয় সম্প্রদায়ের লোকজন নিয়েই উভয়ের সৈন্যবাহিনী গঠিত হয়েছিল।
যদি তথ্যভিত্তিক প্রশাসনিক ইতিহাস, সামরিক ইতিহাস, অর্থনৈতিক ইতিহাসের চর্চা করা যায় তা হলে দেখা যাবে, এইসব ক্ষেত্রে নিয়োগ পদ্ধতি সম্প্রদায়ভিত্তিক ছিল না। একই ভাবে সেদিন সংস্কৃতির সংহতির ক্ষেত্রে ঐকতানের সুরই লক্ষ করা গিয়েছিল। সঙ্গীত যন্ত্র এসরাজ, সুরবাহার, সারেঙ্গি হিন্দু-মুসলমান যুক্ত সাধনার ফসল ছিল। ধ্রুপদ, খেয়াল, টপ্পা, ঠুংরির ইতিহাস যদি বর্তমান শাসকরা খুঁজে দেখতেন তাহলে জানতে পারতেন এগুলির সৃষ্টির পেছনে খসরু থেকে তানসেনদের কী অবদান ছিল। সৌধ নির্মাণের ক্ষেত্রেও এই মিশ্র সংস্কৃতির প্রভাব দেখা যায়। ইতিহাসের প্রবহমান ধারায় নামী-দামি বহু সাম্রাজ্যের উত্থানপতন হয়েছে। সমাজ-সংস্কৃতির অগ্রগতির ধারায় যা মহত্তম অবদান রেখে গিয়েছে স্বাভাবিকভাবেই ইতিহাসের সেই ঘটনাগুলি মানুষ মনে রেখেছে, চর্চাও হয়েছে।
স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে দেশে যে সার্বিক সঙ্কট তৈরি হয়েছে, তা ছেড়ে মন্ত্রীমশাই হঠাৎ করে ইতিহাস নিয়ে পড়লেন কেন? এখানেও কি সেই পেশিশক্তির আস্ফালন? আসলে এ হল, প্রসঙ্গ সামনে এনে সমস্যা থেকে মানুষের নজর ঘোরানোর় কৌশল মাত্র। এই কৌশলের ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্রের ফসল হয়ে উঠেছে ইতিহাস। বিজেপি নেতাদের লক্ষ্য, দেশের নাগরিকরা যেন তাঁদের কাছ থেকেই ইতিহাস, অর্থনীতি, রাজনীতি, সমাজ ও সংস্কৃতির ধারণাগুলি গ্রহণ করে। তাই তাঁরা দেশের ইতিহাসের মৌলিক পরিবর্তন করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছেন। কোনও প্রকারের গণতান্ত্রিক পদ্ধতি, প্রতিবাদের তোয়াক্কা না করে ইউজিসিকে দিয়ে সুকৌশলে দেশের ইতিহাস বদলে ফেলতে চাইছেন। এই ক্ষেত্রে তাদের দুই অস্ত্র হল ইন্ডিয়ান নলেজ সিস্টেম এবং ন্যাশনাল এডুকেশন পলিসি। তাদের তৈরি করা ধাঁচে ইতিহাস নির্মাণ হলে দেশের ছাত্রছাত্রীরা জানতেই পারবেন না, এদেশে একদিন হরপ্পা-মহেঞ্জোদাড়োর মতো সভ্যতা ছিল। আর্যরা ভারতের বাইরে থেকে এ দেশে এসেছিল। এ দেশে ব্রাহ্মণ্য ধর্মের বিরুদ্ধে বৌদ্ধ, জৈন ধর্মের মতো প্রতিবাদী ধর্মের উত্থান ঘটেছিল। ১২০৬ সাল থেকে শুরু হওয়া প্রথমে সুলতানি সাম্রাজ্য পরে মুঘল সাম্রাজ্যের সঙ্গে মৌর্য, গুপ্ত, চোল, পাণ্ড্য ও সাতবাহন প্রভৃতি আঞ্চলিক রাজশক্তিগুলির কোনও তুলনা চলতে পারে না। সমাজ, সংস্কৃতি, অর্থনীতি ও প্রশাসনিক ক্ষেত্রে যে কাঠামো মুঘলরা নির্মাণ করতে পেরেছিল তার কোনও তুলনা সমকালীন আঞ্চলিক রাজশক্তিগুলির সঙ্গে করা চলে না।
তাদের মনগড়া ধারণা প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে বস্তুনিষ্ঠ তথ্যনির্ভর ইতিহাসের বদলে তথ্যবিকৃতির ইতিহাস তৈরি করা হচ্ছে। তারা যে হিন্দু ধর্মভিত্তিক ইতিহাস নির্মাণ করতে চান তা তাদের প্রকাশিত কলেজ স্তরের ইতিহাসের সিলেবাস দেখলেই অনুধাবন করা যায়। বৈদিক সভ্যতার প্রাচীনত্ব, ভূখণ্ডের আদি বাসিন্দা নির্ধারণ, হিন্দু ধর্মের উৎপত্তির গরিমা কীর্তন, সংস্কৃত ভাষার চর্চাকে প্রাধান্য দেওয়া আসলে হিন্দু ধর্মভিত্তিক ইতিহাস নির্মাণের পথ। তথ্য-প্রমাণ ও যুক্তির মাধ্যমে বিচার-বিশ্লেষণ করে বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাস যেভাবে এতদিন ধরে নির্মাণ করা হয়েছে তার বদল করে ধর্মীয় ভেদাভেদ জাতপাতভিত্তিক কল্পিত ইতিহাস নির্মাণ করে ক্ষমতার জোরে তাকেই প্রাতিষ্ঠানিক ইতিহাস চর্চা বলে চালাতে চাইছে। শাসক কর্তৃক ইতিহাসের এই ব্যাখ্যা তথ্যনির্ভর বস্তুতান্ত্রিক ইতিহাস চর্চার পক্ষে অত্যন্ত বিপদজনক। শুধু তাই নয়, ইতিহাসের এই ধরনের ব্যাখ্যায় একটি সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে আর একটি সম্প্রদায়ের ক্ষোভ জন্ম নেবে ও সম্প্রীতির বাতাবরণ নষ্ট হবে।