সীমাহীন ঔদ্ধত্য ধাক্কা খেতেই মোদিজির এই ভেকবদল

এ যেন ভূতের মুখে রামনাম! প্রধানমন্ত্রীর মুখে ‘আমি সর্বধর্ম সমভাবের নীতির প্রতি দায়বদ্ধ’ কথা শুনে দেশের মানুষের মনে এই কথাটাই প্রথম এসেছে। বিদ্বেষই যাঁর রাজনীতির মূল কেন্দ্রবিন্দু, তাঁর মুখে এমন কথা! বাস্তবে এ বারের নির্বাচন যত এগিয়েছে, যত তিনি বুঝেছেন তাঁর ৩৭০ আসনের লক্ষ্য অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে ততই তিনি বিদ্বেষের রাজনীতিতে ফিরে গেছেন। মুসলিমদের বিরুদ্ধে তাঁর পরবর্তী বত্তৃতাগুলি এতই তীব্র বিদ্বেষে ভরা ছিল যে কোনও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষেত্রে এমন বক্তব্য দেশের মানুষের ভাবনার অতীত।

প্রধানমন্ত্রী আরও বলেছেন, আমার জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত ভারতের সংবিধানের মহান মূল্যে সমর্পিত। অথচ গত দশ বছর ধরে তাঁর মুখনিঃসৃত বাণীই প্রায় সংবিধানের জায়গা নিয়েছে। এ বার দেশবাসী প্রবল আশঙ্কায় ছিল, যদি বিজেপি-জোট সত্যিই ৪০০ আসনে জয়ী হয় তবে এই সংখ্যাগরিষ্ঠাতার জোরেই সংবিধানকে ইচ্ছেমতো বদলে দেবে এবং কায়েম করবে অধিকতর স্বৈরাচারী শাসন।

তা হলে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে নির্বাচিত হওয়ার পর নরেন্দ্র মোদি হঠাৎ সংবিধানে মাথা ঠেকাতে গেলেন কেন, আর সর্বধর্ম, সর্বমতের কথাই বা বলছেন কেন? তবে কি তিনি বিদ্বেষের রাজনীতি পরিত্যাগ করলেন? নির্বাচনের ফল তাঁর মানসিকতায় বিরাট কোনও পরিবর্তন ঘটিয়ে ফেলতে সক্ষম হল, যা আইনের শাসনের প্রতিও তাঁর শ্রদ্ধা বাড়িয়ে দিল?

বাস্তবে হিন্দুত্ববাদের আগ্রাসী রাজনীতি সত্ত্বেও একক সংখ্যগরিষ্ঠতা অর্জনে চরম ব্যর্থতা এবং পুনরায় প্রধানমন্ত্রীর গদির দখল নেওয়ার লোভেই মোদির এমন ভেকবদল, এমন বিড়াল তপস্বী সাজা!

অষ্টাদশ লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল নানা দিক থেকেই বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। এই নির্বাচনে মোদি শাসনের অবসান না ঘটলেও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঔদ্ধত্য এই নির্বাচনে বিরাট ধাক্কা খেয়েছে। বাস্তবে গত দুটি নির্বাচনে বিজেপির নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠতা এক দিকে দলের মধ্যে এবং অন্য দিকে সরকারে মোদিকে একাধিপত্য কায়েমের সুযোগ করে দিয়েছিল। অন্য দিকে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও সমস্ত সুযোগ সুবিধা তাঁর ঘনিষ্ঠ কয়েক জন ধনকুবেরের হাতে কুক্ষিগত হয়ে উঠেছিল। এই কয়েক জনই দেশের সমস্ত সম্পদ ব্যবহারের সুযোগ পেয়েছিল এবং অর্থনীতিকেও নিয়ন্ত্রণ করছিল। তাদের দিকে লক্ষ্য রেখেই মোদি সরকার তৈরি করেছিল একের পর এক আইন, যা জনস্বার্থকে পুঁজির স্বার্থের কাছে বিকিয়ে দিয়েছিল। তা সত্ত্বেও এই সময় ধরে এমনকি দরিদ্র মানুষেরও একাংশ ধনকুবের-তোষী এই সরকারকে সমর্থন করে গেছে। কারণ মোদির নেতৃত্বে বিজেপি হিন্দুত্বের ধুয়ো তুলে দেশ জুড়ে এমন একটা মেরুকরণ ঘটাতে সক্ষম হয়েছিল যা তাদের জীবনের গুরুতর সমস্যাগুলিকেও পিছনে ঠেলে দিতে সক্ষম হয়েছিল। এ বারের নির্বাচন বিজেপি রাজনীতির মেরুকরণের এই আগ্রাসী ধারাটিকে অনেকখানি আটকে দিতে পেরেছে।

রাষ্টে্র একচেটিয়া পুঁজির প্রবল আধিপত্যের এই যুগে বিশ্ব জুড়ে রাষ্ট্রীয়তাবাদী-জনপ্রিয়তাবাদী নেতাদের মতোই নরেন্দ্র মোদি ঘোষণা করেছিলেন, তিনি একাই জাতি। বিরোধীদের জাতীয়তা-বিরোধী তকমা দিয়ে বাতিল করে দিয়েছিলেন। জনমতের কোনও তোয়াক্কা করেননি। শ্রমিক-কৃষক-সাধারণ মানুষের দাবিগুলিতে কর্ণপাত করেননি। একদল ধামাধরা রাজনীতিক, ছদ্ম বুদ্ধিজীবী এবং এক দল পেটোয়া সাংবাদিক তাঁর এই দেশ-ঊর্ধ্ব, জাতি-ঊর্ধ্ব হামবড়ামির পিছনে ধুয়ো ধরেছিলেন। তারই পরিণামে সংখ্যালঘু, বিশেষত মুসলিমদের রাষ্ট্র তথা সমাজের এক কোণে ঠেলে দিয়ে তিনি ঘোষণা করেছিলেন– হিন্দুত্বই ভারতীয়ত্ব।

বিজেপির বিজয়রথের ঘোড়া একক সংখ্যাগরিষ্ঠতায় পৌঁছনোর আগেই রুখে দিয়েছে দেশের মানুষ। মোদিরা ভেবেছিলেন, গোয়েবলসীয় কায়দায় যা তাঁরা জোরের সঙ্গে এবং বারে বারে প্রচার করবেন, মানুষ তাকেই সত্য বলে মেনে নেবে। বাস্তবে তা হয়নি।

বিজেপির হিন্দুত্বের রাজনীতি যে মানুষের জীবনের গুরুতর সমস্যাগুলিকে ছাপিয়ে যেতে পারেনি তার বড় প্রমাণ উত্তরপ্রদেশেও বিজেপির ব্যাপক পরাজয়। উত্তরপ্রদেশ, যাকে গুজরাটের বাইরে বিজেপির সর্ববৃহৎ আদর্শগত হৃদয়ভূমি হিসাবে দলের নেতারাই দেশ জুড়ে পরিচিত করেছেন, সেখানে পরাজয় কার্যত বিজেপির হিন্দুত্ববাদ ভিত্তিক রাজনীতিরই পরাজয়। যে অযোধ্যা গত তিন দশক ধরে বিজেপির হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির কেন্দ্রভূমি, যে অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ ধ্বংস করেই বিজেপির ভারতীয় রাজনীতিতে উত্থান, যে অযোধ্যায় রামমন্দির প্রতিষ্ঠাকে বিজেপি তাঁদের প্রধানতম সাফল্য হিসাবে দেশের মানুষের কাছে উপস্থিত করেছে, যে অযোধ্যার় অসমাপ্ত রামমন্দির উদ্বোধন করেই নরেন্দ্র মোদি গোটা দেশ জুড়ে মানুষকে হিন্দুত্বের ঢেউয়ে ভাসিয়ে দেবেন ভেবেছিলেন, সেই অযোধ্যা যে লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্ভুক্ত, সেই ফৈজাবাদে পরাস্ত হয়েছেন বিজেপির প্রতিনিধি।

গত দুবার যে কেন্দ্র থেকে বিজয়ী হয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী, সেই বারাণসী, যে প্রাচীন শহরটিকে বিশ্বে হিন্দু-পর্যটনকেন্দ্রে পরিণত করা ছিল নরেন্দ্র মোদির অন্যতম প্রিয় বাসনা, যার জন্য সেখানকার শত শত প্রাচীন মন্দিরকে গুঁড়িয়ে দিয়ে, শত শত বাড়ি-ঘর ভেঙে কয়েক হাজার মানুষকে উচ্ছেদ করে দিয়ে বিরাট কাশী-বিশ্বনাথ করিডর তৈরি করেছেন, শহরটিকে ঝাঁ-চকচকে করে বিশ্বনাথ মন্দিরকে এক কর্পোরেট মন্দিরে পরিণত করেছেন, সেই বারাণসী কেন্দ্রে প্রধানমন্ত্রী এক অখ্যাত প্রতিদ্বন্দ্বীর কাছে মাত্র দেড় লক্ষ ভোটে জয়ী হয়েছেন। অথচ তিনি নিজেই জয়ের লক্ষ্যমাত্রা ৬ লক্ষে বেঁধে দিয়েছিলেন। বাস্তবে এই জয় কি প্রধানমন্ত্রীর পরাজয় নয়, নিজেকে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির আইডলে পরিণত করা নরেন্দ্র মোদিকে প্রত্যাখ্যান নয়?

বিজেপি নেতারা ধরেই নিয়েছিলেন, ২০১৯-এর মতো এ বারও উত্তরপ্রদেশ জুড়ে তাঁদের একচ্ছত্র আধিপত্য কায়েম থাকবে। বাস্তবে দেশে এ বার মোদি-ঢেউ বলে কিছু ছিল না। বরং তার জায়গা দখল করে নিয়েছিল মানুষের জীবনের গুরুতর সমস্যাগুলি এবং ধনকুবেরদের প্রতি পক্ষপাতিত্ব ও সাধারণ মানুষের প্রতি বঞ্চনার অভিযোগগুলি। ধনকুবেরদের তোষামোদে আর মন্দির-রাজনীতিতে বুঁদ হয়ে থাকা বিজেপি সাধারণ মানুষের জীবনের সমস্যাগুলি, মূল্যবৃদ্ধি, বেকারত্ব প্রভৃতিকে গুরুত্বই দেয়নি। সাধারণ মানুষ, বিশেষত দলিত এবং দরিদ্র অংশের আর্থিক উন্নয়নের দিকে নজরই দেয়নি। মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ ধরেই নিয়েছিলেন বুলডোজার রাজনীতি দিয়েই সব বিরোধিতাকে গুঁড়িয়ে দেবেন। দৃশ্যত তা সম্ভব হলেও সত্যিই যে তা এমনকি কোনও উদ্ধত শাসকের পক্ষেও সম্ভব নয়, নির্বাচনের ফল তা প্রমাণ করে দিয়েছে। উত্তরপ্রদেশে গত নির্বাচনে এনডিএ পেয়েছিল ৭৪টি আসন, সেখানে এ বার ইন্ডিয়া পেয়েছে ৪৩টি আসন, এনডিএ পেয়েছে ৩৬টি। অথচ প্রথম দফা ভোটের পর থেকেই মোদি মুসলমান বিরোধী প্রচারকে তুঙ্গে তুলেছিলেন এবং তা এমনই কটু, যা গত দু-দশকে দেশের মানুষ দেখেনি। ২০১৪ থেকে এই প্রথম বিজেপি মন্দির-মসজিদ রাজনীতিকে সামাজিক এবং অর্থনৈতিক বিক্ষোভকে চাপা দেওয়ার কাজে ব্যবহার করতে পারল না।

বিজেপির এই স্বৈরাচারী রাজনীতির ব্যর্থতার আরও একটা বড় কারণ কৃষক আন্দোলনের প্রভাব। গণআন্দোলন সাম্প্রদায়িক প্রভাব থেকে মানুষকে বের করে এনে জীবনের বাস্তব সমস্যার সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়। এই আন্দোলনকে আরও সংহত করা গেলে বিজেপির আরও বেশি পরাজয় নিশ্চিত করা যেত।

বিজেপির হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির ব্যর্থতা শুধু উত্তরপ্রদেশেই দেখা গেল এমন নয়। রাজস্থানের বারমের কেন্দ্রে পরাস্ত হয়েছে বিজেপি। যেখানে মোদি প্রচারের সময় ভারতীয় মুসলিমদের সম্পর্কে অতি জঘন্য শব্দ ব্যবহার করেছিলেন। মুসলমান বোঝাতে তাদের ‘ঘুসপেটিয়া’ (অনুপ্রবেশেকারী) এবং ‘যারা বহু সন্তানের জন্ম দেয়’, এই ভাবে পরিচয় দিয়েছেন। গুজরাটের বনসকন্থা আসনেও, যা একটি গো-পালন (ডেয়ারি) নির্ভর শহর, সেখানেও পরাজিত হয়েছে বিজেপি। এখানেই প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, বিরোধীরা জিতলে আপনাদের মধ্যে যাঁদের দুটি মহিষ আছে, তার একটি কেড়ে নিয়ে মুসলমানদের দিয়ে দেবে। এই সবই প্রমাণ করে, এই নির্বাচনে বিজেপির হিন্দুত্বের রাজনীতি মানুষকে তেমন ভাবে প্রভাবিত করতে পারেনি।

কিন্তু একটা কথা মনে রাখতে হবে, গোটা নির্বাচন পর্ব জুড়ে প্রধানমন্ত্রী যে বিষ সমাজমননে ছড়িয়ে দিলেন, বিজেপির এই পিছু হঠা সত্ত্বেও তা কিন্তু সমাজ পরিসরে থেকে গেল। যার বিরুদ্ধে সর্বদা সাংস্কৃতিক আন্দোলন জারি না রাখলে যে কোনও মুহূর্তে তা বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে।

এই অবস্থায় বিজেপি গত দশ বছরের শাসনে মানুষের যে গণতান্ত্রিক অধিকারগুলি কেড়ে নিয়েছে, দেশের জনগণকে আজ সেগুলিকে ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি তুলতে হবে, বিচারব্যবস্থা এবং সংবাদমাধ্যম সহ গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে কুক্ষিগত করার যে ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছিল তা থেকে এই বিভাগগুলিকে মুক্ত করার দাবি তুলতে হবে।

একই সঙ্গে জনজীবনের সমস্যাগুলি সমাধানের দাবিতে গণআন্দোলনগুলিকেও জোরদার করতে হবে। এই প্রতিটি আন্দোলনেই সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে আদর্শগত সংগ্রামকে জোরদার করতে হবে। পাশাপাশি, সংসদীয় বিরোধী দলগুলিও যাতে শুধু ক্ষমতা দখলের খেলায় মত্ত না থাকে, তাদের উপর জনগণের দেওয়া দায়িত্ব যাতে তারা ঠিক মতো পালন করে তার জন্য জনগণের সচেতন নজরদারি রাখতে হবে। এ কাজ সম্ভব একমাত্র জনগণকে সংগঠিত করে ব্যাপক গণআন্দোলন গড়ে তোলার দ্বারাই। আন্দোলনের চাপই পারে সরকারকে জনবিরোধী কাজের থেকে বিরত করতে। একইভাবে বিরোধী দলগুলিকে আন্দোলনই বাধ্য করে ক্ষমতার বাইরে জনস্বার্থ নিয়ে কিছুটা হলেও ভাবতে।