‘সিবিআই একটি নিরপেক্ষ সংস্থা’– দেশের বহু মানুষের ধারণা এমনটাই৷ সেই সংস্থার নিরপেক্ষতা দূরে থাকুক, সততাই এখন ধুলোয় লুটোচ্ছে৷ দেশের প্রধান তদন্তকারী এই সংস্থাটির দুই শীর্ষকর্তার পরস্পরের বিরুদ্ধে বিপুল পরিমাণ ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ এবং শেষ পর্যন্ত তাঁদের দুজনকে বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠানোর ঘটনাতে সংস্থার নিরপেক্ষতা এবং সততার মিথটা ভেঙে চুরমার হয়ে গেল৷ মানুষ দেখল, শীর্ষকর্তারাই বিরাট বিরাট অপরাধকে ধামাচাপা দিতে কিংবা গুরুতর অপরাধীদেরও বেকসুর সাজাতে শত শত কোটি টাকা ঘুষ নেয়৷ অন্য দিকে শাসক দল তাদের নিজেদের অপরাধ ধামাচাপা দিতে এবং বিরোধীদের হেনস্থা করতে নগ্ণভাবে এই সংস্থাটিকে কাজে লাগায়৷ স্বাভাবিক ভাবেই এরপর আর সংস্থার বিশ্বাসযোগ্যতা বলে কিছু অবশিষ্ট থাকে না৷
ঘটনায় দেখা যাচ্ছে, সিবিআই অধিকর্তা অলোক বর্মা সংস্থার বিশেষ অধিকর্তা রাকেশ আস্থানার বিরুদ্ধে ধনকুবের মাংস ব্যবসায়ী মইন আখতার কুরেশির দুর্নীতির মামলা মিটমাট করে দেওয়ার জন্য দু’কোটি টাকা ঘুষ নিয়েছেন বলে অভিযোগ এনেছেন৷ যে কুরেশি আয়কর ফাঁকি, হাওয়ালা সহ বহু দুর্নীতিতে অভিযুক্ত৷ ৮১০০ কোটি টাকা আর্থিক দুর্নীতিতে অভিযুক্ত আত্মগোপনকারী ব্যবসায়ী চেতন সন্দেসারার সঙ্গে আস্থানার যোগসাজশের অভিযোগের তদন্ত করছে সিবিআই৷ সেই তদন্তে শেষ পর্যন্ত অলোক বর্মা যখন আস্থানাকে বরখাস্তের পরিকল্পনা নেন তখনই ২৩ অক্টোবর মাঝরাতে আচমকা দুই শীর্ষকর্তাকেই ছুটিতে পাঠিয়ে দেয় সরকার৷ আস্থানার বিরুদ্ধে তদন্ত করছিলেন যে অফিসারেরা তাঁদের সকলকেই দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বদলি করে দেওয়া হয়৷ আস্থানার বিরুদ্ধে ঘুষকাণ্ডের তদন্তকারী অফিসারকে পাঠানো হয়েছে সূদূর আন্দামানে৷ রাতারাতি সেন্ট্রাল ভিজিল্যান্স কমিশনকে দিয়ে এগুলির সুপারিশ করিয়ে নেয় সরকার৷ অভিযোগ উঠেছে, রাফাল কেলেঙ্কারি এবং বিজেপি সভাপতি অমিত শাহের ছেলের দুর্নীতির তদন্তেরও উদ্যোগ শুরু করেছিলেন সিবিআই অধিকর্তা৷ তাই তড়িঘড়ি তাঁকে ছুটিতে পাঠিয়ে বাঁচতে চাইছেন বিজেপি নেতা–মন্ত্রীরা৷ অন্য দিকে আস্থানাও ভার্মার বিরুদ্ধে পাল্টা কুরেশির থেকে দু’কোটি টাকা ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ করেছেন– সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে যার তদন্ত শুরু হয়েছে৷
সিবিআইয়ের বিশেষ অধিকর্তা রাকেশ আস্থানা প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ আস্থাভাজন বলে পরিচিত৷ এক সময়ে গুররাট ক্যাডারের এই আইপিএস অফিসারকে সিবিআই অধিকর্তা পদে বসানোর উদ্যোগ নিয়েছিলেন বিজেপি নেতারা৷ ২০০২ সালে গুজরাটের গোধরায় সবরমতী এক্সপ্রেসে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার তদন্তে গঠিত ‘স্পেশাল ইনভেস্টিগেশন টিম’ (সিট)–এর নেতৃত্বে ছিলেন আস্থানা৷ তিনি অযোধ্যা ফেরত করসেবকে ভরা এস–৬ কামরায় আগুন লাগার ঘটনাকে ‘পরিকল্পিত নাশকতা’ হিসাবে চিহ্ণিত করেছিলেন৷ তাতে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী মোদির আরও আস্থাভাজন হয়ে ওঠেন আস্থানা৷ ইসরাত জাহান ভুয়ো পুলিশি সংঘর্ষের মামলাতেও তাঁর বিরুদ্ধে তথ্যপ্রমাণ লোপাটের অভিযোগ উঠছিল৷ ২০১৬ সালে আস্থানার মেয়ের বিয়েতে রাজসিক আয়োজনে ব্যাঙ্ক জালিয়াতিতে অভিযুক্ত চেতন সন্দেসারা মোটা টাকা ঢেলেছিলেন বলে অভিযোগ কিংবা এক বিতর্কিত শিল্পপতির ব্যক্তিগত বিমানে বিদেশ সফর ঘিরে আস্থানার বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে অভিযোগ উঠলেও তাতে কর্ণপাত করেননি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি৷ গুজরাটে চেতনের সংস্থা স্ট্যার্লিং বায়োটেক দুর্নীতি মামলায় আস্থানার নামও জড়িয়েছে৷ এইসব যুক্তিতে বিশেষ অধিকর্তা হিসাবে আস্থানার নিয়োগের বিরোধিতা করেছিলেন ভার্মা৷ কিন্তু প্রধানমন্ত্রী অভিযোগগুলিকে কোনও গুরুত্ব দেননি৷
সুপ্রিম কোর্টে পেশ করা আবেদনে ভার্মা বলেছেন, তাঁকে বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠানোর কারণ হল কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যক্তির বিরুদ্ধে তদন্ত করার সময় সরকারের পছন্দ মতো নির্দেশ গ্রহণ করা হয়নি, তাতেই তিনি সরকারের বিরাগভাজন হয়ে পড়েন৷ তিনি বলেছেন, আদালত চাইলে তিনি সেই সব ঘটনার বিবরণ তুলে ধরতে পারেন৷
সিবিআই কর্তাদের বিরুদ্ধে ঘুষ নিয়ে দুর্নীতিগ্রস্তদের ক্লিনচিট দেওয়ার অভিযোগ বারে বারে উঠেছে৷ ২০১০–১২ অবধি সিবিআই প্রধান থাকা এ পি সিংহের বিরুদ্ধেও কুরেশির থেকে ঘুষ নেওয়ার অভিযোগের তদন্ত করছে সিবিআই৷ এই অভিযোগের কারণে সিংকে অবসরের পর যোগ দেওয়া ইউপিএসসির সদস্যপদ ছাড়তে হয়৷ এ পি সিংহের পরে সিবিআই প্রধান হন রঞ্জিত সিনহা৷ রঞ্জিত সিনহার ‘ভিজিটরস বুক’ থেকে জানা যায়, তাঁর সঙ্গে ১৫ মাসে ৭০ বার দেখা করেছিল কুরেশি৷ অবসরের পর তাঁর বিরুদ্ধে কয়লা কেলেঙ্কারির তদন্ত করছে সিবিআই৷ এখন আবার প্রধানমন্ত্রীর আস্থাভাজন আস্থানার সঙ্গে কুরেশির যোগ সামনে চলে এসেছে৷
সব মিলিয়ে একদিকে তদন্ত সংস্থার কাজে প্রতি পদে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, অন্য দিকে সংস্থার কর্তাদের আকণ্ঠ দুর্নীতি প্রকাশ্যে এসে গেছে৷ এর আগে কংগ্রেস রাজত্বেও বারে বারে সিবিআইকে বেআইনি এবং অন্যায় ভাবে কাজে লাগানোর অভিযোগ উঠেছে৷ যা দেখে ২০১৩ সালে সুপ্রিম কোর্ট সিবিআইকে ‘খাঁচার তোতাপাখি’ বলেছিল৷ সিবিআইয়ের মতো ইডির শীর্ষস্তরের সঙ্গে সরকারের সংঘাতও চরমে উঠেছে৷ এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরটে বা ইডিতে অবস্থা এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে, ২৭ অক্টোবর অবসরের পর আরও তিন মাসের জন্য দায়িত্বে বহাল থাকার অনুরোধ জানানো হলেও তা স্বীকার করতে রাজি হননি ইডি নির্দেশক কারনাল সিং৷ এর কারণ, ইডির পরিচালনা পদ্ধতিতে বারবার সরকারি হস্তক্ষেপ৷ গত এক বছরের বেশি সময় ধরে গুরুত্বপূর্ণ সব মামলায় কার্যত কোনও সময়োচিত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে দেওয়া হয়নি কারনাল সিংকে৷
বিজেপিরই সাংসদ সুব্রহ্মণ্যম স্বামী সেন্ট্রাল ভিজিল্যান্স কমিশনের (সিভিসি) কমিশনার কে ভি চৌধুরীর বিরুদ্ধে পি চিদম্বরম ও তাঁর ছেলের বিরুদ্ধে মামলা লঘু করার অভিযোগ করেছেন৷ তাঁর অভিযোগ, অর্থমন্ত্রকের অধিকারিক থাকার সময় তিনি রেভিনিউ ইনটেলিজেন্সের অনেকগুলি তল্লাশি চালান৷ তারপর ঘুষ নিয়ে মামলাগুলি ধামাচাপা দেন৷ একই সাথে তাঁর অভিযোগ, সিবিআই, ইডি, আইবি, র, আরবিআই–এর মতো সংস্থার অধিকর্তাদের উপর ২০১৯–এর মধ্যে নিয়ন্ত্রণ কায়েম করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন কেন্দ্রীয় তথ্য সচিব হাসমুখ আধিয়ার নেতৃত্বে এক ‘দুষ্ট চতুষ্টয়’ (গ্যাং অফ ফোর)৷
সরকারের কাজকর্মে কোথাও গণতন্ত্রের চিহ্ণমাত্র নেই৷ সরকারি ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে বিজেপি নেতা–মন্ত্রীরা গণতান্ত্রিক সব প্রতিষ্ঠানগুলি কুক্ষিগত করছে৷ এ কথা কেউ ভুলে যাননি, গত লোকসভা নির্বাচনের আগে কংগ্রেসের আকণ্ঠ দুর্নীতিতে যখন দেশের মানুষ অতিষ্ঠ, তখন বিজেপি নেতারা স্বচ্ছ প্রশাসনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে মানুষের ক্ষোভকে কাজে লাগিয়েছিল৷ কিন্তু সেই প্রতিশ্রুতি যে আসলে দেশের মানুষের সাথে এত বড় প্রতারণা তা বোধহয় বিজেপির অতিবড় সমর্থকও সেদিন কল্পনা করতে পারেননি৷
এসব অভিযোগ কোনওটিই সরকারের নেতা–মন্ত্রীদের অজানা নয়৷ তাঁরা সব জেনেও এসব চলতে দিচ্ছেন৷ কেন দিচ্ছেন? কারণ এই সব নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলির শীর্ষকর্তাদের দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দিয়েই এগুলিকে তাঁরা মুঠোর মধ্যে এনেছেন৷ তারপর তাঁদের স্বার্থে ইচ্ছেমতো ব্যবহার করছেন৷ বিরোধীদের শায়েস্তা করতে অস্ত্র হিসাবে সংস্থাগুলিকে কাজে লাগানোর অভিযোগ বারে বারে উঠেছে৷ তাতে দেশের মানুষের চোখে এই স্বাধীন এবং নিরপেক্ষ বলে পরিচিত সংস্থাগুলি যদি খাঁচার তোতাপাখিতে পরিণত হয়, তাতে কিছু যায়–আসে না৷ অথচ একদিন পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের বিভিন্ন শাখাগুলির মধ্যে সমন্বয় রক্ষার জন্য এই ধরনের স্বাধীন সংস্থাগুলি গড়ে তোলা হয়েছিল৷ যাতে কোনও একটি শাখা তার এক্তিয়ারের সীমা অতিক্রম করে পুঁজিপতি শ্রেণির সামগ্রিক স্বার্থের হানি না ঘটাতে পারে৷ আজ অর্থনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থা হিসাবে পুঁজিবাদ যত পচে যাচ্ছে, যত তার উৎপাদনে নৈরাজ্য দেখা দিচ্ছে, তত তার প্রতিফলন এই প্রতিষ্ঠানগুলিতেও পড়ছে৷ পুঁজিবাদ যত সংকটগ্রস্ত হচ্ছে, পুঁজিপতি শ্রেণি ততই দুর্নীতিগ্রস্ত হচ্ছে, তাদের সেবক রাজনৈতিক দলগুলি এবং তার নেতারাও তত দুর্নীতিগ্রস্ত হচ্ছে৷ সংকটগ্রস্ত পুঁজিবাদ আজ তার মুনাফা বজায় রাখতে সমস্ত রকম ন্যায়নীতিকে বিসর্জন দিয়েছে৷ কারণ ন্যায়, নীতি এগুলি পুঁজিবাদের শোষণের স্টিমরোলার চালানোর ক্ষেত্রে বাধা হিসাবে দাঁড়াচ্ছে৷ তার জন্য তাদেরই তৈরি একদিনের আইনকে তারা আজ আমূল বদলে দিচ্ছে৷ স্বাধীন বলে পরিচিত সংস্থাগুলির মাথায় নিজেদের পছন্দের লোক বসিয়ে সেগুলির দখল নিচ্ছে৷ ব্যাপারটা এমন নয় যে বিজেপিই প্রথম এ কাজ করছে৷ এর আগে কংগ্রেসও একই কাজ করেছে৷ রাজ্যে রাজ্যে আঞ্চলিক বুর্জোয়া দলগুলি কিংবা বাম–নামধারী সোস্যাল ডেমোক্র্যাট দলগুলিও যে যার সাধ্যমতো একই কাজ করছে৷ তবে বিজেপি এসব করছে একেবারে নগ্ণ এবং নির্লজ্জ ভাবে৷
ক্ষমতায় বসার আগে দলের নেতারা বিজেপিকে ‘অন্য ধরনের দল’ বলে ঘোষণা করেছিলেন৷ ক্ষমতায় বসার মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই একের পর এক দুর্নীতিতে নিজেদের জড়িয়ে পড়া এবং অন্যদের দুর্নীতিতে মদত দেওয়ার ঘটনায় দেশের মানুষের কাছে স্পষ্ট হয়ে গেল বিজেপি কেমন অন্য ধরনের দল৷ এ রাজ্যে যাঁরা তৃণমূলের দুর্নীতি এবং নীতিহীন আচরণ দেখে বিজেপিকে বিকল্প ভাবছেন সিবিআই–কান্ড তাঁদের অবশ্যই চোখ খুলে দেবে৷
(৭১ বর্ষ ১২ সংখ্যা ২ – ৮ নভেম্বর, ২০১৮)