সোনা খেয়ে মানুষ বাঁচে বলে এখনও শোনা যায়নি। কিন্তু বাংলাকে সোনা দিয়ে মুড়ে দেওয়ার দাবি শুনে কেউ আপত্তি করেছে বলেও জানা নেই। মাঠে-ঘাটে সোনা পাওয়া গেলে অবশ্য তার দাম কতটা থাকবে, আর তা কী কাজে লাগবে? এসব নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ হতে পারে।
কিন্তু একটা বিষয়ে দ্বিমত নেই, ভোট কাছে এলেই নামী-দামি সব নেতাদের মুখে এই একটি স্লোগান বাংলার মানুষ শুনতে পাবেই– সোনার বাংলা গড়তে চান, অমুক দাদা বা দিদিকে ভোট দিন। একসময় কংগ্রেস বলেছে, তারপর বলেছে সিপিএম, তৃণমূলও কিছু কম সোনার দাবিদার ছিল না। তার সর্বাধুনিক সংযোজন করেছেন বিজেপির দুই নম্বর নেতা বলে খ্যাত কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। তিনি ১ মার্চ কলকাতার শহিদ মিনার ময়দানে দাঁড়িয়ে বলে গেছেন ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপিকে জেতাতে পারলেই সোনার বাংলা তাঁরা গড়ে দেবেন।
একটা প্রশ্ন অবশ্য উঠবে এর জন্য কাঁচামাল তাঁরা জোগাড় করবেন কোথা থেকে? বিজেপির পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সভাপতি গোরুর দুধ থেকে সোনা নিষ্কাশনের নিদান দিলেও সে প্রযুক্তি সম্ভবত কেবল তাঁর দখলেই থেকে গেছে। অমিত শাহ পর্যন্ত তার নাগাল পাননি, না হলে নিশ্চয়ই এই উৎসটা অমিতজি রাজ্যের মানুষকে জানিয়ে যেতেন! তাহলে বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলি থেকেই কি আমদানি করা হবে সোনা? সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর পরম মিত্র মার্কিন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভারত সফরে আমেদাবাদের রাস্তায় ঝুপড়ি-বস্তি আড়াল করতে পাঁচিল তুলতে হয়েছে। সোনায় মোড়া গুজরাট দেখে বিদেশিদের লোভ হতে পারে এই অশঙ্কাতেই কি? যদিও নিন্দুকেরা বলছে পূতিগন্ধময় বস্তির কঙ্কাল ঢাকতেই নাকি পাঁচিল! কিন্তু অমিতজি মোদিজিদের সে কথায় কান দিলে কি চলে! যদিও বছর দুয়েক আগেও বিজেপির হাতে ছিল ২০টির বেশি রাজ্য। সেগুলি সোনায় মোড়ার ধাক্কায় সেই সংখ্যা কমে ১০-এর নিচে দাঁড়িয়েছে।
সোনায় মোড়া বিজেপি শাসনের দু’একটি হিসাব নেওয়া যাক। কিছুদিন আগে বিজেপি শাসিত উত্তরপ্রদেশে ৩৬২ টি পিওনের পোস্টের জন্য আবেদন পড়েছিল ২৩ লক্ষ, তার মধ্যে ২৫৫ জন পিএইচ ডি ছাড়াও এম এ, এম এস সি এবং গ্র্যাজুয়েট ছিলেন। কারণটা জানা যাবে উত্তরপ্রদেশের শ্রমমন্ত্রী স্বামী প্রসাদ মৌর্যের কথায়। ৭ ফেব্রুয়ারি তিনি জানিয়েছেন, উত্তরপ্রদেশের নথিভুক্ত শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা ৩৪ লক্ষ। যদিও বাস্তবে মোট বেকার বা অর্ধবেকার অর্থাৎ যাদের কোনও সুনির্দিষ্ট কাজ নেই, এমন মানুষের সংখ্যাটা যে কয়েক কোটি ছাড়াবে তাতে সন্দেহ নেই। বিজেপি কথিত হিন্দু কুলতিলক যোগী আদিত্যনাথের মুখ্যমন্ত্রীত্বে উত্তরপ্রদেশের বেকারত্বের হার বেড়েছে এক বছরে ৫৮ শতাংশ (বিজনেস টু-ডে, ২.০৩.২০২০)। সোনা কম পড়ার সম্ভাবনা নেই বোধহয়!
আরও কিছু সোনায় মোড়া বিজেপি রাজত্বের খবর নেওয়া যাক– ভারতবর্ষে যে ১০টি রাজ্য এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল বেকারত্বের গড়ে সবচেয়ে এগিয়ে তার সবগুলিতে হয় বিজেপির সরকার চলছে, না হয় দু’দিন আগেও তাদের রাজ্য সরকার ছিল। শীর্ষে আছে ত্রিপুরা, তার বেকারত্বের হার ২৮.৬ শতাংশ, হরিয়ানাতে ২৭.৬ শতাংশ, হিমাচলপ্রদেশে ২০.২ শতাংশ। ঝাড়খণ্ডে এবং রাজস্থানে অল্পদিন আগেও ছিল বিজেপি সরকার, সেই দুই রাজ্যে বেকারত্বের হার যথাক্রমে ১৭.৭ এবং ১৫.৯ শতাংশ। বিহারে প্রায় ১২ শতাংশ, খোদ দিল্লিতে এই হার ১২ শতাংশের বেশি।
আর সারা দেশে? সাত সাতটা বছর তাঁরা যে কেন্দ্রীয়ভাবে সোনার চাষ করেছেন তা কেমন চকচক কর়ছে? ইন্ডিয়ান লেবার বুরোর় রিপোর্ট দেখাচ্ছে ভারতে লেবার পার্টিসিপেশন রেট ৪৯.৮ শতাংশ। অর্থাৎ ১৫ থেকে ৬০ বছর বয়সের মানুষ, যাঁরা সবচেয়ে কর্মক্ষম, তাঁদের অর্ধেকের বেশিরই কোনও কাজ নেই (ইকনমিক টাইমস, ০৪.০২.২০২০)। যত লোক কাজ করেন তার এক-তৃতীয়াংশই অস্থায়ী শ্রমিক। শ্রমিক-কর্মচারীদের ৮৩ শতাংশের সুনির্দিষ্ট বেতন বলে কিছু নেই। দেশের প্রতি তিনটি পরিবারের মধ্যে দুটিরই আয় মাসে ১০ হাজার টাকার নিচে (ব্লুমবার্গ ডটকম)। এই বাজারে তাতে পরিবার প্রতিপালন চলে? এমন সোনাতেই কি বিজেপি মুড়বে বাংলাকে?
সোনার রাজত্বে উত্তরপ্রদেশেই আখচাষিদের পাওনা প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা। বড় বড় মদের কোম্পানি এবং চিনিকল মালিকরা তা মেরে দিয়েছে। যোগী আদিত্যনাথের সরকারের যোগনিদ্রা ভঙেনি। সারা দেশে ১৮ হাজার ৯৫৮ কোটি টাকা চাষিদের দেয়নি এই কোম্পানিগুলি (বিজনেস লাইন ২১.০৬.২০১৯)। মহারাষ্টে্র বিজেপি-শিবসেনা সরকার সদ্য গত হয়েছে। তাদের ‘সোনার রাজ্য’ গড়ার কারবারে সেখানে ৫ বছরে ঋণের জালে জড়িয়ে আত্মঘাতী হয়েছেন ১৪ হাজার ৫০০ চাষি। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস বুরোর তথ্যে দেখা যাচ্ছে শুধু ২০১৬ সালে সারা দেশে ১১ হাজার ৩৭৯ জন চাষি আত্মহত্যা করেছেন। অর্থাৎ দিনে ৩১ জন চাষিকে ঋণের দায়ে আত্মঘাতী হওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে (দ্য ওয়্যার, ৮ নভেম্বর ২০১৯)। সোনার ভারতই বটে!
সোনার রাজত্বে ‘বেটি পড়াও, বেটি বাঁচাও’-এর চিত্র কেমন? ২০১৮ সালে অ্যাসোসিয়েশন অফ ডেমোক্রেটিক রাইটস দেখিয়েছে কমপক্ষে ১২ জন বিজেপি এমএলএ, এমপি ধর্ষণে অভিযুক্ত। ২০১৬ সালকে নারীদের জন্য সবচেয়ে ভয়াবহ বছর বলে চিহ্নিত করেছে ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস বুরো। সরকারি হিসাবেই দিনে ১০৬ জন নারী ধর্ষিতা হয়েছেন সেই বছর। যদিও বাস্তব সংখ্যাটা আরও বহুগুণ বেশি তা মানুষ জানে। বিজেপির উত্তরপ্রদেশের এক মন্ত্রী বলেছেন, ‘স্বয়ং রামচন্দ্রেরও ধর্ষণ আটকানোর ক্ষমতা নেই’ (কোয়ার্জ ইন্ডিয়া ২৫.০৯.২০১৯)। সোনার রাজ্যই বটে! উত্তরপ্রদেশের উন্নাওতে বিজেপি এমএলএ কুলদীপ সেঙ্গার ধর্ষণ এবং খুনের দায়ে শাস্তি পেলেও পুলিশ এখনও তাকে বাঁচাতে চেষ্টা করছে। আর এক নেতা চিন্ময়ানন্দ যে ছাত্রীকে ধর্ষণ করেছে, সেই নির্যাতিতা মেয়েটিকেই পুলিশ জেলে ভরেছে। দিল্লির প্রাক্তন বিজেপি এমএলএ বিজয় জোলি ধর্ষণে অভিযুক্ত। জম্মুতে আটবছরের শিশুর ধর্ষক এবং খুনিদের সমর্থনে বিজেপি মিছিল করেছে। কেন্দ্রীয় সরকার নরেন্দ্র মোদির ছবি দিয়ে বেটি বাঁচাওয়ের যে বিজ্ঞাপন দিচ্ছে তাতে বলা হয়েছে, কন্যাকে না বাঁচালে আপনাকে নরম রুটি করে দেবে কে? ‘ডিজিটাল ইন্ডিয়া’, মঙ্গলে মহাকাশ যান পাঠানো ভারতে মেয়েদের এর থেকে বেশি দায়িত্বে ভাবতে পারেনি মোদি সরকার? চিন্তায় ভাবনায় আদ্যোপান্ত কর্তৃত্ববাদী পুরুষতন্ত্রের এই ছাপই হল আরএসএসের দর্শন। দিল্লিতে নির্ভয়ার ঘটনার পর আরএসএস নেতারা বলেছিলেন, মেয়েরা ঘরে থাকলেই আর ধর্ষণ হবে না। ধর্ষণে অভিযুক্ত বিজেপির স্নেহধন্য স্বঘোষিত অবতার আশারাম বাপু পরামর্শ দিয়েছিলেন, মেয়েটির উচিত ছিল ধর্ষণকারীদের ভাই বলে ডাকা। এমন সোনার রাজত্বই কি বিজেপি বাংলায় আনতে চাইছে!
বাংলায় ক্ষমতায় না থেকেও ইতিমধ্যেই বেশ কয়েকজন বিজেপি নেতা-কর্মী গ্যাস সিলিন্ডার নিয়ে দুর্নীতি, শিশু নারী পাচার, ধর্ষণ সহ নানা অপকর্মে জড়িত হয়ে নাম কিনেছেন। আর উদাহরণ বাড়িয়ে দরকার নেই। অমিত শাহ সাহেবদের ‘সোনার বাংলা’র জন্য এই ক’টি উদাহরণই মানুষের হৃৎকম্পের জন্য যথেষ্ট। এমনিতেই কংগ্রেস এবং সিপিএমের ছেড়ে যাওয়া জুতোয় পা গলিয়ে তৃণমূল গণতন্ত্র হরণ, তোলাবাজি, নারী নির্যাতন, মদের অবাধ প্রসার, পাড়ায় পাড়ায় যথেচ্ছ বেলেল্লাপনার যে নজির গড়েছে, বিজেপির নজির এর থেকে কোনও অংশে কম নয়। তৃণমূলের আমলে পশ্চিমবঙ্গে চাষির আত্মহত্যা কমেনি কমার কথাও ছিল না। বেকারত্ব কমেনি, তা হওয়ারও ছিল না। তৃণমূলের অপশাসন দেখে ক্ষুব্ধ হয়ে যেমন অতীতের কংগ্রেস, পরবর্তী সিপিএম জমানার দুঃস্বপ্নের কথা ভুলে গেলে বিপদ, একইভাবে বিজেপির মতো একচেটিয়া পুঁজির সেবাদাস মারাত্মক সাম্প্রদায়িক একটি শক্তিকে ডেকে আনা হবে মারাত্মক ভুল। নিছক ভোটের স্লোগানে না ভুলে দরকার কেন্দ্র বা রাজ্য সরকারের জনবিরোধী নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলা। যে কাজটি একমাত্র এস ইউ সি আই (সি) করে চলেছে। এর মধ্য দিয়েই সমস্যামুক্তির পথ পাওয়া সম্ভব। ভোটের বাজার গরম করতে অমিত শাহদের সোনার বাংলার স্লোগান শুনে মানুষ তাই সেই বহুল প্রচলিত কথাটিই স্মরণ করেছে– ‘ভিক্ষা চাই না মা, কুকুর সামলা’।