রুশ নভেম্বর বিপ্লবের ১০৪তম বার্ষিকী উপলক্ষে এবার মহান স্ট্যালিনের একটি রচনা প্রকাশ করা হল। রচনাটি ১৯১৭ সালের ১৩ অক্টোবর প্রকাশিত হয়েছিল ‘রাবোচি পুত‘-পত্রিকার ৩৫তম সংখ্যায়। সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত রাশিয়ায় ‘সোভিয়েত‘-এর হাতে ক্ষমতার অর্থ বাস্তবে কী– এই রচনাটি তা বুঝতে সাহায্য করবে।
বিপ্লবের প্রথম দিকের দিনগুলোয় ‘সব ক্ষমতা চাই সোভিয়েতের হাতে’– স্লোগানটা ছিল একটা অভিনব কথা। এই প্রথম ‘সোভিয়েত শক্তির’ প্রতিষ্ঠা হল এপ্রিলে, অস্থায়ী সরকারের ক্ষমতার বিরুদ্ধে। রাজধানীর অধিকাংশই তখনও ছিল অস্থায়ী সরকারের পক্ষে। এই অস্থায়ী সরকারে রাজধানীর অধিকাংশই মিলিউকভ আর গুচকভকে চাইছিলেন না। জুনে শ্রমিক এবং সৈন্যদের অধিকাংশ বিক্ষোভ সমাবেশ থেকেই উঠতে লাগল এই স্লোগান। রাজধানীতে অস্থায়ী সরকার ততদিনে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। জুলাইতে ‘সব ক্ষমতা চাই সোভিয়েতের হাতে’– স্লোগানটা নিয়েই রাজধানীতে সংখ্যাগুরু বিপ্লবী আর লভভ-কেরেনস্কি সরকারের মধ্যে জ্বলে উঠল সংগ্রামের আগুন। আপসকামী সেন্ট্রাল এক্সিকিউটিভ কমিটি প্রদেশের পশ্চাৎপদতার উপর নির্ভর করে চলে গেল সরকারের দিকে। সংগ্রামে জয় হল সরকার পক্ষের। কোণঠাসা হয়ে পড়ল সোভিয়েত শক্তির অনুগামীরা। তারপর শুরু হল এক শ্বাসরোধকারী অবস্থা। চলল ‘সমাজতন্ত্রী’দের দমন আর ‘রিপাবলিকান’দের জেলে ঢোকানো। চলল কুটিল সব ষড়যন্ত্র আর সামরিক ছক কষা। যুদ্ধক্ষেত্রে রইল ফায়ারিং স্কোয়াড আর পিছনে ‘সম্মেলন’। আগস্টের শেষ পর্যন্ত চলল এই অবস্থা। পরিস্থিতি আমূল বদলে গেল আগস্টের শেষ দিকে। কর্নিলভের অভ্যুত্থান প্রতিরোধে প্রয়োজন হয়ে পড়ল বিপ্লবী শক্তির শেষ বিন্দুটারও।
পিছনে সোভিয়েতগুলো আর সীমান্তে কমিটিগুলো একরকম নিষ্ক্রিয় হয়েই পড়েছিল জুলাই আর আগস্টে। ‘হঠাৎ’ যেন নতুন প্রাণ সঞ্চার হল তাদের মধ্যে। তারা ক্ষমতা দখল করে নিল সাইবেরিয়া আর ককেশাসে, ফিনল্যান্ড আর উরালে, ওডেসা আর খারকভে। যদি তা না করা হত, ক্ষমতা যদি দখল না করা হত, বিপ্লব ধ্বংস হয়ে যেতে পারত। এইভাবে, এপ্রিলে পেট্রোগ্রাড শহরের ‘ছোটো একদল’ বলশেভিক যে ‘সোভিয়েত শক্তি’র ঘোষণা করেছিল, আগস্টের শেষ নাগাদ তা স্বীকৃতি পেল প্রায় সমগ্র রাশিয়ার বিপ্লবী শ্রেণির।
সবার কাছেই এখন পরিষ্কার যে ‘সোভিয়েত শক্তি’ কেবল একটা জনপ্রিয় স্লোগান নয়, বিপ্লবের বিজয়ের জন্য প্রয়োজনীয় একমাত্র অমোঘ হাতিয়ার, বর্তমান পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসার একমাত্র রাস্তা।
অবশেষে সময় এসেছে ‘সব ক্ষমতা চাই সোভিয়েতের হাতে’ স্লোগানটাকে হাতে কলমে করে দেখাবার।
কিন্তু ‘সোভিয়েত শক্তি’ কী? অন্য শক্তিগুলোর সাথে তার তফাৎ কোথায়?
বলা হয় সোভিয়েতের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের অর্থ হল একটা ‘সম প্রকৃতি’র গণতান্ত্রিক সরকার গঠন করা, ‘সমাজতন্ত্রী’ মন্ত্রীদের নিয়ে একটা নতুন ‘মন্ত্রীসভা’ গঠন করা এবং মোটের উপর অস্থায়ী সরকারের গঠনের একটা ‘গুরুত্বপূর্ণ’ পরিবর্তন ঘটানো। কিন্তু এটা সত্য নয়। এটা আদৌ অস্থায়ী সরকারের কয়েকজন সদস্যের বদলে অন্য কয়েকজনকে নিয়ে আসার বিষয় নয়। যেটা বিষয়, তা হল, নতুন বিপ্লবী শ্রেণিগুলিকে দেশের কর্তৃত্বে নিয়ে আসা। আসল কথা হল সর্বহারা এবং বিপ্লবী চাষিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা। কিন্তু এ জন্য সরকারের কিছু মামুলি পরিবর্তনই যথেষ্ট নয়। সবার আগে যা দরকার তা হল সরকারের সমস্ত দপ্তর আর প্রতিষ্ঠানগুলোর আগাগোড়া শুদ্ধিকরণ। দরকার এর সব ক’টি থেকে কর্নিলভপন্থীদের বরখাস্ত করে সর্বত্র মজুর চাষির প্রতি বিশ্বস্ত লোকদের নিয়োগ করা। তখনই এবং কেবল তখনই বলা যাবে ‘কেন্দ্রে এবং স্থানীয়ভাবে’ সোভিয়েতের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা গেছে।
অস্থায়ী সরকারের ‘সমাজতন্ত্রী’ মন্ত্রীদের এই চরম অসহায় অবস্থার কারণ কী? এই মন্ত্রীরা যে অন্তর্বর্তী সরকারের বাইরের কিছু লোকের হাতের তুচ্ছ পুতুলে পরিণত হয়েছেন, তার কারণ কী? (‘ডেমোক্রেটিক কনফারেন্সে’ চেরনভ এবং স্কোবেলেভ, জারুদ্নি এবং পেশেখোনভের ‘রিপোর্ট’-এর কথা মনে করুন)। কারণ হল, প্রথমত এই মানুষগুলো দপ্তর পরিচালনা করছেন– এমন হওয়ার বদলে এদের দপ্তরই এদের পরিচালনা করেছে। অন্যান্য কারণের মধ্যে একটা হল, প্রত্যেকটা দপ্তরই এক একটা দুর্গ, যেখানে জার আমলের আমলারা ঘাঁটি গেড়ে রয়েছে। মন্ত্রীদের মহান ইচ্ছেগুলোকে এরা পরিণত করে ফাঁকা ‘বুলিতে’ এবং কর্তৃপক্ষের প্রতিটা বিপ্লবী পদক্ষেপে অন্তর্ঘাত করতে এরা তৈরি। সোভিয়েতের হাতে ক্ষমতা দেওয়ার কাজটা যদি কথার কথা না হয়, যদি তা সত্যিই করতে হয়, তা হলে ওই দুর্গগুলো দখল করতেই হবে। কাদেত-জার জমানার দালালদের দূর করতে হবে ওখান থেকে। সেই জায়গায় বসাতে হবে বিপ্লবের প্রতি বিশ্বস্ত এবং নির্বাচিত কর্মীদের, প্রয়োজনে যাদের ফিরিয়ে আনা যায়।
সোভিয়েতের হাতে ক্ষমতার অর্থ হল, পশ্চাৎভাগ ও রণাঙ্গণের সমস্ত সরকারি প্রতিষ্ঠানকে আগাগোড়া শুদ্ধিকরণ করা।
সোভিয়েতের হাতে ক্ষমতার অর্থ পশ্চাদভাগ ও রণাঙ্গণের সমস্ত ‘কর্তৃপক্ষ’কে নির্বাচিত হতেই হবে এবং প্রয়োজনে তাদের ফিরিয়ে আনার ক্ষমতাও জনগণের থাকবে। সোভিয়েতের হাতে ক্ষমতার অর্থ গ্রাম-শহরে, সেনাবাহিনী এবং নৌবাহিনীতে, ‘দপ্তর’ এবং ‘প্রতিষ্ঠানে’, ‘রেলে’, ‘ডাক এবং টেলিগ্রাফ’ অফিসে ‘কর্তৃত্বের আসনে থাকা প্রত্যেক ব্যক্তি’কে নির্বাচিত হতেই হবে এবং প্রয়োজনে তাদের ফিরিয়েও আনা যাবে।
সোভিয়েতের হাতে ক্ষমতার অর্থ সর্বহারা এবং বিপ্লবী কৃষকের একনায়কত্ব।
অতি সম্প্রতি কেরেনস্কি আর তেরেশ্চেঙ্কোর বদান্যতায় কর্নিলভ এবং মিলিউকভ যে একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছে তার থেকে, বুর্জোয়া সাম্রাজ্যবাদী একনায়কত্বের থেকে তা গুণগতভাবেই পৃথক।
সর্বহারা এবং বিপ্লবী কৃষকের একনায়কত্ব হল মানুষের জন্য রুটির স্বার্থে, চাষির জন্য জমির স্বার্থে, উৎপাদন এবং বন্টনের উপর শ্রমিকের নিয়ন্ত্রণের স্বার্থে, গণতান্ত্রিক শান্তির স্বার্থে, সংখ্যালঘু শোষকের উপর, ভূস্বামী এবং পুঁজিপতিদের উপর, ব্যাঙ্ক-মালিক এবং মুনাফাখোরদের উপর খেটে-খাওয়া সংখ্যাগুরু জনতার একনায়কত্ব।
বিপ্লবী কৃষক এবং সর্বহারার একনায়কত্বের অর্থ জনতার প্রকাশ্য একনায়কত্ব। তাতে না থাকে কোনও ষড়যন্ত্র, না থাকে টেবিলের তলায় কোনও লেনদেন, যা ঘটে তা সকলের চোখের সামনেই ঘটে। পুঁজিপতিরা লক-আউট করে, নানাভাবে নিজেদের ‘দায় খালাস’ করে, বেকারত্ব বৃদ্ধি করে। মুনাফাখোর ব্যাঙ্কাররা খাবারের দাম বাড়ায়, মানুষকে বাধ্য করে উপোস করতে। এদের যে দয়া করা হবে না, এ সত্য গোপন করার কোনও কারণ নেই এই একনায়কত্বের।
সর্বহারা এবং কৃষকের একনায়কত্বের অর্থ এমন একনায়কত্ব যা জনগণকে দমন করে না, যা চলে জনগণের ইচ্ছায়, যা জনগণের শত্রুর আশা-আকাঙক্ষার সমাধি রচনা করে।
‘সব ক্ষমতা চাই সোভিয়েতের হাতে’– এই হল শ্রেণি মর্মবস্তু।
আভ্যন্তরীণ এবং বৈদেশিক কর্মকাণ্ডের বিকাশ, দীর্ঘকাল ধরে চলতে থাকা যুদ্ধের ফলে শান্তির জন্য আকুতি, ফ্রন্টে পরাজয় আর রাজধানী রক্ষার প্রয়োজন, অন্তর্বর্তী সরকারের পচাগলা অবস্থা, আর মস্কোতে তার ঘোষিত ‘অপসারণ’, অর্থনীতির বিধ্বস্ত অবস্থা আর ক্ষুধা, বেকারত্ব আর জনগণের দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া– এ সবই রাশিয়ার বিপ্লবী শ্রেণিগুলোকে অপ্রতিরোধ্য ভাবে উদ্বুদ্ধ করছে ক্ষমতা দখল করতে। অর্থাৎ সর্বহারা এবং বিপ্লবী কৃষকের একনায়কত্বের জন্য দেশ ইতিমধ্যেই পরিপক্ক হয়ে উঠেছে।
অবশেষে সময় এসেছে ‘সব ক্ষমতা চাই সোভিয়েতের হাতে’– এই স্লোগানকে বাস্তবায়িত করার।