সোভিয়েটের বিরুদ্ধে ফ্যাসিস্ট জার্মানিকে মদত দিয়েছিল পশ্চিমী সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলিই

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ফ্যাসিস্ট জার্মান বাহিনীর পরাজয়ের ৭৫ বছর পূর্ণ হল ৮ মে। মহান স্ট্যালিনের নেতৃত্বে সোভিয়েট লালফৌজ জার্মান ফ্যাসিস্ট বাহিনীকে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে বিতাড়িত করে ১৯৪৫-এর ৮ মে পৌঁছে গিয়েছিল বার্লিনে। জার্মান পার্লামেন্টের গম্বুজে উত্তোলিত করেছিল মুক্তির লাল পতাকা। প্রতি বছর এই দিনটিকে বিশ্বের গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষ গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে। একই সঙ্গে স্মরণ করে ফ্যাসিস্টদের উৎখাত এবং গণতন্ত্র উদ্ধারে লালফৌজের সংগ্রামকে। ইউরোপ যখন ফ্যাসিস্ট বাহিনীর দুর্ধর্ষ আক্রমণে পর্যুদস্ত, যখন একের পর এক দেশ ফ্যাসিস্ট বুটের তলায় নতজানু হয়ে পড়েছে, তখন মহান স্ট্যালিনের নেতৃত্বে একমাত্র লাল ফৌজই অসীম বীরত্বে, সাহসিকতায়, অগণিত আত্মদানে, মানবতার প্রতি গভীর দায়িত্বশীলতা ও গণতন্তে্রর প্রতি অবিচল নিষ্ঠায় কঠিন লড়াই লড়েছে। তার ফলে সোভিয়েত লালফৌজ বিশ্বের শ্রমজীবী মানুষের নয়নের মণি প্রথম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র সোভিয়েট ইউনিয়নকে যেমন মুক্ত করেছে তেমনই গোটা ইউরোপকেও মুক্ত করেছে। সে সবই আজ ইতিহাস। সেই ইতিহাসে লাল ফৌজের ভূমিকা যেমন এক আলোকোজ্জ্বল দিক, ঠিক তেমনই এর বিপরীতে রয়েছে এক অন্ধকারময়, ষড়যন্ত্রপূর্ণ কুৎসিত দিক।

সেই ষড়যন্ত্র ফ্যাসিস্ট আক্রমণের মধ্য দিয়ে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নকে সেদিন বিশ্বের মানচিত্র থেকে মুছে দিতে চেয়েছিল। বস্তুত, একা ফ্যাসিস্ট হিটলার বাহিনী নয়, আমেরিকা ইংল্যান্ড সহ সমস্ত সাম্রাজ্যবাদী-পুঁজিবাদীদের লক্ষ্য ছিল যুদ্ধের সুযোগে সোভিয়েতকে ধ্বংস করা। আসলে যুদ্ধটা ছিল এই সমস্ত তথাকথিত মিত্রশক্তির অন্তর্ভুক্ত সাম্রাজ্যবাদীদের স্বার্থেই। বিশ্ব জুড়ে পুঁজিবাদের তীব্র সংকটের মুখে পড়ে তাদের দরকার হয়ে পড়েছিল নতুন বাজার দখলের জন্য ঝাঁপানো। এর জন্য যুদ্ধই ছিল তাদের একমাত্র রাস্তা। এই সময় সামরিক অস্ত্র আর তার সরঞ্জাম তৈরিই হয়ে ওঠে তাদের শিল্পের প্রধান উৎপাদন। একদিকে তাদের যেমন সাম্রাজ্যবাদী হিসাবে নিজেদের মধ্যে মারামারি কাটাকাটি ছিল, একই সাথে সমাজতন্ত্রকে ধ্বংসের কাজে তাদের স্বার্থ ছিল এক। তাই যুদ্ধটাকে চালিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি তাদের চেষ্টা ছিল ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের ভূমিকাকে আড়াল করে, ছোট করে দেখানো। আজও সেই ষড়যন্ত্র সমান সক্রিয়।

আজ একদিকে যখন প্রবল আর্থিক মন্দায় বিশ্ব জুড়ে পুঁজিবাদী অর্থনীতি হাবুডুবু খাচ্ছে, দেশে দেশে শ্রমিক, কৃষক, শোষিত জনতা পুঁজিবাদী শাসকদের বিরুদ্ধে ক্ষোভে ফুঁসছে, করোনা পরিস্থিতিতে শক্তিশালী পুঁজিবাদী দেশগুলোতেও জনগণের জীবন রক্ষায় শাসকদের সীমাহীন ব্যর্থতা প্রকট হয়ে উঠছে, সমাজতন্তে্র জনগণের জীবন রক্ষায় রাষ্টে্রর অপরিসীম দায়িত্বশীলতার কথা দেশে দেশে মানুষের মধ্যে নতুন করে আলোচ্য বিষয় হিসেবে উঠে আসছে, তখন বুর্জোয়া শাসক শ্রেণি মার্কসবাদ-লেনিনবাদ, সমাজতন্ত্র, বিশেষত সোভিয়েত সমাজতন্তে্রর রূপকার স্ট্যালিনের বিরুদ্ধে তাদের আক্রমণ, মিথ্যাচার, কুৎসা আরও তীব্র করে তুলছে। ইতিহাস বিকৃত করছে।

আমাদের দেশেও শাসক শ্রেণি তাদের পরিচালিত সংবাদমাধ্যমকে লাগাতার সেই কাজে লাগাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে দেখা যাক বিশ্বযুদ্ধে ফ্যাসিস্ট আক্রমণের থেকে বিশ্বকে মুক্ত করার যে মিথ্যে গৌরব প্রচার করছে পশ্চিমী সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলি, বাস্তবে এই যুদ্ধ পরিস্থিতিতে তাদের কী ভূমিকা ছিল, আর মহান স্ট্যালিনের নেতৃত্বে লালফৌজ কী ভূমিকা পালন করেছিল। ১৯৩৯-এর ১ সেপ্টেম্বর জার্মানির পোল্যান্ড আক্রমণের মধ্য দিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আনুষ্ঠানিক সূচনা হয়। যদিও এর প্রস্তুতি শুরু হয়েছিল অনেক আগে থেকেই।

পরাজিত জার্মানির উত্থান

একটা প্রশ্ন স্বাভাবিক ভাবেই এসে যায়– ১৯১৪-‘১৮-র প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পরাজিত জার্মানির উপর বিজয়ী ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স ভার্সাই চুক্তি চাপিয়ে দিয়েছিল তার আর্থিক ও সামরিক মেরুদণ্ড ভেঙে দিতে, তা সত্ত্বেও অতি অল্প সময়ের মধ্যে জার্মানির এই বিদ্যুৎগতি উত্থান কীভাবে সম্ভব হল? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে সাম্রাজ্যবাদী পুঁজির বাজার দখলের চরম নীতিহীন লড়াই, আপসকামিতা এবং তীব্র কমিউনিস্ট বিদ্বেষের ইতিহাসকে স্মরণে রাখা দরকার। ভার্সাই চুক্তি অনুসারে জার্মানির আয়ের প্রায় সমস্ত সুযোগে কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। স্বাভাবিকভাবেই তার উপর চাপানো বিপুল ক্ষতিপূরণ সে মেটাতে পারছিল না। জার্মান অর্থনীতি পুরোপুরি হয়ে পড়েছিল ঋণনির্ভর। এই অবস্থায় ব্রিটেন-আমেরিকা-ফ্রান্সের সাম্রাজ্যবাদী পাণ্ডারা ক্ষতিপূরণ আদায়ের একটা নতুন ফিকির তৈরি করল। তারা নিদান দিল, আমেরিকা ও অন্য মিত্রশক্তিগুলি জার্মানিকে তার শ্রমশিল্প এবং বহির্বাণিজ্য গড়েতোলার জন্য টাকা ধার দেবে এবং এভাবে জার্মানির যে অতিরিক্ত রপ্তানি বাণিজ্য তৈরি হবে তা থেকে এই দেশগুলি কিস্তিতে যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ আদায় করবে। ইতিমধ্যে মার্কিন অর্থনীতিতে উৎপাদনের জোয়ার তৈরি হয়েছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যুদ্ধরত এবং যুদ্ধভীত সব দেশকে সমান ‘নিরপেক্ষতায়’ খাদ্য, বস্ত্র এবং সমরসম্ভার জুগিয়ে মার্কিন পুঁজিপতিরা বিপুল পুঁজির অধিকারী হয়ে পড়ল। ভার্সাই চুক্তিকে দু’পায়ে মাড়িয়ে মার্কিন পুঁজিপতিরা জার্মান শিল্পে, বিশেষত তাদের সমরাস্ত্র নির্মাণ শিল্পে ব্যাপক অর্থ লগ্নি করতে থাকল। ১৯৩৩-এ হিটলার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর মার্কিন ও ব্রিটিশ পুঁজি স্রোতের মতো ঢুকতে থাকল জার্মানির সমরশিল্পে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে পর্যন্ত মার্কিন শিল্পপতিরা জার্মানিতে ১০০কোটি ডলার লগ্নি করেছিল।

এক দিকে যুদ্ধে পরাস্ত হয়ে, অন্য দিকে বিশ্বজোড়া মহামন্দার কবলে পড়ে জার্মানি, ইতালি প্রভৃতি ইউরোপের দেশগুলিতে প্রবল গণবিক্ষোভ, শ্রমিক বিক্ষোভ শুরু হয়ে যায়। রুশ বিপ্লবের ঢেউ আছড়ে পড়ে দেশগুলিতে। দলে দলে মানুষ সমাজতন্তে্রর সমর্থক হয়ে পড়তে থাকে। ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে জাতীয় পুঁজিপতি শ্রেণী। ১৯২০ সালে ইতালিতে বিপ্লবের পরিস্থিতি তৈরি হয়। জার্মানিতে সোস্যাল ডেমোক্র্যাট এবং কমিউনিস্টদের প্রতি সমর্থন হু হু করে বাড়তে থাকে। এই অবস্থায় জার্মান শিল্পপতিরা কমিউনিস্ট আতঙ্ক থেকে রক্ষা পেতে হিটলারের পিছনে গিয়ে জড়ো হয়। ইউরোপে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলিও হিটলারের কমিউনিস্টবিরোধী কর্মসূচি লক্ষ করে সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক শক্তির বিরুদ্ধে সমবেত হতে থাকল। ফ্রান্স ও ইংল্যান্ড জার্মানির উপর চাপানো ভার্সাই চুক্তি একরকম তুলেই নিল। এবং বিপুল মুনাফার লোভে ব্যাঙ্ক অফ ইংল্যান্ড জার্মানির অস্ত্রসজ্জার জন্য অর্থ যোগাতে লাগল। ব্রিটিশ সমরাস্ত্র নির্মাণ কারখানা ভিকার্স আর্মস্ট্রং কোম্পানি জার্মানিকে প্রত্যক্ষভাবে সাহায্য করতে থাকল। ব্রিটিশ সরকার সব জেনেও পুঁজিপতি শ্রেণির চাপে চোখ বন্ধ করে থাকল। যে ‘সার’ অঞ্চল নিয়ে ফ্রান্সের সঙ্গে জার্মানির বিরোধ ছিল, কয়লা খনি সমৃদ্ধ জার্মান শিল্পক্ষেত্রের প্রাণ সেই অঞ্চলটি ফ্রান্স জার্মানিকে ফিরিয়ে দিল ১৯৩৫ সালের শুরুতেই। হিটলারঘোষণা করলেন, ভার্সাই চুক্তি মানতে জার্মানি বাধ্য নয়। ইংল্যান্ড বা ফ্রান্স কেউ তার কোনও প্রতিবাদ করল না। ফ্রান্সের একচেটিয়া পুঁজির মালিক হিটলারের সমর্থনে এগিয়ে এল। হিটলারের যুদ্ধ আয়োজনের অন্যতম প্রধান সমস্যা আকরিক লোহার অভাব মেটাতে তারা ফ্রান্সের বিখ্যাত লোরেন খনির লৌহ আকরিক জোগানোর দায়িত্ব নিল। সোজা কথায় ব্রিটিশ-ফরাসি পুঁজিপতিদের ক্রমাগত আনুকূল্য ও সাহায্য দানে এবং জার্মান শিল্পপতিদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতায় হিটলার ও নাৎসি দল দ্রুতগতিতে ইউরোপে সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠীর প্রধান পাণ্ডা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে থাকল।

১৯১৯ সাল থেকে ১৯৩৯ পর্যন্ত ২০ বছরের ইতিহাস খোঁজ করলে দেখা যাবে, ব্রিটিশ, আমেরিকা ও অন্যান্য পশ্চিমী শক্তিগুলো ক্রমাগত সোভিয়েত রাশিয়ার বিরুদ্ধতার নীতি অনুসরণ করেছে। যে নীতির ফলেই ইউরোপে জার্মানি এবং এশিয়ায় জাপান সাম্রাজ্য বিস্তার ও যুদ্ধের প্রস্তুতিতে প্রকৃত সহায়তা পেয়েছে।

সোভিয়েত বিরোধী ষড়যন্ত্র

সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলির সোভিয়েট বিদ্বেষের কারণে ১৯৩৫ সালে যুদ্ধের ষড়যন্ত্র ক্রমশ গভীর হয়ে উঠতে লাগল। জার্মানি ও জাপান সোভিয়েত বিরোধী অভিযানের চুক্তিতে স্বাক্ষর করল। জার্মানি ও ইতালি কমিউনিজমের কবল থেকে মুক্ত করার নাম করে স্পেনের রিপাবলিকান সরকারের বিরুদ্ধে সেখানকার ফ্যাসিস্ট নেতা ফ্রাঙ্কোকে ট্যাংক, কামান এবং বিমান বহর পাঠিয়ে ক্ষমতা দখল করতে সাহায্য করল। ব্রিটেন ও ফ্রান্স নিরপেক্ষতার ভান করে সবকিছু চুপচাপ দেখে গেল শুধু নয়, কিছুদিনের মধ্যে স্বৈরশাসক ফ্রাঙ্কোকেই বৈধ শাসক হিসেবে স্বীকৃতি দিল। সোভিয়েত বিরোধী জার্মান-জাপান চুক্তিতে ১৯৩৭ সালে ইতালিও যোগ দিল। ১৯৩৮-এ অস্ট্রিয়া দখল করে নিল জার্মানি। এরপর হিটলার চেকোশ্লোভাকিয়ার জার্মান অধ্যুষিত অঞ্চল সুদেতল্যান্ড দাবি করে বসল। ফ্যাসিস্ট গুপ্তচররা সেখানকার জার্মানদের প্ররোচনা দিয়ে চেক সরকারের বিরুদ্ধে মিথ্যা ও অতিরঞ্জিত অত্যাচারের অভিযোগ এনে জার্মানির সঙ্গে মিশে যাওয়ার দাবি তুলতে লাগল। সেখানকার জার্মান নাৎসি নেতা নানা ধ্বংসাত্মক কাজকর্ম চালাতে থাকল। অবিলম্বে সুদেতল্যান্ড না ছাড়লে হিটলার যুদ্ধের হুমকি দিলেন। যুদ্ধ থামাবার নামে হিটলারকে তুষ্ট করতে ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী চেম্বারলেন, ফ্রান্সের প্রধানমন্ত্রী দালাদিয়ের, ইতালির প্রেসিডেন্ট মুসোলিনি মিউনিখে চেকোশ্লোভাকিয়াকে ছাড়াই এবং ইউরোপের অন্যতম শক্তি সোভিয়েত ইউনিয়নকে বাদ দিয়ে ১৯৩৮-এর ১৯ সেপ্টেম্বর এক চুক্তিতে স্বাক্ষর করলেন এবং সেই চুক্তি অনুযায়ী চেকোশ্লোভাকিয়াকে জার্মানির হাতে সুদেতল্যান্ড ছেড়ে দিতে বাধ্য করা হল। ওই একই সময়ে মিউনিখে বসে চেম্বারলেন হিটলারের সঙ্গে এক ব্যক্তিগত বৈঠকে ব্রিটেন ও জার্মানি পরস্পরের বিরুদ্ধে কখনও যুদ্ধ করবে না, এই মর্মে এক প্রতিশ্রুতিপত্রে স্বাক্ষর করলেন এবং এটাকে শান্তির লক্ষ্যে বিরাট সাফল্য বলে দেশে ফিরে প্রচার করতে থাকলেন। অথচ চেকোশ্লোভাকিয়ার সামরিক শক্তি যথেষ্ট উন্নত ছিল। তেমনি ফ্রান্সের সঙ্গে তার পারস্পরিক আত্মরক্ষার চুক্তি এবং সোভিয়েত রাশিয়ার সঙ্গে মৈত্রী চুক্তি ছিল। চাইলেই ফ্রান্স কিংবা ব্রিটেন জার্মানির এই জবরদস্তি রুখে দিতে পারত। বাস্তবে তারা মনে করেছিল, এর দ্বারা তারা জার্মানিকে ক্রমাগত রাশিয়ার বিরুদ্ধে ঠেলে নিয়ে চলেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সোভিয়েত সেনাপতি মার্শাল ঝুকভ লিখেছেন, সোভিয়েত লালফৌজ চেকোশ্লোভাকিয়াকে সামরিক সাহায্য দেওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিল। বিমান বাহিনীকে তৈরি রাখা হয়েছিল। কিন্তু তদানীন্তন চেক শাসকরা এই সাহায্য নিতে অস্বীকার করে এবং আত্মসমর্পণকেই শ্রেয় মনে করে। এর কিছুদিনের মধ্যেই ১৯৩৯-এর ১৫ মার্চ হিটলার সমগ্র চেকোশ্লোভাকিয়া দখল করে নেয়। এর ফলেচেকোশ্লোভাকিয়ার বিখ্যাত স্কোডা সমরাস্ত্র কারখানা এবং আরও ২৩টি অস্ত্র কারখানা, যেগুলি একত্রে ফ্যাসিস্ট ইটালির সমস্ত যুদ্ধাস্ত্র কারখানার চেয়ে তিনগুণ বড়, সেগুলি সবই হিটলারের সম্পত্তিতে পরিণত হল। মিউনিখ চুক্তির দ্বারা চেকোশ্লোভাকিয়াকে এভাবে বলি দিয়ে ব্রিটিশ-ফরাসি শক্তিগুলি জার্মানির যুদ্ধগত অবস্থানের ব্যাপক শক্তিবৃদ্ধি ঘটাল। এর ফলে জার্মানি যেমন তার আয়তন অনেকখানি বাড়িয়ে নিল, তেমনি তার জনসংখ্যা বাড়ল ৩০ লক্ষ ৫০ হাজার। এর মধ্যে ছিল চেক বাহিনীতে উত্তম প্রশিক্ষণ পাওয়া তিন লক্ষ উৎকৃষ্ট সৈন্য। রণনীতির দিক থেকে তার কাছে মধ্য ও দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপের দরজা খুলেগেল। অথচ মিউনিখ চুক্তি মারফত চেক রাষ্ট্র যদি নিশ্চিহ্ন না হত, তবে পূর্বে রাশিয়া ও পশ্চিমে ফ্রান্স– এই দুয়ের মধ্যে যোগসূত্র থাকত এবং এই তিনটি রাষ্ট্রই সন্ধিসূত্র দ্বারা পরস্পর আবদ্ধ ছিল।

মহাযুদ্ধের পর বার্লিনের পররাষ্ট্র দপ্তরের কাগজপত্রে দেখাগেল, হিটলারের অস্ট্রিয়া দখলের় আগেই ১৯৩৭-এর ১৯ নভেম্বর ব্রিটেনের লর্ড চ্যান্সেলর হ্যালিফা’ (পরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী) ওবারস্যালমবার্গে হিটলারের সঙ্গে এক বৈঠকে বলেছিলেন, ‘‘ফুয়েরার তাঁর নিজ দেশে কমিউনিজম ধ্বংস করে পশ্চিম দিকে এই মতবাদের অগ্রগতি রোধ করেছেন। তাই ব্রিটিশ সরকার মনে করে, পশ্চিম ইউরোপে বলশেভিজম প্রতিরোধের পক্ষে জার্মানি একটি দুর্গের মতো। লর্ড হ্যালিফা’ স্বীকার করেন, আজ হোক কাল হোক ইউরোপীয় ব্যবস্থার মধ্যে পরিবর্তন আসবেই এবং পরিবর্তনের এই প্রশ্নগুলির মধ্যে রয়েছে ভানজিগ, অস্ট্রিয়া ও চেকোশ্লোভাকিয়া।” অর্থাৎ চেম্বারলেন সরকার এই দেশগুলির নিয়ন্ত্রণ হিটলারের হাতে তুলেদেওয়ার জন্য আগে থেকেই প্রস্তুত ছিলেন। অথচ চেক বিরোধের সূত্রপাতেই সোভিয়েট পররাষ্ট্রমন্ত্রী লিটভিনোভ পররাজ্য আক্রমণ ও তাতে বাধাদেওয়ার উদ্দেশ্যে ব্রিটেন, ফ্রান্স, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত রাশিয়া– এই চার শক্তির একটি সম্মেলন ডাকার জন্য এবং যৌথ নিরাপত্তা নীতি অবলম্বনের জন্য ১৭ মার্চ ১৯৩৮ এক প্রস্তাব আনেন। কিন্তু ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চেম্বারলেন তৎক্ষণাৎ তা নাকচ করেদেন। এইভাবে ইউরোপের পরিস্থিতি ক্রমাগত অগ্নিগর্ভ হতে থাকে এবং ইউরোপের সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো জার্মানিকে সামনে রেখে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্রের জাল বিছাতে থাকে।

১৯৩৯-এর ১০ মার্চ সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির অষ্টাদশ কংগ্রেসের অধিবেশনের ভাষণে কমরেড স্ট্যালিন বললেন, ‘‘পশ্চিমের গণতন্ত্রবাদী দেশগুলির বিশেষত ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতিকরা যৌথ নিরাপত্তার নীতি অগ্রাহ্য করেছে। এর বদলে তারা এখনওসোভিয়েত বিরোধী কোয়ালিশনের স্বপ্নদেখছে এবং এই মনোভাবকে তারা শান্তিবাদিতা, নিরপেক্ষতা ইত্যাদি কূটনৈতিক শব্দের দ্বারা আড়াল করছে। এই অবস্থায়সোভিয়েত রাশিয়ার বুঝতে অসুবিধা হয় না, ব্রিটেন ও ফ্রান্সের সঙ্গে বাস্তবিক কাজে লাগার মতো কোনও বোঝাপড়াই সম্ভব হবে না।

নাৎসি আক্রমণের কবলে ব্রিটেন-ফ্রান্স

অন্য দিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন যে আত্মরক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছে, হিটলার তা জানতেন। কিন্তু ১৯৩৯ সালে সোভিয়েতের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামতে হলে যা প্রস্তুতি প্রয়োজন তা হিটলারের ছিল না। তাই ইউরোপের অবশিষ্ট দেশগুলি দখল করে সেইসব দেশের সম্পদ করায়ত্ত করে জার্মান বাহিনীর আক্রমণ-ক্ষমতাকে তিনি চূড়ান্ত মাত্রায় নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। ফলে আপাতত পশ্চিম ইউরোপের দিকে যুদ্ধকে সীমাবদ্ধ করাই ছিল জার্মানির লক্ষ্য। স্বভাবতই পূর্ণশক্তি পশ্চিমে নিয়োজিত করলে পূর্বে অর্থাৎ সোভিয়েত সীমান্তে তার সামরিক শক্তি প্রয়োজনের তুলনায় দুর্বল থাকবে। এই পরিস্থিতিতে পূর্ব সীমান্ত নিয়ে নিশ্চিন্ত থাকার আশু প্রয়োজনে জার্মানি অনাক্রমণ চুক্তির প্রস্তাব পেশ করে সোভিয়েতের কাছে। চার্চিল তাঁর ‘দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাস’ বইয়ের প্রথম খণ্ডে লিখেছেন, রাশিয়া ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সকে নিয়ে ত্রিশক্তি চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য রুশ-প্রস্তাব ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চেম্বারলেন খারিজ করেন। এরপর ১৯ আগস্ট রুশ-জার্মান চুক্তির বিষয়টি স্ট্যালিন পলিটবুরোতে রাখেন। ২২ আগস্ট হিটলারের স্বরাষ্ট্রসচিব রিবেনট্রপ মস্কো আসেন এবং ২৪ আগস্ট রুশ-জার্মান অনাক্রমণ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।

কিন্তু অনুকূল পরিস্থিতি তৈরি হওয়া মাত্রই জার্মানি চুক্তি ভঙ্গ করে সোভিয়েট আক্রমণ করবে– সোভিয়েট নেতৃত্ব তা জানত। তবু যতটুকু সময় এর ফলে পাওয়া যাবে সেই সময়ের মধ্যে যুদ্ধ প্রস্তুতি আরও শক্তিশালী করে সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন থেকে সোভিয়েটকে রক্ষা করাই ছিল তার অন্যতম লক্ষ্য। তা ছাড়া এই চুক্তি স্বাক্ষর করে সোভিয়েট বিশ্ববাসীকে এটাও বুঝিয়ে দেয় যে, তারা যুদ্ধ চায় না, তারা শান্তিকামী। পরবর্তীকালে এই আশঙ্কাই সত্য প্রমাণিত হয়েছে। হিটলার এই চুক্তির প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করে সোভিয়েটকে আক্রমণ করেছে এবং সোভিয়েট তা প্রতিরোধ করেছে।

রুশ-জার্মান যুদ্ধ শুরুর পর ১৯৪১ সালের ৩ জুলাই প্রথম বেতার ভাষণে স্ট্যালিন এই চুক্তি প্রসঙ্গে বলেন, ‘‘অনাক্রমণ চুক্তি হল দুটি রাষ্টে্রর মধ্যে শান্তি চুক্তি। ১৯৩৯ সালে এই চুক্তির প্রস্তাব জার্মানিই আমাদের দিয়েছিল। … আমি মনে করি, প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে শান্তিচুক্তির প্রস্তাব কোনও শান্তিকামী দেশই প্রত্যাখ্যান করতে পারে না। এমনকি প্রতিবেশী দেশের সরকারি ক্ষমতার শীর্ষে হিটলার ও রিবেনট্রপের মতো নরখাদক শয়তান থাকলেও নয়। এ ক্ষেত্রে অপরিহার্য শর্ত একটাই, তা হল চুক্তি কোনও মতেই প্রত্যক্ষে বা পরোক্ষে শান্তিকামী দেশের ভৌগোলিক সংহতি, স্বাধীনতা ও সম্মানের হানি ঘটাবে না। সোভিয়েট-জার্মান অনাক্রমণ চুক্তি এই ধরনেরই একটা চুক্তি।”

এই সোভিয়েট-জার্মান অনাক্রমণ চুক্তির ফলে হিটলারের মিত্ররা ত্রুদ্ধ হয়ে ওঠে। মুসোলিনি খোলাখুলি বিরোধিতা করেন।ক্ষিপ্ত হয় জাপানও। জাপান ইতিমধ্যেই মঙ্গোলিয়ার সীমানায় সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে যুদ্ধ বাধিয়ে দিয়েছিল। জাপান হিটলারকে জানিয়ে রেখেছিল যে, আগস্ট নাগাদ সে রুশবিরোধী অভিযানে যোগ দিতে পারবে। কিন্তু এই চুক্তির ফলে জাপানের পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। সবচেয়ে ক্ষিপ্ত হয় হিটলারের লন্ডনস্থ রক্ষণশীল পৃষ্ঠপোষকেরা। এই প্রথম তারা হিটলারের বিরুদ্ধে গর্জন করে ওঠে।

১৯৩৯-এর ১ সেপ্টেম্বর জার্মান ফ্যাসিস্ট বাহিনী পোল্যান্ড আক্রমণ করে। দু’দিন বাদে ব্রিটেন ও ফ্রান্স যুদ্ধ ঘোষণা করে জার্মানির বিরুদ্ধে। কিন্তু ওই ঘোষণা পর্যন্তই। তারা যুদ্ধ কোথাও করেনি। হিটলার বাহিনীর বিরুদ্ধে একটি আঙুলও তোলেনি। পারস্পরিক সহযোগিতা চুক্তি থাকা সত্তে্বও তারা ফ্যাসিস্ট আক্রমণ প্রতিরোধে কোনও সাহায্য করেনি।

১৯৪০-এর ৯ এপ্রিল জার্মান ফ্যাসিস্ট বাহিনী নরওয়ে এবং ডেনমার্কে হানা দেয়। যে ব্রিটিশ-ফরাসি বাহিনীকে জার্মানদের সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য পাঠানো হয়েছিল তারা জার্মান আক্রমণের সামনে দাঁড়াতে পারেনি। মে মাসে হল্যান্ড, বেলজিয়াম ও লুক্সেমবুর্গ দখলের পর যখন ফ্যাসিস্ট বাহিনী ফ্রান্স দখলে ঝাঁপ দেয়, সেখানে ডানকার্কে অবরুদ্ধ ব্রিটিশ বাহিনীর প্রতি হিটলারের অপ্রত্যাশিত করুণা প্রদর্শনের ঘটনায় রাজনৈতিক মহল বিস্মিত হয়েছিল। ১৯ মে থেকে ৪ জুন ডানকার্কই হতে পারত প্রায় সমগ্র ব্রিটিশ ও ফরাসি বাহিনীর সমাধিক্ষেত্র। কিন্তু তা হল না। ইতিহাসের এই ঘটনা প্রথমে ‘মিরাকল’ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছিল। পরে সত্য উদঘাটিত হয়। এই যুদ্ধে জার্মানির জয় যখন সুনিশ্চিত, তখন হঠাৎ হিটলার যুদ্ধ স্থগিতের নির্দেশ দেন। ২ লক্ষ ২৪ হাজার ৫৮৫ জন ব্রিটিশ সেনা ইংল্যান্ডে ফিরে যেতে সক্ষম হয় এবং সেই সঙ্গে ১ লক্ষ ১২ হাজার ৫৪৬ জন ফরাসি সেনাও। হিটলার ডানকার্কে ব্রিটিশ ও ফরাসি বাহিনীকে ধ্বংস করে দিলে তো সব শেষ হয়ে যেত! হিটলার তা হতে দেননি কেন? হিটলারের ভাবনা ছিল, ফ্রান্সের সঙ্গে একটা যুক্তিসঙ্গত শান্তি-সন্ধি করার পর ব্রিটেনের সঙ্গে চুক্তি করারও অবাধ সুযোগ পাওয়া যাবে। এরপর হিটলার ১৯৪০-এর ৮ আগস্ট ব্রিটেন আক্রমণ করেন। সোভিয়েত আক্রমণের আগে ব্রিটেনকে নতজানু করানোই ফ্যাসিস্ট জার্মানির সবচেয়ে বেশি কাঙ্খিত ছিল। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সঙ্গে সম্মিলিত সমরশক্তি নিয়ে তারা সোভিয়েতের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে চেয়েছিল। কিন্তু ৮ আগস্ট থেকে বেপরোয়া বিমান আক্রমণ চালিয়েও ব্রিটেনকে সন্ধি প্রস্তাবে রাজি করানো যায়নি। ব্রিটেনকে ধ্বংস ও দখল করা নয়, ভয়ঙ্কর আক্রমণের চাপ সৃষ্টি করে ব্রিটেনকে নিজেদের শর্তে সন্ধি করানোই ছিল ফ্যাসিস্ট জার্মানির লক্ষ্য। তার লক্ষ্য, বনেদি সাম্রাজ্যবাদী দেশ ব্রিটেন ও ফ্রান্সকে হঠিয়ে নিজে বিশ্ববাজার দখল করা ও সাম্রাজ্যবাদের শিরোমণির স্থানটি অধিকার করা। বাজার নিয়ে সাম্রাজ্যবাদী শিবিরের দ্বন্দ্বই ছিল যুদ্ধের কারণ। তাই সোভিয়েটের বিরুদ্ধতার প্রশ্নে সম মনোভাব থাকলেও ব্রিটেনের পক্ষে জার্মানির শ্রেষ্ঠত্ব মেনে জার্মানির পক্ষে যোগ দেওয়া সম্ভব ছিল না। বিশ্ববাজারের উপর নিজস্ব সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্য ছেড়ে দিতে সে রাজি ছিল না। আবার রাশিয়ার বিরুদ্ধে জার্মানিকে সে কাজে লাগাতেও চাইছিল।

ইতিহাসের হিংস্রতম আক্রমণ সোভিয়েটে

আজ পশ্চিমী সাম্রাজ্যবাদীদের মদতপুষ্ট লেখকরা দেখাতে চাইছেন, বিশ্বযুদ্ধে ইউরোপই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল এবং ইউরোপকে মুক্ত করার ক্ষেত্রেও তাঁরা স্ট্যালিনের নেতৃত্বে লালফৌজের ভূমিকাকে উড়িয়ে দিয়ে ব্রিটেন-আমেরিকার ভূমিকাকেই সামনে নিয়ে আসছেন। কেউ কেউ তো আবার চার্চিলকে ‘মুক্তিযুদ্ধের সেনাপতি’ই বলে বসছেন! অথচ, ইউরোপের ক্ষতি যা হয়েছে, তা সেই দেশগুলির নেতৃত্বের আত্মঘাতী নীতিরই ফল। সোভিয়েট বিদ্বেষ থেকে ফ্যাসিবিরোধী কোনও জোট ও সম্মিলিত প্রতিরোধ না গড়ে তোলার কারণেই তা ঘটেছিল। আর ধ্বংসকাণ্ড, ক্ষয়ক্ষতি তো হয়েছিল সোভিয়েটেরই সবচেয়ে বেশি। জার্মানি যখন সোভিয়েট আক্রমণ করে, ততক্ষণে ব্রিটেন বাদে প্রায় সমগ্র ইউরোপ জার্মানবাহিনীর দখলে। তারা যে সব দেশ দখল করেছিল, তাদের সমগ্র অর্থনীতিকেও জার্মান সমরাস্ত্র নির্মাণের কাজে লাগানো হয়েছিল। পরাজিত দেশগুলির সমগ্র অর্থনীতি, তাদের সমস্ত প্রাকৃতিক সম্পদ যেমন জ্বালানি তেল, ইস্পাত, কয়লা, খাদ্য, কাঁচামাল– সবকিছুই তখন জার্মান বাহিনী যুদ্ধের কাজে ব্যবহার করেছিল। এছাড়া ছিল তাদের সুদৃঢ় ফ্যাসিস্ট জোট, যাতে জার্মানি ছাড়াও ছিল জাপান, ইতালি, ফিনল্যান্ড, হাঙ্গেরি ও রোমানিয়া। জাপান ছাড়া সব রাষ্ট্রই তাদের সেরা বাহিনী নিয়ে সামিল হয়েছিল সোভিয়েট বিরোধী যুদ্ধে। ফলে, সোভিয়েটকে লড়তে হয়েছে প্রায় ইউরোপের সামগ্রিক শক্তির বিরুদ্ধে। তবুও যে তারা এই যুদ্ধে জয়ী হয়েছিল, তার কারণ, লালফৌজ লড়েছিল স্বাধীনতা ও গণতন্তে্রর পক্ষে। সর্বোপরি, তাদের বুকে ছিল মার্কসবাদ-লেনিনবাদ এবং মহান স্ট্যালিনের আহ্বান।

গোটা ইউরোপ যখন জার্মান নাৎসি বুটের তলায় আত্মসমর্পণ করেছে তখন সোভিয়েট বাহিনীই নাৎসী বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রথম সত্যিকারের প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। যে জার্মান বাহিনীর অপরাজেয়তার তত্ত্বগোটা ইউরোপ প্রায়মেনে নিয়েছিল সেই তত্ত্ব প্রথম ধাক্কা খায় সোভিয়েট প্রতিরোধে, স্ট্যালিনগ্রাডে জার্মান বাহিনীর শোচনীয় পরাজয়ে। স্ট্যালিনগ্রাডে জার্মান বাহিনীর এই পরাজয়ের প্রতিক্রিয়া হয়েছিল সুদুরপ্রসারী। জার্মানির বিপুল সৈন্যক্ষয় হয়েছিল। ইতালির অবস্থা কাহিল হয়ে পড়েছিল। বিশেষভাবে জার্মানি এবং ইতালির সম্পর্কের উপর আঘাতটা সবচেয়ে বেশি পড়েছিল। এই প্রথম দুই শক্তির মধ্যে অবিশ্বাস এবং সন্দেহের সূচনা দেখা দিয়েছিল এবং মুসোলিনি পূর্ব রণাঙ্গনে যুদ্ধে ক্ষান্ত দেওয়ার জন্য একেবারে অস্থির হয়ে পড়েছিলেন। সোভিয়েত আক্রমণে জার্মানি-ইতালি অক্ষশক্তির বিপুল ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াও সহযোগী অন্যান্য তাঁবেদার রাষ্ট্রগুলির অবস্থাও কাহিল হয়ে পড়েছিল। পূর্ব রণাঙ্গনে তাদের যে বিপুল ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল তার ধাক্কা সামলানো এই দেশগুলির পক্ষে কঠিন হয়ে পড়েছিল। স্ট্যালিনগ্রাডের যুদ্ধে রোমানিয়ার ৩ লক্ষ সৈন্য নষ্ট হয়েছিল। হাঙ্গেরিয়ান সৈন্যবাহিনীর ১ লক্ষ ৪৬ হাজার নিহত ও ৩০ হাজার আহত হয়েছিল। ফিনিশ সৈন্যবাহিনীর অধিনায়ক জেনারেল ম্যানারহেইম স্বীকার করেছিলেন যে, তাঁদের এত বেশি সৈন্যক্ষয় হয়েছিল যে আর এগোনো সম্ভব ছিল না।

স্ট্যানিলগ্রাডে লালফৌজের জয়লাভ ও জার্মানির পরাজয়ের ফলে অধিকৃত দেশগুলিতে প্রতিরোধ আন্দোলন, গেরিলা যুদ্ধ এবং রাজনৈতিক-সামাজিক মুক্তি আন্দোলনও ক্রমাগত জোরদার হতে থাকে। ইতালি, রোমানিয়া, বুলগেরিয়া, হাঙ্গেরি ইত্যাদি দেশগুলিতে যুদ্ধ ও ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে এবং নতুন সামাজিক মুক্তির দাবিতে জনগণের মধ্যে বিক্ষোভ ও আন্দোলন ক্রমাগত সঙ্ঘবদ্ধ হতে থাকে, যা নাৎসি নেতাদের গভীরভাবে উদ্বিগ্ন করেতোলে।

স্ট্যালিনগ্রাড ঘুরিয়ে দিল যুদ্ধের অভিমুখ

স্ট্যালিনগ্রাডে লালফৌজের বিজয়ের পর যুদ্ধের স্রোত পুরোপুরি উল্টো দিকে ঘুরে যায়। ১৯৪৪-এর গ্রীষ্মকালের প্রথম দিকে লালফৌজ জার্মান বাহিনীকে তাড়িয়ে সোভিয়েট সীমানার বাইরে নিয়ে গিয়ে ফেলে। কিন্তু এতেই যুদ্ধের শেষ হয়নি। সোভিয়েটের বিরুদ্ধে জার্মান আক্রমণের শুরুতে ১৯৪১-এর ৩ জুলাই বেতার ভাষণে স্ট্যালিন ঘোষণা করেছিলেন, ‘‘ফ্যাসিস্ট উৎপীড়কদের বিরুদ্ধে সমগ্র জাতিকে জড়িত করে আমাদের এই যুদ্ধের লক্ষ্য কেবল আমাদেরদেশের সামনে দেখা দেওয়া গভীর বিপদ দূর করা নয়। জার্মান ফ্যাসিবাদী যাঁতাকলে পিষ্ট সকল ইউরোপীয় জনগণকে সহায়তা করাও আমাদের লক্ষ্য।” ফলে ফ্যাসিবাদী যাঁতাকলে পিষ্ট ইউরোপীয় জনগণকে মুক্ত করতে করতে বার্লিনের উদ্দেশ্যে এগিয়ে চলেসোভিয়েত লালফৌজ। এরপর একের পর এক মুক্ত হয় পোল্যান্ড, রোমানিয়া, চেকোশ্লোভাকিয়া, বুলগেরিয়া, হাঙ্গেরি প্রভৃতি ইউরোপের দেশগুলি। প্রতিটি ক্ষেত্রেই নাৎসি বাহিনীর সঙ্গে ভয়াবহ সংঘর্ষে লালফৌজের লক্ষ লক্ষ সৈনিক প্রাণ হারায়।

সোভিয়েট বাহিনী যখন প্রাণপণে ফ্যাসিস্ট বাহিনীকে তাড়িয়ে নিয়ে চলেছে ইউরোপের পথে পথে, তখন মিত্রপক্ষের বাকিদের অবস্থান কী ছিল? ১৯৪১-এর জুনে হিটলার বাহিনী সোভিয়েট আক্রমণ করার পরই স্ট্যালিন মিত্রশক্তি তথা ইংল্যান্ড-ফ্রান্স-আমেরিকার কাছে পশ্চিম ইউরোপে কিংবা ফ্রান্সে দ্বিতীয় রণাঙ্গন খোলার আবেদন জানান, যাতে ফ্যাসিস্ট বাহিনী তাদের পুরো শক্তি সোভিয়েতের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করতে না পারে। ১৯৪১ গেল, ১৯৪২-এও দ্বিতীয় রণাঙ্গন খোলা হল না। ১৯৪৩-এ লন্ডন এবং ওয়াশিংটন প্রতিশ্রুতি দিয়েও কোথাও কোনও দ্বিতীয় রণাঙ্গন খুলল না। স্ট্যালিনগ্রাডের যুদ্ধে লালফৌজের হাতে জার্মান বাহিনীর ভয়াবহ পরাজয়ের পরও ব্রিটিশ-মার্কিন বাহিনীর পক্ষ থেকে দ্বিতীয় রণাঙ্গন না খোলায় বিশ্ব জুড়ে সমালোচনার ঝড় ওঠে। অথচ ব্রিটিশ-মার্কিন পক্ষ থেকে আগেই এই দ্বিতীয় ফ্রন্ট খুললে যুদ্ধ এত দীর্ঘস্থায়ী হত না। এর ফলে শুধু বিপুল সংখ্যায় সোভিয়েটসেনারই মৃত্যু এবং ক্ষয়ক্ষতি ঘটেনি, ব্রিটিশ ও মার্কিন সহ মিত্রপক্ষের অজস্র মানুষের প্রাণবলি এবং ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। মিত্রশক্তি কখন দ্বিতীয় ফ্রন্ট খুলল? লালফৌজ তখন পোল্যান্ডের মধ্য দিয়ে নাৎসিদের তাড়িয়ে নিয়ে চলেছে। ব্রিটিশ-মার্কিন শক্তি এ কথা বুঝে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠল যে, লালফৌজ একাই সমগ্র ইউরোপকে মুক্ত করে ফেলবে। আর সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েট ইউনিয়নের নেতৃত্বে গোটা ইউরোপ মুক্ত হলে তা শুধু নাৎসি বাহিনীকেই বিতাড়িত করবে না, তাদের সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থের গোড়াতেই আঘাত হানবে। জনগণের মধ্যে ইতিমধ্যে সোভিয়েট সমাজতন্ত্র সম্পর্কে যে প্রবল আকর্ষণ তৈরি হয়েছে, তা উত্তাল তরঙ্গে পরিণত হয়ে ইউরোপকে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। এমন পরিস্থিতিতে পড়েই, এতদিন সোভিয়েট সরকারের বহু আবেদনেও যেটা তারা করেনি, ১৯৪৪-এর ৬ জুন তা-ই ঘটে। ব্রিটিশ-মার্কিন সেনা ফ্রান্সের নরম্যান্ডিতে নামে এবং বিপুল ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করে ফ্যাসিস্টদের পর্যুদস্ত করে।

এরপর মিত্র বাহিনী জার্মানি সীমান্তের দিকে প্রায় বিনা বাধায় এগিয়ে যায়। ১৯৪৪-এর ১৬ ডিসেম্বর নাৎসি বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ে ব্রিটিশ-মার্কিন বাহিনীর উপর। পশ্চিম রণাঙ্গণে আর্দেন্স ও উত্তর আলসাসে ভয়ানক ক্ষয়ক্ষতির মুখে পড়ে বিপর্যস্ত হতে থাকে মিত্র বাহিনী। বিপদ থেকে বাঁচতে ভীত ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিল স্ট্যালিনকে একটি জরুরি চিঠিতে ভিসচুলা রণাঙ্গণ বা আর কোথাও জার্মান বিরোধী অভিযান চালানোর জন্য অনুরোধ করেন। তাতে সাড়া দিয়ে স্ট্যালিন ১২ জানুয়ারি বাল্টিক সাগর থেকে কারপেথিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকায় জার্মান বাহিনীর বিরুদ্ধে লালফৌজের অভিযান শুরু করেন। জার্মান বাহিনী ব্রিটিশ-মার্কিন বাহিনীকে রেহাই দিয়ে পূর্ব রণাঙ্গণে চলে যায় যুদ্ধ করতে। ব্রিটিশ নথিপত্রেই উল্লেখ রয়েছে, আর্দেন্সে নাৎসি বাহিনীর হাতে মার খাওয়া ও লালফৌজের সাহায্যে বিপদমুক্ত হওয়ার পর ব্রিটিশ-মার্কিন বাহিনীকে আর যুদ্ধ করতে হয়নি।

লালফৌজ সোভিয়েটকে মুক্ত করে ইউরোপকে মুক্ত করল

ততক্ষণে সোভিয়েট লালফৌজ অপ্রতিহত গতিতে এগোতে থাকে এবং শেষ পর্যন্ত ২৭ এপ্রিলের মধ্যেই পৌঁছে যায় বার্লিনে। মার্শাল ঝুকভ ও মার্শাল কোনিয়েভ দেড় শতাধিক সেনাপতি সহ বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে বার্লিনে প্রবেশ করেন। ব্রিটিশ-মার্কিন-ফরাসি বাহিনী তখনও অনেক দূরে। লালফৌজের সৈন্যরা তীব্র নাৎসি প্রতিরোধ ভেঙে শেষ পর্যন্ত ২ মে বিকেল তিনটেয় জার্মান পার্লামেন্ট রাইখস্ট্যাগের চূড়ায় উড়িয়ে দেয় লাল পতাকা। এ সবই ইতিহাস। যাঁরা ইতিহাসের এতটুকু খবর রাখেন, এ সব তাঁদের কারও অজানা থাকার কথা নয়। তবুও ইতিহাসকে বিকৃত করে একদল প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন। আসলে পুঁজিবাদের ব্যর্থতা আজ আর কোনও মতেই ঢেকে রাখা যাচ্ছে না। শোষিত-নিপীড়িত মানুষ ব্যাকুল হয়ে মুক্তির পথ খুঁজছে। এই অবস্থায় তারা যাতে সমাজতন্ত্রকেই মুক্তির পথ হিসাবে বেছে না নেয়, তা নিশ্চিত করতে ইতিহাস বিকৃতির এই অপচেষ্টা চলছে।