সম্প্রতি তিন দিনের সফরে কাশ্মীরে গিয়েছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। সেখানে তিনি বেশ কয়েকটি সভা করেছেন, নিরাপত্তা সংস্থাগুলির অফিসারদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। সর্বত্রই তিনি সরকারি নীতির সাফল্যের কথা ফলাও করে বলেছেন। কাশ্মীরের বিশেষ সাংবিধানিক অধিকার ৩৭০ ধারা তুলে দেওয়ার ফলে কাশ্মীরের মানুষই লাভবান হয়েছেন, সেখানে শান্তি ফিরে এসেছে, এ দাবি তিনি প্রতিটি সভায় করেছেন।
কিন্তু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দাবি ও বাস্তব কি একই রকম? কাশ্মীরে উপস্থিত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যখন সন্ত্রাসকে গোড়া ধরে উপড়ে ফেলার ডাক দিচ্ছেন, তখনই সেখানে একের পর এক জঙ্গি হামলার ঘটনা ঘটেছে। ঘটনায় নিহতের তালিকায় যেমন নিরীহ সাধারণ নাগরিকরা রয়েছেন, তেমন সেনা ও পুলিশকর্মীরাও রয়েছেন। শুধু অক্টোবরেই সেনা-জঙ্গি সংঘর্ষে ১২ জন সাধারণ নাগরিক প্রাণ হারিয়েছেন, ন’জন সেনাকর্মীর মৃত্যু ঘটেছে। সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত ২০ জন পুলিশকর্মী নিহত হয়েছেন।
জম্মুর রাজৌরি-পুঞ্চ সীমান্ত এলাকায় অনুপ্রবেশ এবং এনকাউন্টারে মৃত্যু দুই-ই সম্প্রতি বেড়েছে। নিরাপত্তা বাহিনীর উপর হামলা ঠেকাতে নিয়মিত বাঙ্কারের সংখ্যা বাড়াতে হচ্ছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তেমনই একটি বাঙ্কার ঘুরে দেখে এসেছেন এই সফরে। এর পরেও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পরিস্থিতিকে শান্তিপূর্ণ বলছেন কোন যুক্তিতে?
কাশ্মীর কতখানি শান্ত এবং নিরাপদ তা বোঝাতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শের-ই-কাশ্মীর কনভেনশন সেন্টারে বত্তৃতার আগে পোডিয়ামে লাগানো বুলেটপ্রুফ কাচের ঘেরাটোপটি সরিয়ে দিয়েছেন। নিরাপত্তার লৌহবেষ্টনীর মধ্যে ওই কাচের ঘেরাটোপটি সত্যিই অপ্রয়োজনীয় অর্থে বেমানানই ছিল। তাঁর সফর উপলক্ষে নিরাপত্তায় মুড়ে ফেলা হয়েছিল গোটা কাশ্মীরকে। নিয়মিত বিপুল বাহিনী ছাড়াও ৫০ কোম্পানি বাড়তি আধাসামরিক বাহিনী, ৫০০০ ট্রুপারের সঙ্গে ছিল স্নাইপার, ড্রোন ও শার্পসুটাররা।
মোদি সরকারের দাবি ছিল, ৩৭০ ধারা বাতিলের পর উপত্যকায় জঙ্গি সমস্যা কমবে, পরিবেশ স্বাভাবিক হবে এবং উন্নয়নের বন্যা বইবে। একের পর সংঘর্ষ এবং মৃত্যুর ঘটনা থেকে স্পষ্ট, পরিস্থিতির উন্নতি ঘটেনি। কাশ্মীরে জঙ্গি কার্যকলাপ এখনও কেন একই রকম থেকে গেল, এ প্রশ্নের কোনও উত্তর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তাঁর প্রতিটি বত্তৃতাতেই এড়িয়ে গেছেন। বরং পরিস্থিতিকে চাপা দেওয়ার চেষ্টায় তিনি বলেছেন, ‘রক্তপাতের দিন শেষ। আগামী দিন উন্নয়নের’। আসলে বাস্তবটাকে স্বীকার করে নিলে সরকারের ব্যর্থতা এবং ৩৭০ ধারা বাতিলের সাফল্য নিয়ে বাগাড়ম্বর দেশের মানুষের সামনে স্পষ্ট হয়ে যায়। বাস্তবে বিপুল আর্থিক বিনিয়োগ দূরের কথা, ছিটেফোঁটা বিনিয়োগও কাশ্মীর, লাদাখ এমনকি জম্মুতেও আসেনি। আসার কথাও নয়। জঙ্গি কার্যকলাপের এমন অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে কোনও বিনিয়োগ আসতে পারে না। স্বাভাবিক ভাবেই কোনও কর্মসংস্থানও তৈরি হয়নি। বেকারি আকাশ ছুঁয়েছে। ফল বাগিচা, কার্পেট, শাল তৈরি, পর্যটন প্রভৃতি ক্ষেত্রও পুরো স্তব্ধ।
অন্য দিকে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যখন বলছেন, রক্তপাতের দিন শেষ, তখন একই সাথে বলছেন, সন্ত্রাস নির্মূল করতে এগিয়ে আসতে হবে কাশ্মীরের যুব সম্প্রদায়কে। রক্তপাত যদি শেষই হয়ে গিয়ে থাকে তবে যুব সম্প্রদায়ের উদ্দেশে মন্ত্রীকে এমন আহ্বান জানাতে হচ্ছে কেন? কেন নিরাপত্তা সংস্থাগুলির অফিসারদের সঙ্গে বৈঠকে বসে বলতে হচ্ছে যে, সন্ত্রাস রুখতে সর্বশক্তি প্রয়োগ করুন? কেন যুবকদের মধ্যে জেহাদি মনোভাবে রাশ টানার বিষয়টিকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে দেখার কথা বলতে হচ্ছে?
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যখন একদিকে বলছেন, গণতন্ত্র তৃণমূল স্তরে পৌঁছেছে, জম্মু-কাশ্মীরের যুবকদের দায়িত্ব উন্নয়নের কাজে শামিল হওয়া এবং তিনি কাশ্মীরের যুবকদের বন্ধু হতে চান, ঠিক তখনই ভারত-পাকিস্তান ক্রিকেটে পাকিস্তানি খেলোয়াড়দের পক্ষে উল্লাস প্রকাশ করায় শ্রীনগরে ‘গভর্নমেন্ট মেডিকেল কলেজ এবং শের-ই-কাশ্মীর ইনস্টিটিউট অফ মেডিকেল সায়েন্সেস-এর ছাত্রদের বিরুদ্ধে পুলিশ ইউএপিএ ধারায় অভিযোগ দায়ের করেছে। একই ঘটনা দেখা গিয়েছে উত্তরপ্রদেশ এবং হরিয়ানার দুটি কলেজ হস্টেলে। সেখানে কাশ্মীরী ছাত্রদের উপর হামলা করেছে উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা। এই মনোভাব নিয়েই নাকি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কাশ্মীরের যুবকদের বন্ধু হতে চান! স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মুখে এ কথা বললেও কাশ্মরী কিশোর যুবকদের সর্বদাই সন্দেহের চোখে দেখে প্রশাসন এবং সশস্ত্র বাহিনী। বাস্তবে বিজেপি সরকার একদিকে ৩৭০ ধারা বাতিল করে কাশ্মীরের জনগণের স্বাতন্ত্র্য ও বিশেষ অধিকারগুলিকে পদদলিত করে তাদের ভাবাবেগে প্রবল আঘাত করেছে, অন্য দিকে পুলিশ-মিলিটারির বেয়নেট-বুটের তলায় তাদের ক্ষোভ-বিক্ষোভ দমন করছে। আর এই দমনের খবর যাতে বাইরে প্রকাশিত না হয় তার জন্য সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতাকেও কেড়ে নেওয়া হয়েছে। সত্য তুলে ধরার চেষ্টা যে সাংবাদিকরা করছেন তাঁদের পুলিশি অত্যাচারের মুখোমুখি হতে হচ্ছে, জেলে যেতে হচ্ছে। প্রশাসন জানিয়ে দিয়েছে, সরকারের যে কোনও সমালোচনাকেই রাষ্ট্রবিরোধিতা হিসাবে দেখা হবে। সত্য তুলে ধরায় কেন তাঁদের এত বাধা? আসলে বিজেপি নেতা-মন্ত্রীদের ঘোষণার উল্টো বাস্তবকে ধামাচাপা দিতেই এই সরকারি হুমকি।
এ ভাবে যে কাশ্মীরে শান্তি ফিরিয়ে আনা যাবে না, তা এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট) ২০১৯-এর ৫ আগস্ট ৩৭০ ধারা বাতিলের দিনই স্পষ্ট করে বলেছিল বিবৃতিতে। বলা হয়েছিল, কাশ্মীরে শান্তি ফিরিয়ে আনতে হলে সংবিধানের ৩৭০ ধারাকে পূর্ণ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করতে হবে ও কাশ্মীরী জনগণের স্বাতন্ত্র্যকে মর্যাদা দিতে হবে। পরিবর্তে বিজেপি সরকার যা করল তাতে আমাদের আশঙ্কা, কাশ্মীরের পরিস্থিতি আরও অগ্নিগর্ভ হবে এবং কাশ্মীরী জনগণের ভাবাবেগ চূড়ান্ত আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তিগুলিকে আরও সাহায্য করবে। পাকিস্তানকেও নাশকতাবাদী কার্যকলাপ চালাতে সাহায্য করবে। এস ইউ সি আই (সি)-র সেই আশঙ্কা আজ দুঃখজনক ভাবে অক্ষরে অক্ষরে সত্য প্রমাণিত হচ্ছে।
বাস্তবে ভারতের স্বাধীনতার সময় স্বতন্ত্র ধারায় জাতিসত্তার বৈশিষ্ট্য নিয়ে অবস্থান করা কাশ্মীরের ভারতভুক্তির বাস্তব প্রয়োজনেই এসেছিল সংবিধানের ৩৭০ ধারা। কিন্তু একেবারে প্রথম থেকেই কংগ্রেস পরিচালিত তৎকালীন কেন্দ্রীয় সরকার ৩৭০ ধারাকে বারবার লঙ্ঘন করেছে। একের পর এক পদক্ষেপে এই ধারার প্রায় সমস্ত অধিকারই কংগ্রেস সরকার কেড়ে নিয়েছে– যা কাশ্মীরী জনগণের কাছে বিশ্বাসভঙ্গ হিসাবেই এসেছে। যা তাদের গোটা ভারতের সঙ্গে এক হয়ে মিলবার পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ সবই কংগ্রেস করেছিল কাশ্মীরে ক্ষমতা দখল করার জন্য। এখন বিজেপি কংগ্রেসের পথেই সেই একই কাজ করছে।
এ বার কাশ্মীর সফরে অমিত শাহ সরকারি নীতির জয়গানের পাশাপাশি পূর্ণ রাজ্যের মর্যাদা ফেরানোর আশ্বাস দিয়েছেন। এ ব্যাপারে তিনি ক্রনোলজি টেনেছেন– আগে ডিলিমিটেশন (আসন পুনর্বিন্যাস), তার পর নির্বাচন এবং তার পর পূর্ণ রাজ্যের মর্যাদা। পরিস্থিতির উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন না হওয়া সত্ত্বেও আজ তাঁরা পূর্ণ রাজ্যের মর্যাদা ফিরিয়ে দেওয়ার কথা বলছেন, তা হলে সেদিন তাঁরা তা কেড়ে নিয়েছিলেন কেন? সেই কেড়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত যে সম্পূর্ণ ভুল ছিল নরেন্দ্র মোদি-অমিত শাহরা কাশ্মীরের মানুষের সামনে দাঁড়িয়ে তা স্বীকার করুন। আসলে জম্মু-কাশ্মীরের বিধানসভা পুনর্বিন্যাসের কাজটি অমিত শাহরা এমনভাবে করতে চাইছেন যাতে জম্মুতে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয়ী হয়ে উপত্যকার ক্ষমতা তারা দখল করতে পারেন। এটি বিজেপির দীর্ঘ দিনের পরিকল্পনা। কাশ্মীরের মানুষের আশঙ্কা, এই ভাবে বিজেপি উপত্যকার জনবিন্যাসের চরিত্রই পাল্টে দিতে চাইছে। কাশ্মীরিয়ত– যা তাদের নিজস্ব সত্তা, তা নষ্ট করে দিতেই এই পদক্ষেপ। বাস্তবে বিজেপি নেতারা একের পর এক পদক্ষেপে কাশ্মীরের মানুষকে কাছে টানার পরিবর্তে দূরেই ঠেলছেন।