দিল্লিতে আন্দোলনকারী কৃষকদের সঙ্গে সরকারের দফায় দফায় বৈঠক যখন ব্যর্থ, যখন কৃষকরা ঘোষণা করছেন– ‘লড়ব এবং জিতব’, তখন হঠাৎ সিপিএম সাধারণ সম্পাদক কমরেড সীতারাম ইয়েচুরি সর্বভারতীয় ইংরেজি দৈনিক ‘দি হিন্দু’তে (৩১ ডিসেম্বর, ২০২০) এবং সিপিএমের বাংলা মুখপত্র গণশক্তিতে নিবন্ধ লিখে দাবি করলেন, সরকার কৃষকদের সাথে আলোচনায় কর্পোরেটকেও ডাকুক এবং তাঁদের সাথে আলোচনার ভিত্তিতে নতুন আইন নিয়ে আসুক (১ জানুয়ারি, ২০২১)।
সিপিএম সম্পাদকের এই প্রস্তাবে আন্দোলনকারী কৃষকরা রীতিমতো বিস্মিত। তাঁদের প্রশ্ন, কথা তো সরকার এবং কৃষকদের মধ্যে। কর্পোরেট মালিকরা সেখানে অসে কী করে! সীতারাম ইয়েচুরি হঠাৎ এমন প্রস্তাব তুললেন কেন? তিনি কি তবে কর্পোরেটের মুখপাত্র হলেন! রাজধানী দিল্লির এই আন্দোলন সব দিক থেকেই ঐতিহাসিক। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে কৃষকরা আন্দোলনে ঐক্যবদ্ধ। তেমনই এই আইন তৈরির পিছনে যে সরকারের কর্পোরেটদের স্বার্থ রক্ষার তাগিদই কাজ করেছে, কৃষকদের স্বার্থ রক্ষা নয়, তা আন্দোলনকারী কৃষকদের কাছে দিনের আলোর মতো স্পষ্ট। তাই আন্দোলনের ময়দান থেকে এক দিকে সরকারের কৃষক বিরোধী চরিত্রের বিরুদ্ধে স্লোগান উঠেছে, তেমনই কর্পোরেট পুঁজিকেও সরাসরি কাঠগড়ায় তুলেছেন তাঁরা। কৃষি-আইনের অন্যতম প্রধান সুবিধাভোগী আম্বানি এবং আদানিদের পণ্য বয়কটের ডাক দিয়েছে কৃষক সংগঠনগুলি। কৃষকরা জিও ফোন বয়কট করেছেন। পাঞ্জাব হরিয়ানা জুড়ে জিও-র টাওয়ারগুলিতে বিদ্যুৎ সংযোগ ছিন্ন করে দিয়েছেন। ফলে কৃষকরা যখন ধনকুবের কোম্পানি মালিকদের বিরুদ্ধে এমন আপসহীন ভাবে লড়াই করছে তখন সিপিএম নেতার তাদের সাথে গলাগলির এই প্রস্তাবে কৃষকরা রীতিমতো স্তম্ভিত।
কৃষকদের দাবি, সরকার অবিলম্বে কর্পোরেট স্বার্থবাহী কৃষি আইন প্রত্যাহার করুক। এই নিয়ে দফায় দফায় সরকারের সঙ্গে কৃষকদের আলোচনা চলছে। সরকার দাবি না মানলে আন্দোলন আরও তীব্র হবে বলে কৃষকরা স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন। এই রকম পরিস্থিতিতে সিপিএম সম্পাদকের এমন প্রস্তাব স্বাভাবিক ভাবেই আন্দোলনের ক্ষতি করবে, নানা বিভ্রান্তি তৈরি করবে। বাস্তবে সীতারাম ইয়েচুরি এই প্রস্তাবের দ্বারা তাঁর দলের আপসকামী চরিত্রটিকেই স্পষ্ট করলেন না কি? তাঁরা মুখে নিজেদের শ্রমিক-কৃষকের দল বলেন। অথচ আন্দোলনে কৃষকদের আপসহীন মনোভাব যখন শাসক দল এবং শাসক পুঁজিপতি শ্রেণির মনে ভয় ধরিয়ে দিয়েছে তখন এমন একটি প্রস্তাব শ্রেণিসংগ্রাম তীব্র করার পরিবর্তে শ্রেণি সমন্বয়েরই ইঙ্গিতবাহী। এর দ্বারা কি সিপিএমের শাসক পুঁজিপতি শ্রেণির স্বার্থ রক্ষায় আপসকামী তথা সোস্যাল ডেমোক্রেটিক চরিত্রটিকেই আবার স্পষ্ট করে দিল না? সিপিএমের কৃষক সংগঠনও এই আন্দোলনের অংশীদার। কিন্তু সিপিএম সম্পাদক তথা দল হিসেবে সিপিএম যদি এই আপসকামী নীতি নিয়ে চলে তবে তাঁদের অনুগামী কৃষক নেতারা কি আন্দোলনে সঠিক ভূমিকা পালন করতে পারবেন? নানা কথার প্যাঁচে তাঁরাও তো শেষ পযন্ত এই আপসের ভূমিকাটিই পালন করবেন! সিপিএমের যে কর্মী-সমর্থকরা কৃষক আন্দোলনের সাফল্য চাইছেন তাঁদের নেতৃত্বের এই ভূমিকা বিচার করে দেখা দরকার।