সি পি এমে এমন রাজনৈতিক আলোচনা পাইনি – কমরেড দেবেন্দ্রনাথ বর্মন

এস ইউ সি আই(কমিউনিস্ট) দলের কোচবিহার জেলা কমিটির প্রবীণ সদস্য, অল ইন্ডিয়া কৃষক ক্ষেতমজদুর  গঠনের(AIKKMS) সর্বভারতীয় সহ-সভাপতি ও কোচবিহার জেলা সম্পাদক কৃষক ও গণআন্দোলনের বরিষ্ঠ নেতা প্রাক্তন সাংসদ ও বিধায়ক কমরেড দেবেন্দ্রনাথ বর্মন আজ ১৮ জুলাই’২১ প্রয়াত হন। তিনি কোচবিহার জেলায় সি পি আই (এম) দলের বিশিষ্ট নেতা ছিলেন, ঐ দলের পক্ষ থেকে ১৯৮১ থেকে ৮৭ সাল পর্যন্ত রাজ্যসভার সদস্য ও ১৯৯১ থেকে ৯৬ সাল পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় বিধায়ক নির্বাচিত হয়েছিলেন। কমরেড বর্মন ১৯৯৭ সালে সি পি আই (এম) পরিত্যাগ করে এস ইউ সি আই (সি) দলে যোগ দিয়েছিলেন। ১৯৯৯ সালে এ আই কে কে এম এস-এর রাজনৈতিক শিক্ষাশিবিরে যোগ দিয়ে তিনি নিজের উপলব্ধির কথা জানিয়েছিলেন। নীচের প্রতিবেদনটি কমরেড দেবেন্দ্রনাথ বর্মনের যা গণদাবীর ৫১ বর্ষ ১২ সংখ্যা ২৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৯ প্রকাশিত হয়েছিল। — গণদাবী

 

“গত ১৫ই ফেব্রুয়ারী ’৯৯ থেকে ১৭ই ফেব্রুয়ারী ’৯৯ শহীদ কমরেড আমির আলী হালদার নগরে অনুষ্ঠিত সারা ভারত কৃষক ও ক্ষেতমজুর সংগঠনের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটি দ্বারা পরিচালিত রাজনৈতিক শিক্ষাশিবিরে অংশগ্রহণ করার সুযোগ আমার হয়েছিল। সেই শিক্ষাশিবিরে কমরেড শিবদাস ঘোষ রচিত ‘মার্কসবাদ ও মানবসমাজের বিকাশ প্রসঙ্গে’ ও ‘ভারতবর্ষের কৃষিসমস্যা ও চাষী আন্দোলন প্রসঙ্গে’ বই দুখানা নিয়ে রাজ্য সম্পাদক কমরেড প্রভাস ঘোষ যেভাবে আলোচনা রাখলেন, আমার সুদীর্ঘ ৩৫ বছরের রাজনৈতিক জীবনে এই ধরনের আলোচনা শোনার সুযোগ হয় নাই।

যাঁরা এই শিক্ষা শিবিরে অংশগ্রহণ করেছিলেন – তার বড় একটা অংশই ছিল গরীব কৃষক ও ক্ষেতমজুর, অল্প লেখাপড়া জানা কমরেড। ‘মার্কসবাদ ও মানবসমাজের বিকাশ প্রসঙ্গে’ এই কঠিন বিষয়কে স্বল্প লেখাপড়া জানা মানুষের উপযোগী করে সহজ সরল ভাষায় কমরেড শিবদাস ঘোষ উপস্থাপনা করেছিলেন। তারই ভিত্তিতে দীর্ঘ আলোচনা করেছেন কমরেড প্রভাস ঘোষ।

আমার রাজনৈতিক জীবনে যৌথ কমিউনিস্ট পার্টি ও পরবর্তীতে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)তে থাকাকালীন একাধিকবার রাজনৈতিক শিবিরে অংশগ্রহণ করার সুযোগ হয়েছিল। সেই সব শিবিরগুলোতে মার্কসবাদ প্রসঙ্গে, মানবসমাজের ক্রমবিকাশ, ভারতের বিপ্লবের স্তর ইত্যাদি বিষয় নিয়ে আলোচনা হতো। এই আলোচনা কিছু লেখা নোট দেখে বলা হত এবং তা-ই নোট করে নেওয়া হতো। কিন্তু বিষয়গুলি সম্পর্কে বাস্তব উদাহরণ বা তুলনামূলক আলোচনা কিছুই হতোনা। শুধু তাই নয়, মার্কসীয় দর্শন সম্পর্কে পুঁথিতে যা লেখা শুধু তাই আলোচনা হতো। মার্কসবাদ পড়ে মুখস্ত করে সেটা জনগণের সামনে বলার জন্য বা মার্কসবাদ সম্বন্ধে নিজের জ্ঞান জাহির করার জন্য বা নিছক জানার জন্য আলোচনা হতো। কিন্তু কে. কে. এম. এস-এর রাজনৈতিক শিক্ষাশিবিরের আলোচনার শুরুতে জানতে পারলাম এখানকার আলোচনার বিষয় শুধু জানার জন্য নয়; নিজের জীবনে, পারিবারিক জীবনে এবং সমাজ জীবনে প্রয়োগ করার জন্য এই শিক্ষাশিবির। মার্কসীয় দর্শনকে উপলব্ধি করে রক্তের সাথে যাতে মিশে যায়, সত্য জানার প্রয়োজন সর্বহারা শ্রেণীর সবচেয়ে বেশী, ব্যক্তিগত স্বার্থের চাইতে বিপ্লবের স্বার্থ ও সংগঠনের স্বার্থকে বড় করে দেখতে হবে, বর্তমান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকটই যে শুধু নয়, সামাজিক সংকট, নীতিনৈতিকতা, মূল্যবোধের অবক্ষয়, জ্ঞান চর্চাকে ধ্বংস করে দেওয়া, বিবেক দ্বারা পরিচালিত না হয়ে প্রবৃত্তির দাসে পরিণত হওয়া প্রভৃতি যে মূল্যবান বিষয়গুলি ১৭/২/৯৯ তারিখের বিকাল বেলায় আলোচিত হল, সেই ধরনের আলোচনা আমার রাজনৈতিক জীবনে এই প্রথম জানার সুযোগ হল। দীর্ঘদিন সি পি আই (এম) পার্টিতে থাকাকালীন কোনদিনও এই ধরনের সামাজিক অবক্ষয়-নীতিনৈতিকতা, মূল্যবোধের চর্চা বা বিপ্লবী চরিত্র গঠন সম্পর্কে আলোচনা হয় নাই। শুধু জানার সুযোগ হয়েছিল যে, নেতৃত্ব থেকে কর্মী স্তর পর্যন্ত পার্টির একাংশ নানা ধরনের অনৈতিক কাজকর্মের সঙ্গে যুক্ত। সুতরাং পার্টির পক্ষ থেকে “শুদ্ধিকরণ” অভিযান চালাতে হবে। তাই একবার দশ দফা, পরবর্তীতে ১৪ দফা শুদ্ধিকরণ পুস্তিকা আমরা পড়েছিলাম। আর সেইসময় জোর দেওয়া হয়েছিল “সাচ্চা কমিউনিস্ট কি করে হতে হয়”-লিও সাউ চির লিখিত বইখানা বেশী করে কমরেডদের শুধু পড়বার জন্য। কিন্তু কমিউনিস্ট হতে গেলে সেই অনুযায়ী আচার-আচরণ, নিষ্ঠা — এইসব যে গুণাবলী অর্জন করতে হয় তার বালাই পূর্বতন পার্টিতে ছিলনা। তাই ইদানিংকালে যে কথাটা বেশী করে প্রচার হচ্ছে – “রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন” তা শুধু বুর্জোয়া দলগুলির মধ্যে নয় – তথাকথিত বামপন্থী নামধারী সি পি আই (এম) পার্টিতেও সৃষ্টি হয়েছে। এবং বহু দুর্বত্ত এই পার্টির পতাকাতলে আশ্রয় নিয়েছে। কিন্তু এস ইউ সি আই পার্টি ও পার্টির পরিচালিত গণসংগঠনগুলিতে প্রথম থেকেই পার্টিকর্মীদের এবং নেতৃত্বের নীতিনৈতিকতা, আদর্শ, মূল্যবোধ বিপ্লবী চরিত্র গঠনের উপর যে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয় ও সেইভাবে গড়ে তোলা হয় তা এদিনকার আলোচনায় কমরেড প্রভাস ঘোষ আরও পরিষ্কারভাবে বললেন। উপরন্তু পার্টি সংগঠন সম্পর্কে বলতে গিয়ে গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার নীতি প্রয়োগের উপর গুরুত্ব আরোপ, নেতৃত্বের কোন ত্রুটি থাকলে বা দেখা দিলে নির্ভয়ে পার্টির স্বার্থে তা উল্লেখ করার কথা তিনি বলেন। অন্ধভাবে অনুসরণ করা নয়, কর্মীদের ত্রুটি-বিচ্যুতির চেয়ে নেতৃত্বের ত্রুটি-বিচ্যুতি পার্টির পক্ষে বেশী ক্ষতিকারক তা বিভিন্ন উদাহরণের সাহায্যে দেখালেন। কিন্তু সি পি আই (এম) পার্টিতে এধরনের নীতি মানার বালাই নেই। তাছাড়া সেখানে পার্টির স্বার্থে নেতৃত্বের ভুলত্রুটি নিয়ে সমালোচনা বা আত্মসমালোচনার সুযোগ নাই।

এস ইউ সি আই পার্টিতে যোগদানের অল্পদিনের মধ্যে আমি যা উপলব্ধি করতে পেরেছি, তা হচ্ছে সত্যিকারের একটি বিপ্লবী পার্টি গড়ে তুলতে হলে যে বিপ্লবী আদর্শ, বিপ্লবী চরিত্র, বলিষ্ঠ নীতি একান্ত দরকার এবং ব্যক্তিজীবনে, পারিবারিক জীবনে ও সমাজজীবনে তার প্রয়োগ, পার্টির স্বার্থকে ও বিপ্লবের স্বার্থকে ব্যক্তিস্বার্থের উর্ধ্বে স্থান দিয়ে কাজ করার যে হিম্মত এসবই এস ইউ সি আই পার্টির নেতৃত্বের মধ্যে ও কর্মীদের মধ্যে বিরাজমান।”

দেবেন্দ্রনাথ বর্মন, তুফানগঞ্জ, কোচবিহার, ২০ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৯