যে বিষে আক্রান্ত সুষমা স্বরাজ, তার স্রষ্টা যে তাঁর নিজের দল, তা কি অস্বীকার করতে পারবেন তিনি!
বিদেশ মন্ত্রক আইন মেনে একজনকে পাসপোর্ট দেওয়ার কারণে স্বদেশপ্রেম এবং হিন্দুত্বের স্বঘোষিত অভিভাবক বিজেপির ছোট–বড় নানা স্তরের নেতাদের টুইটার–ফেসবুক বাহিত গালাগালির যে বিষ–বাণ তাঁর দিকে ধাবিত হয়েছে তাতে নাকি তিনি ব্যথিত কিন্তু মন্ত্রীত্বের মধুভাণ্ডের মায়ায় প্রতিবাদ করা যে তাঁর পক্ষে অসম্ভব!
উত্তরপ্রদেশের তনভি শেঠ পাসপোর্ট চেয়েছিলেন৷ কিন্তু তাঁর স্বামী যেহেতু মুসলমান তাই নাম এবং ধর্ম পরিবর্তন না করলে পাসপোর্ট দিতে অস্বীকার করেন পাসপোর্ট অফিসার৷ ওই অফিসার তনভির স্বামী আনাসকেও ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করে হিন্দু ধর্ম গ্রহণের পরামর্শ দিয়েছিলেন৷ উত্তরপ্রদেশের যোগী আদিত্যনাথের পুলিশও রিপোর্ট দেয়, ফরমে লেখা স্থায়ী ঠিকানায় তিনি নিয়মিত থাকেন না অতএব তিনি পাসপোর্ট পাওয়ার অনুপযুক্ত৷ এই অবস্থায় ওই দম্পতি বিদেশ মন্ত্রকের দ্বারস্থ হন৷ মন্ত্রক নিয়ম খতিয়ে দেখে জানায় পাসপোর্ট অফিসার এবং উত্তরপ্রদেশের পুলিশ উভয়েই এক্তিয়ারের বাইরে গিয়ে অন্যায়ভাবে পাসপোর্ট আটকানোর চেষ্টা করেছে৷ তারা পাসপোর্ট মঞ্জুর করে এবং আবেদনকারীদের হেনস্তা করার জন্য অফিসারকে বদলি করে৷
এর পরেই বিদেশমন্ত্রী তথা বিজেপি নেত্রী সুষমা স্বরাজের নামে অকথ্য ভাষায় গালাগালিতে ইন্টারনেট বাহিত সোস্যাল মিডিয়া টুইটার, ফেসবুক ইত্যাদি ভরে ওঠে৷ ইন্টারনেটের পরিভাষায় এইরকম আক্রমণকে বলা হয় ‘ট্রোলিং’৷ দেখা যায় যারা ট্রোল করছে তাদের বেশিরভাগই বিজেপির নানা স্তরের নেতা এবং কর্মী–সমর্থক৷ সুষমা স্বরাজের স্বামীর উদ্দেশে এক বিজেপি কর্মীর পরামর্শ, আপনার স্ত্রী বাড়ি ফিরলে পিটিয়ে তার এই মুসলমান তোষণের ভুত ছাড়িয়ে দেবেন৷ যে সমস্ত অ্যাকাউন্টগুলি থেকে এই সব পোস্ট করা হয়েছে তার কোনওটির নাম ‘জয় শ্রী রাম’, কোনওটি ‘ভিকট্রি ফর নমো’, ‘স্যাফ্রন (গেরুয়া) রকস’ ইত্যাদি৷ আরও উল্লেখযোগ্য হল এই অ্যাকাউন্টগুলিকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সহ ৪১ জন কেন্দ্রীয় বিজেপি মন্ত্রী এবং সাংসদ ‘ফলো’ করেন৷ বিদেশমন্ত্রীর উদ্দেশে এই আক্রমণ বেশ কয়েকদিন চললেও বিজেপি নেতৃবৃন্দ নীরবই থেকেছেন৷ যে প্রধানমন্ত্রী টুইটারে তাঁর যাবতীয় মতামত জানিয়ে থাকেন, তিনিও এ নিয়ে টুঁ শব্দ করেননি৷ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং এবং মন্ত্রী নিতিন গড়কড়ি অনেক দেরিতে মৃদু মতপার্থক্য জানিয়ে ক্ষান্ত হয়েছেন৷ তাও সাংবাদিকরা খুঁচিয়েছিলেন বলেই এটুকু তাঁরা করেছেন৷ এর মানে বুঝতে অসুবিধা হয় কি? বিজেপি নেতৃত্ব ট্রোলিং না চাইলে তা হতে পারত?
দেশের আইন অনুযায়ী যা চলে না, তেমন একটি কাজের বিরুদ্ধতা করার জন্য খোদ বিদেশমন্ত্রীর যদি এই হাল হয়, তাহলে বিজেপির জনবিরোধী নীতির সামান্য বিরোধিতা করলে দেশের সাধারণ মানুষের অবস্থা কী দাঁড়াতে পারে এই ঘটনায় তা স্পষ্ট৷ বিজেপির হিসাব রক্ষক হিসাবে পরিচয় দেওয়া একজন তো এক বিরোধী নেত্রীর দশ বছরের কন্যাকে ধর্ষণ করতে চেয়েও টুইটারে পোস্ট করেছেন৷ বিজেপি বিরাট একদল সংগঠিত কর্মী বাহিনীকে অর্থের বিনিময়ে নিয়োগ করেছে, যাদের কাজই হল অন্ধ মুসলিম বিদ্বেষ ছড়ানো এবং দেশপ্রেমের নামে যে কোনও বিজেপি বিরোধীকে প্রবল গালিগালাজ করে ট্রোল করা, তাকে পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেওয়ার হুমকি দেওয়া, মিথ্যা খবর ছড়ানো, রোমহর্ষক এবং ধর্মীয় বিদ্বেষমূলক মিথ্যা কাহিনী এমনভাবে প্রচার করা যাতে সাধারণ মানুষ বারবার শুনতে শুনতে মিথ্যাটাকেই সত্য বলে বিশ্বাস করে ফেলেন৷ এ ব্যপারে তারা হিটলারের প্রচার সচিব গোয়েবলসের থেকে শিক্ষা নিয়েছে৷ এর নাম হয়েছে ‘পোস্ট ট্রুথ’৷ এর প্রভাব সমাজ জীবনে কতটা মারাত্মক ক্ষত সৃষ্টি করছে তা বোঝা যায় একটি তথ্যে৷ সুষমা স্বরাজ তাঁকে এমনভাবে গালিগালাজ করা যুক্তিযুক্ত হচ্ছে কি না সে বিষয়ে সোস্যাল মিডিয়ায় জনমত চেয়েছিলেন৷ যাঁরা মত দিয়েছেন তাঁদের অধিকাংশ (৫৭ শতাংশ) সুষমার পক্ষে রায় দিলেও গালিগালাজ সমর্থনকারীদের সংখ্যাটাও কম নয়, প্রায় ৫১ হাজার ৬০০৷ উদ্বেগজনক হল, এই ট্রোলিং বাহিনীর একটা বড় অংশ যুবক৷ যাদের কাছে যুক্তি–সত্য কোনও কিছুরই মূল্য থাকছে না৷ কোনও মহিলার বিরুদ্ধে কদর্য ভাষা প্রয়োগ করতেও তাদের কোথাও বাধছে না৷ দেশপ্রেম বলতে তারা বোঝে মুসলিম বিদ্বেষ আর পাকিস্তানকে গালমন্দ করা৷
এরা কি কোনও আদর্শের টানে বিজেপির ট্রোলিং বাহিনীতে নাম লিখিয়েছে? একবারেই না, বেশিরভাগই নাম লিখিয়েছেন চাকরি না পেয়ে রোজগারের আশায়৷ ম্যানেজমেন্ট ডিগ্রি নিয়েও কোনও উপযুক্ত কাজ না পাওয়ার তীব্র রাগ আর ঘৃণা কোথায় প্রকাশ করবেন তা বুঝে না পেয়েও অনেকে এই ট্রোলিং–এর রোজগারে এসেছেন৷ জমে থাকা রাগ আর ক্ষোভকে পুঁজিবাদের সেবকদের বদলে মুসলমানদের বিরুদ্ধে উগরে দিয়ে তারা নিজেদের অসহায়তাকে ভুলে থাকতে চান৷ বিজেপি নেতারা মুসলমান আর পাকিস্তানকেই সমস্ত সমস্যার উৎস হিসাবে এদের বুঝিয়ে দিব্যি নিজেরা কর্পোরেট পুঁজির সেবা করে বিলাসবহুল জীবন কাটিয়ে চলেছেন৷ জার্মানিতে হিটলার এমন করেই বেকার, সমাজে নানা দিক থেকে বঞ্চিত যুবকদের ক্ষোভকে সুকৌশলে ইহুদিদের বিরুদ্ধে চালনা করে সভ্যতাবিরোধী ফ্যাসিস্ট বাহিনীতে জড়ো করতে পেরেছিল৷ তার বিষময় ফলভোগ শুধু জার্মানি করেনি, সারা পৃথিবী তাতে ছারখার হয়েছে৷ বিজেপি সেই খেলাতেই নেমেছে৷
বিজেপি এমনিতেই আদর্শগতভাবে দেউলিয়া৷ আরএসএসের রাজনৈতিক শাখা হিসাবে তার ঝুলিতে স্বাধীনতা আন্দোলনের কোনও ঐতিহ্য পর্যন্ত নেই যে তা ভাঙিয়ে কিছু বড় বড় কথা বলবে তার উপর সরকারে বসে দেশের মানুষের জন্য অন্ন–বস্ত্র–বাসস্থান্ নূ্যনতম ব্যবস্থা করা, কাজের সুযোগ তৈরি, আর্থিক ক্ষেত্রে একটু সুরাহা দেওয়া, নারীর নিরাপত্তা, মূল্যবৃদ্ধি রোধ করা ইত্যাদি জনস্বার্থের জন্য প্রয়োজনীয় কোনও কাজই তারা করেনি৷ একচেটিয়া মালিকদের সেবাদাস হিসাবে জনগণের উপরে অত্যাচারের স্টিম রোলার চালানো ছাড়া অন্য আর কিছু করণীয়ও তাদের নেই৷ অথচ এক বছরও বাকি নেই লোকসভা ভোটের৷ তারা কী নিয়ে সে নির্বাচনে লড়বে? তাই হিন্দুত্ববাদের জোয়ার তোলার মরিয়া চেষ্টা করছে বিজেপি৷ এজন্য নিজের দলের নেত্রীকেও ছিঁড়ে খেতে, সাংবাদিকদের গুলি করে হত্যা করতেও তারা পিছপা নয়৷ বিরোধিতা করলেই মরতে হবে এই হুমকি দিয়ে একটা আতঙ্কের পরিমণ্ডল বানাতে চাইছে৷
বিজেপি বিরোধী কংগ্রেস ও অন্য বুর্জোয়া দলগুলিও হিন্দুভোটব্যাঙ্ক খোয়ানোর ভয়ে এই সর্বনাশা রাজনীতির বিরুদ্ধে যথাযথ প্রতিবাদ করতে পারছে না৷ বৃহৎ বামপন্থী বলে পরিচিত দলগুলি সংকীর্ণ ভোটের স্বার্থে কখনও কংগ্রেস, কখনও নানা স্বার্থান্বেষী বুর্জোয়া দলের হাত ধরতে গিয়ে বিজেপির জমি তৈরিতে সাহায্যই করছেন৷ যার সুযোগ নিচ্ছে বিজেপি৷
এই সুযোগে হিন্দুত্ববাদের জিগির তুলে ভোট বৈতরণী পার হতে যারা নিজের দলের নেত্রীকেও এমন কুৎসিত আক্রমণ করতে পারে অনায়াসে, সে দল কতটা সর্বনাশা চরিত্রের তা বুঝতে অসুবিধা হয় কি?
(৭০ বর্ষ ৪৭ সংখ্যা ১৩ জুলাই, ২০১৮)