সাম্রাজ্যবাদীদের নির্লজ্জতা আজ বোধহয় সমস্ত সীমা ছাড়িয়ে গেছে৷ মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ যে ডাহা মিথ্যের ওপর ভর করে ইরাকে বর্বর হানাদারি চালিয়েছিল, প্রমাণ হয়ে গেছে সে কথা৷ মৌলবাদী সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলির তাণ্ডব থেকে মানুষকে রক্ষা করার নাম করে দেশে দেশে বোমা মেরে চলেছে যে আমেরিকা, সে নিজেই যে সেইসব গোষ্ঠীর জন্মদাতা এবং অস্ত্র ও অর্থের প্রধান জোগানদার, সে কথাও আজ দিনের আলোর মতো পরিষ্কার৷ এর পরে আবারও মিথ্যা অভিযোগ তুলে সিরিয়ায় হামলা চালাতে বাধেনি এই নির্লজ্জ–শিরোমণিদের৷ ৭ এপ্রিল সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ দৌমা শহরে নিজের দেশের মানুষের উপরেই রাসায়নিক গ্যাস প্রয়োগ করেছেন– এই অভিযোগে ব্যাপক শোরগোল তুলে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ তার দুষ্কর্মের স্যাঙাৎ ব্রিটেন ও ফ্রান্সকে সঙ্গে নিয়ে ১৪ এপ্রিল ভোররাতে সিরিয়ার দামাস্কাস ও হোমস শহরের উপকণ্ঠে ১০৫টি মিসাইল হানা চালিয়ে এলাকাটিকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছে৷ এবারেও পেটোয়া সংবাদমাধ্যমগুলির সম্মিলিত মিথ্যা প্রচারের ঝড় ঠেলে মাথা তুলেছে সত্য৷প্রমাণ হয়ে গেছে, স্রেফ হামলা চালাবার অজুহাত হিসাবে সিরিয়ার বিরুদ্ধে রাসায়নিক হানার অভিযোগ তুলেছিল সাম্রাজ্যবাদীরা৷ টিকে থাকার স্বার্থে লুঠেরা সাম্রাজ্যবাদ দেশে দেশে যে নির্মম আক্রমণ চালায়, বাস্তবে তার ভিত্তিই হল চরম মিথ্যাচার আর কপটতা৷
রাসায়নিক হানায় নিহত ও আহত শিশু–নারীদের ছবি, ভিডিও প্রচার করে কোনও প্রমাণ ছাড়াই এর দায় প্রেসিডেন্ট আসাদের উপর চাপিয়েছে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ৷ বাস্তব পরিস্থিতি নিজের চোখে দেখতে ১৫ এপ্রিল প্রখ্যাত সাংবাদিক রবার্ট ফিস্ক দৌমায় উপস্থিত হয়েছিলেন তথাকথিত রাসায়নিক হামলার তথ্য সংগ্রহ করতে৷ ব্রিটেনের এই প্রবীণ সাংবাদিক মধ্যপ্রাচ্য বিশেষজ্ঞ হিসাবে খ্যাতনামা৷ ‘ইন্ডিপেন্ডেন্ট’ পত্রিকায় প্রকাশিত সরেজমিন তদন্তের ভিত্তিতে তৈরি তাঁর রিপোর্ট ফাঁস করে দিয়েছে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের ভয়ঙ্কর প্রতারণার আসল চেহারা৷
দৌমায় গিয়ে ফিস্ক কথা বলেছেন ডাক্তার আসিম রাহাইবানির সঙ্গে৷ যে ক্লিনিকে রাসায়নিক গ্যাসে আক্রান্ত শিশুদের চিকিৎসার ভিডিও ছবির ব্যাপক প্রচার করেছে মার্কিন প্রচারমাধ্যম, ডাঃ আসিম সেখানেই কাজ করেন৷ ফিস্ক ডাঃ আসিমের বক্তব্য হুবহু তুলে ধরেছেন তাঁর রিপোর্টে৷ ডাক্তারবাবু বলেছেন, ‘‘… সব ডাক্তাররাই সেদিনের ঘটনা জানেন৷ দৌমার আকাশে সেদিন সরকারি বাহিনীর বিমান, অন্যদিন যেমন হয়, তেমনই ঘোরাঘুরি করছিল, সেনাবাহিনীর গোলাবর্ষণও চলছিল৷ কিন্তু সেদিন রাতে হাওয়া ছিল জোরদার৷ হাওয়ায় উড়ে প্রচুর ধুলো ঢুকে পড়ছিল মাটির নিচের ঘরগুলিতে যেখানে সাধারণ মানুষ বাস করে৷
লোকজন সেদিন ক্লিনিকে আসছিল ‘হাইপোক্সিয়া’ বা অক্সিজেনের অভাবের সমস্যা নিয়ে৷ হঠাৎ দরজার কাছে দাঁড়িয়ে একজন– ‘হোয়াইট হেলমেট’ গোষ্ঠীরই কেউ একজন চিৎকার করে উঠল– ‘রাসায়নিক গ্যাস’, আর সঙ্গে সঙ্গে আতঙ্ক ছড়িয়ে গেল৷ ত্রস্ত মানুষজন একে অপরের ওপর জল ঢালতে শুরু করল৷ হ্যাঁ, এই ক্লিনিকেই ভিডিওগুলোর ছবি তোলা হয়েছিল৷ ছবিগুলো বাস্তব, সাজানো নয়৷ কিন্তু সত্যটা হল এই যে, মানুষগুলি হাইপোক্সিয়ায় কষ্ট পাচ্ছিলেন, গ্যাস হামলার কারণে নয়৷’’
দেখা যাচ্ছে, সন্ত্রাসী গোষ্ঠী দমনের লড়াইয়ে সিরিয়ার সরকারি সেনাবাহিনীর সহযোগী রাশিয়া তথাকথিত রাসায়নিক হামলা সম্পর্কে যে বিবৃতি দিয়েছে, তার সাথে ডাঃ আসিমের বক্তব্য মিলে যায়৷ যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়ায় ত্রাণের নামে প্রেসিডেন্ট আসাদের বিরোধিতা করার উদ্দেশ্যে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের হাতে গড়া, তাদেরই সাহায্যপুষ্ট ‘হোয়াইট হেলমেট’ সংস্থার ওপরেই রাসায়নিক হামলার দায় চাপিয়েছে রুশ কর্তৃপক্ষ৷
গত সাত বছর ধরে সিরিয়ায় মৌলবাদী সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলিকে লেলিয়ে দিয়ে প্রেসিডেন্ট আসাদকে ক্ষমতাচ্যুত করার ছক কষে চলেছে আমেরিকা৷ গোষ্ঠীগুলিকে অকাতরে অর্থ ও অস্ত্র সাহায্য করেছে৷ দেশের মধ্যে জারি রেখেছে যুদ্ধ পরিস্থিতি৷ এই অবস্থায় নিজের স্বার্থ রক্ষার লক্ষ্যেই পুঁজিবাদী রাশিয়া আমেরিকার একচেটিয়া দাদাগিরি রুখতে সিরিয়ার প্রেসিডেন্টের পাশে দাঁড়ায়৷এরপর থেকে ছবিটা পাল্টে যেতে শুরু করে৷ রাশিয়ার সাহায্য নিয়ে প্রেসিডেন্ট আসাদের সেনাবাহিনী সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীগুলিকে কোণঠাসা করে ফেলে৷ ঢোঁক গিলে পিছু হঠতে হয় মার্কিন সাম্রাজ্যবাদকে৷ প্রেসিডেন্টকে উৎখাত করার পরিকল্পনা বাতিল করতে হয়৷ সম্প্রতি সিরিয়া থেকে হাত গুটিয়ে নেওয়ার কথা ঘোষণা করতে বাধ্য হয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প৷ বাস্তবে এই এপ্রিল মাসেই মৌলবাদী সন্ত্রাসী বাহিনীর টিকে থাকা অল্প কয়েকটি গোষ্ঠীরও মৃত্যুঘন্টা বাজিয়ে দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট আসাদ৷ কয়েক হাজার সন্ত্রাসবাদী আত্মসমর্পণ করেছে৷ টিকে থাকা সন্ত্রাসবাদীদের পূর্ব ঘউটার পাহাড়ি এলাকাগুলি থেকে রাশিয়ার সাহায্যে ঝেঁটিয়ে বিদায় করেছে সিরিয়ার সরকারি বাহিনী৷ সিরিয়া সরকার ‘মানবিক করিডর’ তৈরি করে আটকে পড়া দেড় লক্ষের বেশি নাগরিককে ওই অঞ্চল থেকে বেরিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছে৷ যে দৌমা শহরে রাসায়নিক হামলার অভিযোগ তুলেছে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ, বাস্তবে সেই শহরটিকেই শুধু সন্ত্রাসবাদীদের হাত থেকে মুক্ত করতে বাকি ছিল৷ তথাকথিত রাসায়নিক হানার মাত্র ২৪ ঘন্টা আগেই সিরিয়ার বিমান বাহিনী দৌমায় সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠী জয়েশ আল–ইসলামের ৩০০টি ঘাঁটি ধ্বংস করেছে, ধ্বংস করা হয়েছে সন্ত্রাসীদের সদর দপ্তর, যোগাযোগ দপ্তর এবং অস্ত্রভাণ্ডার৷
এইরকম একটা পরিস্থিতিতে, জয় যখন একেবারে নাগালের মধ্যে, সেই সময় সিরিয়া সরকার নিজের দেশের জনগণের ওপর রাসায়নিক হামলা চালাবে– এ কথা এমনিতেই অবিশ্বাস্য এবং হাস্যকর৷ কিন্তু মিসাইল হানা চালাবার অজুহাত চাই আমেরিকার৷ তাই কোনও প্রমাণের তোয়াক্কা না করেই প্রেসিডেন্ট আসাদের ওপর এই হামলার দায় চাপিয়েছে তারা৷ যে মার্কিন প্রতিরক্ষা সচিব জেমস ম্যাটিস মিসাইল হানার একদিন আগেও বলেছেন, তাঁরা আসাদ সরকারের রাসায়নিক হামলার প্রমাণ খোঁজার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন, সেই তিনিই ১৩ তারিখ রাতে ঘোষণা করেছেন, তাঁরা নিশ্চিত যে রাসায়নিক হামলা হয়েছে৷ যদিও কোথা থেকে এল এই নিশ্চয়তা, বিশ্ববাসীকে সে কথা জানানোর প্রয়োজন বোধ করেননি তিনি৷ শুধু তাই নয়, দৌমায় আদৌ রাসায়নিক হামলা হয়েছে কিনা তা নিয়ে রাসায়নিক অস্ত্র প্রতিরোধী সংস্থা ‘ওপিসিডব্লিউ’–র তদন্তে আসার কথা ছিল যখন, ঠিক তার আগেই সাম্রাজ্যবাদীরা এই মিসাইল হামলা চালাল৷ অর্থাৎ এই সংস্থাকে তদন্ত করে সত্য প্রমাণের সুযোগ না দিয়ে গায়ের জোরে একতরফা ভাবে সাম্রাজ্যবাদীরা ঘোষণা করে দিল দৌমায় রাসায়নিক হামলা হয়েছে এবং তার পিছনে রয়েছেন প্রেসিডেন্ট আসাদ৷
সাম্রাজ্যবাদী প্রচারমাধ্যম চেপে দিতে চাইলেও সাংবাদিক রবার্ট ফিস্কের রিপোর্ট ইতিমধ্যেই সামনে চলে এসেছে৷ ঠিক যেমন করে সামনে চলে এসেছিল ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হুসেনের বিরুদ্ধে তোলা গণবিধ্বংসী অস্ত্র মজুত রাখার অভিযোগের অসত্যতা৷
সিরিয়ার ওপর সাম্রাজ্যবাদীদের সাম্প্রতিক হামলাকে ধিক্কার জানাচ্ছে গোটা বিশ্বের শান্তিকামী সাম্রাজ্যবাদবিরোধী মানুষ৷ গোটা দুনিয়া জুড়ে যতদিন না সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ঐক্যবদ্ধ জঙ্গি শান্তি আন্দোলন মাথা তুলে দাঁড়াবে ততদিন সাম্রাজ্যবাদীদের এই নির্লজ্জ মিথ্যাচার ও নির্মমতা বন্ধ হবে না৷
(৭০ বর্ষ ৩৬ সংখ্যা ২৭ এপ্রিল, ২০১৮)