জনরোষের চাপে অবশেষে মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ রাতের শেষ মেট্রো ভাড়ার উপর দশ টাকা সারচার্জ বসানোর প্রস্তাব অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করেছে। মেট্রোরেল কেন্দ্রীয় বিজেপি সরকারের নিয়ন্ত্রণে। ফলে ভাড়াবৃদ্ধির বোঝা চাপানোর এই সিদ্ধান্ত রেল বোর্ডের বকলমে কেন্দ্রের মোদি সরকারেরই মস্তিষ্কপ্রসূত। তীব্র অর্থনৈতিক সঙ্কটে জর্জরিত জনগণের উপর ভাড়াবৃদ্ধির বোঝা চাপানোর এই সিদ্ধান্ত থেকে একটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে যায়, জনগণকে দেশের শাসক শ্রেণি কী দৃষ্টিতে দেখে।
কোনও শাসক ন্যূনতম জনদরদি হলে প্রথমেই তার বিচারের মধ্যে থাকা উচিত এই অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যেও জনসাধারণকে কতটা বেশি সুরাহা দেওয়া যায়। ভাড়া ন্যূনতম রেখে যাত্রী স্বাচ্ছন্দ্য যতদূর বেশি দেওয়া সম্ভব সেটা হওয়া উচিত একটি জনমুখী সরকারের প্রাথমিক এবং প্রধান কর্তব্য। কিন্তু সরকারের ভূমিকায় তা দেখা যাচ্ছে না। সরকার মেট্রোরেল থেকে আরও বেশি মুনাফা তোলার মতলবে নানা নামে টাকা তোলার পথে হাঁটছে। ট্যাক্সবৃদ্ধি, মূল্যবৃদ্ধি, বেকারত্ব, রোজগারহীনতায় বা স্বল্প মজুরিতে অতি কষ্টে দিন গুজরান করা সাধারণ মানুষ নতুন করে আবারও মেট্রো ভাড়াবৃদ্ধির বিরোধিতা করবে এটাই স্বাভাবিক। যে জনরোষের জন্য সারচার্জ স্থগিতের সিদ্ধান্ত, তা কী উপায়ে প্রশমিত করে ভাড়াবৃদ্ধিকে সহনশীল করা যায় রেলবোর্ডের কর্তারা উর্বর মাথা খাটিয়ে উপায় বের করেছে। জনসাধারণের মনটাকে এমন ভাবে তৈরি করে দাও যাতে মূল্যবৃদ্ধিতে ভাড়াবৃদ্ধিতে রুষ্ট হবে না, বরং বলবে এটাই জরুরি ছিল। সরকারের এই হীন উদ্দেশ্য সফল করতে সক্রিয় হয়েছে এক শ্রেণির সংবাদমাধ্যম।
তাদের বক্তব্য, কলকাতা মেট্রোরেল অসম্ভব রকম সস্তা। মেট্রোরেলে যারা নিয়মিত যাতায়াত করেন তারা জানেন এই সস্তা তত্ত্বের দোহাই দিয়ে কলকাতা মেট্রোতে কয়েক বছর আগে কী ভাবে ভাড়া বাড়ানো হয়েছে এবং স্মার্ট কার্ডের বোনাস কমিয়েছে। দশ-বারো বছর আগেও স্মার্ট কার্ডে ২০ শতাংশ বোনাস দেওয়া হত। এই বোনাস দিয়েও মেট্রো বিপুল মুনাফা করেছে। পরে বোনাস কমাতে কমাতে ১০ শতাংশে নামিয়ে আনা হল। সম্প্রতি তা আরও কমিয়ে পাঁচ শতাংশ করে দেওয়া হয়েছে। ভাড়া বাড়াতে স্টেজগুলিও ভাঙা হয়েছে। এতে মেট্রোর মুনাফা আরও বেড়েছে। ভাড়াবৃদ্ধির ওকালতি করে বলা হচ্ছে, দেশের অন্য শহরে মেট্রোতে ভাড়া বেশি। তাই ভাড়া বাড়াতে হবে। এটা কোনও যুক্তি হতে পারে না। অন্য শহরে মেট্রোতে বেশি ভাড়া নিলে সেটা অন্যায়। সেই অন্যায়কে দেখিয়ে আরেকটা অন্যায় করা চলে না। অন্য শহরে বেশি ভাড়া নিলে সেখানে কমানোর জন্য দাবি তোলা উচিত। তা না হলে চক্রবৃদ্ধিতে ভাড়ার বোঝা যাত্রীদের ঘাড়ে চাপতেই থাকবে।
দ্বিতীয় যে কথাটি তারা বলছে, ‘মেট্রোর ভাড়া বাড়ুক, গোটা ব্যবস্থাটির আধুনিকীকরণ হোক এবং যাত্রী স্বাচ্ছন্দ্যের প্রশ্নটিকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হোক।’ যারা এ ভাবে ভাবছেন তাদের পুরনো কয়েকটি ঘটনা স্মরণ করা প্রয়োজন। সিপিএম সরকারের শেষ দিকে একবার ১৫ শতাংশ বাসভাড়া বাড়িয়েছিল সরকার। তখন বাস মালিকরা বলেছিল, বাসে যাত্রী স্বাচ্ছন্দের জন্য ৬ শতাংশ টাকা খরচ করা হবে। যাত্রী স্বাচ্ছন্দের কী হাল ভুক্তভোগী মানুষ তা জানেন। ভাড়া বেড়েছে, স্বাচ্ছন্দ্য ব্যাপারটাই কলকাতার গণপরিবহণ থেকে ভ্যানিশ হয়ে গেছে। আসলে যাত্রী স্বাচ্ছন্দের গল্প বলে ভাড়াবৃদ্ধি করে মুনাফা বৃদ্ধিই সরকারের উদ্দেশ্য।
মেট্রো স্টেশনগুলিতে আগে অনেকগুলি টিকিট কাউন্টার খোলা থাকতো। এখন বেশিরভাগ স্টেশনে একটা টিকিট কাউন্টার খোলা থাকে। টিকিট কিনতেই ১০-১৫ মিনিট চলে যাচ্ছে। এটা যাত্রী স্বাচ্ছন্দের নমুনা? যাত্রী স্বাচ্ছন্দ্য দিতে হলে বেশি মেট্রো চালাতে হবে। দুটি মেট্রো মাঝের সময়ের ব্যবধান তিন-চার মিনিটের বেশি করা উচিত নয়। যাত্রী স্বাচ্ছন্দ্য দিতে চাইলে ট্রেন বাতিল করার পরম্পরা বন্ধ করতে হবে। এ দিকে কর্তৃপক্ষের নজর কোথায়?
তৃতীয়ত, কিছু সংবাদমাধ্যম বলছে মেট্রোর ভাড়া বাড়ানো হোক যথেষ্ট পরিমাণে এবং দিনের কিছু সময় যেমন সকাল ন’টার আগে পর্যন্ত বা দুপুর বারোটা থেকে চারটে পর্যন্ত সেই সময় ভাড়ার উপর ডিসকাউন্ট বা ছাড় দেওয়া হোক। এই যুক্তির মধ্যে রয়েছে অদ্ভুত ধূর্তামি। মেট্রো রেলে যখন সবচেয়ে বেশি ভিড় হয়– সেই অফিসটাইমে চড়া হারে ভাড়া বাড়ালেই ভিড় কমে যাত্রী স্বাচ্ছন্দ্য বেড়ে যাবে, এটা শিশুসুলভ চিন্তা। আজকের দিনে দ্রুত কর্মক্ষেত্রে পৌঁছানো এবং সারা দিন নানা কাজে দ্রুত চলাফেরার জন্য মেট্রো রেল শহরে একটা অপরিহার্য বিষয়ে পরিণত হয়েছে। কোনও গণপরিবহণ ব্যবস্থাই উচ্চবিত্তের বিলাসের বিষয় হতে পারে না। মেট্রোর ক্ষেত্রে বর্তমানকালে এটা আরও বেশি করে প্রযোজ্য। অতিরিক্ত ভাড়ায় চাপ হলেও দরিদ্র শ্রমিককেও এই পরিবহণ ব্যবহার করতেই হবে। তাতে সংসারের বাকি খরচে টান পড়ুক, ওষুধপত্র কেনা লাটে উঠুক, এই টাকা খরচ করতে সে বাধ্য! না হলে কাজ থেকে ছাঁটাই হবে। তাতে পুরো পরিবারের সম্পূর্ণ অনাহার নিশ্চিত। ফলে ভাড়া বাড়লেও ভিড় কমবে কী করে?
এ জন্যই যাত্রী স্বাচ্ছন্দ্য বাড়াতে হলে মেট্রোর সংখ্যা বাড়ানো জরুরি। তা না করে মেট্রো থেকে নিম্ন আয়ের মানুষদের হঠিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব অত্যন্ত হীন এবং জঘন্য। কলকাতা মেট্রো শুধু ধনীদের যাতায়াতের জন্য তৈরি হয়নি। ভিখারি থেকে দিনমজুর, নিম্নবিত্ত থেকে মধ্যবিত্ত সকলেরই ট্যাক্সের টাকায় এই মেট্রো গড়ে উঠেছে। এখন ধনীর বিলাসযাত্রার ব্যবস্থা করতে নানা ফন্দি চলছে। তারই অঙ্গ মেট্রো থেকে নিম্ন আয়ের মানুষদের হঠানোর ষড়যন্ত্র।
ভাড়াবৃদ্ধির পক্ষে ওকালতি করতে গিয়ে চতুর্থ যে যুক্তি করা হচ্ছে তা হল, বিভিন্ন অ্যাপ নির্ভর ট্যাক্সি সংস্থা যদি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ভাড়া নিতে পারে তা হলে মেট্রোতে না হওয়ার যুক্তি কী? প্রশ্ন হল, এই ব্যবস্থাটা কি সাধারণ মানুষের স্বার্থে পরিচালিত? চাহিদা বেশি থাকলেই ভাড়া বাড়ানো, দাম বাড়ানোকে নৈতিক দিক থেকে বলে কালোবাজারি করা। সেটাই এখন বাজারি ফরমুলায় ‘ডায়নামিক প্রাইসিং।’ মেট্রো রেলও সেই পথেই মানুষের পকেট কাটবে? আর মানুষ তা মেনে নেবে? আপাতত মেট্রো সারচার্জ বৃদ্ধি সিদ্ধান্ত স্থগিত হয়েছে। প্রতিবাদ না থাকলে যে কোনও মুহূর্তে যাত্রীদের উপর ভাড়া বৃদ্ধির বোঝা চাপবে। যারা নিত্যযাত্রী এ ক্ষেত্রে তাদের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। প্রতিটি স্টেশনে যাত্রী কমিটি গড়ে তুলে সংগঠিতভাবে বর্ধিত ভাড়ার সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণ বাতিলের দাবি জানাতে হবে।