প্রসঙ্গ পাঁচামি খনি প্রকল্প
২৬ ডিসেম্বর বীরভূমের সিউড়িতে রামকৃষ্ণ সভাগৃহে অনুষ্ঠিত নাগরিক কনভেনশন স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করল, ডেউচা-পাঁচামি এলাকায় জমি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম-লালগড়ের ছায়া দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। ডাক্তার, অধ্যাপক, শিক্ষক সহ সমাজের বিভিন্ন স্তরের দুই শতাধিক মানুষের উপস্থিতিতে ও বিশিষ্ট নাগরিক বংশীধর দাসের সভাপতিত্বে এই কনভেনশন পরিচালিত হয়। মূল প্রস্তাব পেশ করেন মার্শাল হেমব্রম। বক্তব্য রাখেন, শিক্ষক বাগাল মার্ডি, মেডিকেল সার্ভিস সেন্টারের সম্পাদক ডাঃ অংশুমান মিত্র, বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডঃ বিজয়কৃষ্ণ দলুই, অল ইন্ডিয়া জন অধিকার সুরক্ষা কমিটির যুগ্ম সম্পাদক দীপক কুমার, বিসম্বর মুড়া প্রমুখ। এই নাগরিক কনভেনশন এবং আন্দোলনের সাথে সহমত জ্ঞাপন করে বার্তা পাঠায় সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম আন্দোলন পর্বে গড়ে ওঠা ‘শিল্পী-সাংস্কৃতিক কর্মী-বুদ্ধিজীবী মঞ্চ’ ও ‘নাগরিক প্রতিরোধ মঞ্চ’। উভয় বার্তা পাঠ করেন শুভময় দে।
কনভেনশনের মূল প্রস্তাবে বলা হয়েছে, বীরভূমের মহম্মদবাজার ব্লকের পাঁচামি এলাকায় প্রস্তাবিত কয়লা প্রকল্পকে কেন্দ্র করে পুলিশ-প্রশাসন এলাকাবাসীদের উপর যেভাবে আক্রমণ নামিয়ে আনছে এই নাগরিক কনভেনশন তাতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছে ও তীব্র ধিক্কার জানাচ্ছে।
বর্তমান পরিস্থিতিতে একজন দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে ওই এলাকার নির্যাতিত মানুষের পাশে দাঁড়ানো এবং সহমর্মিতা প্রকাশ করা প্রতিটি বিবেকবান মানুষের কর্তব্য হিসাবে এই সভা দৃঢ়ভাবে অভিমত ব্যক্ত করছে।
জিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার পর্যবেক্ষণে কয়েক বছর আগেই ধরা পড়েছিল, ডেউচা-পাঁচামি এলাকায় হিংলো, ভাঁড়কাটা এবং ডেউচা গ্রাম পঞ্চায়েতের দশটি মৌজা জুড়ে প্রায় ৩৪০০ একর জায়গায় ১২০০ ফুট মাটির নিচে রয়েছে অতি উন্নত মানের কয়লার এক সুবিশাল ভাণ্ডার। তার উপরের অংশে রয়েছে ব্যাসল্টের স্তর এবং সেটাও অত্যন্ত উৎকৃষ্ট মানের। সংবাদে প্রকাশ, সম্পদের বিচারে এটি ভারতের বৃহত্তম এবং পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম কয়লা ভাণ্ডার। বৈশিষ্ট্য অনুসারে এটি পার্মিয়ান বা গন্ডোয়ানা কয়লা, প্রায় ৩০০ কোটি বছর আগে তৈরি। প্রকৃতিতে এটি বিটুমিনাস ধরনের। এর মোট পরিমাণ ২১০০ কোটি টন।
বিপুল এই প্রাকৃতিক সম্পদ মুনাফার উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত না হয়ে দেশের মানুষের উন্নয়নের কাজে যদি সত্যিই ব্যবহার হয় তাতে মানুষের খুশি হওয়ার কথা। বিশেষত শিল্পে অনগ্রসর বীরভূম জেলাবাসী এবং তীব্র বেকার সমস্যায় জর্জরিত মানুষ এই এলাকায় বিজ্ঞান-নির্ভর পদ্ধতিতে প্রাকৃতিক সম্পদ উত্তোলন এবং উন্নয়নমূলক কাজে ব্যবহারে আশান্বিত হবেন, এটাই স্বাভাবিক।
প্রশাসনের প্রধান হিসাবে মুখ্যমন্ত্রী গত ১১ সেপ্টেম্বর বিধানসভায় দাঁড়িয়ে এই কয়লা প্রকল্প চালু করার ঘোষণা করেন। ক্ষতিপূরণ এবং পুনর্বাসন সংক্রান্ত একটি প্যাকেজও ঘোষণা করেন। তিনি আশ্বস্ত করেন, জোর করে কারও জমি কেড়ে নেওয়া হবে না, আলোচনা করেই সব কাজ করা হবে। কিন্তু এই দীর্ঘ সময়ে প্রশাসনের পক্ষ থেকে আলোচনা করে প্রকল্পের কাজে হাত দেওয়ার কোনও সুস্পষ্ট, সদর্থক এবং কার্যকরী পদক্ষেপ কেউ দেখতে পায়নি। আলোচনার নামে, মূলত সরকারের সাথে নানা বিষয়ে সহমত পোষণ করেন, সরকারি দলের প্রতি অনুগত, এমন ব্যক্তিদের সাথেই প্রশাসন কিছু কথাবার্তা মাঝেমাঝে চালিয়েছে। এলাকার সম্ভাব্য প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের মানুষদের সাথে প্রশাসন কথা বলার কোনও প্রয়োজন মনে করেনি। কেবল সরকারের অভ্যন্তরে পরিকল্পনা ছাড়া এ বিষয়ে কোনও বিশেষজ্ঞ মহলের সাথেও আলোচনা এবং তার ফল জনসমক্ষে জানানোর কোনও প্রচেষ্টা দেখা যায়নি। সরকারি প্যাকেজের প্রতি যে ওখানকার মানুষ আদৌ আস্থাশীল নন, এ কথা প্রশাসন জানলেও তার সমাধান নিয়ে কোনও ভূমিকা তারা নেয়নি। ওখানে কয়েক শত পাথর খাদান এবং ক্রাশিং মেশিন আছে, যেখানে ওই এলাকা ছাড়াও পার্শ্ববর্তী এলাকার হাজার হাজার শ্রমিক কাজ করেন। যতদূর খবর পাওয়া গেছে ওই খাদান শ্রমিকদের ও কর্তৃপক্ষের সাথেও বিশেষ কোনও আলোচনা তাঁরা করেননি।
এই প্রকল্প হলে তার আনুষঙ্গিক সমস্যা এবং সরকার যে খোলামুখ খনির কথা বলছে, যা অত্যন্ত ক্ষতিকারক, তা উপলব্ধি করে ইতিমধ্যে মানুষ প্রতিবাদে সরব হয়েছেন। এতে শুধু ওই প্রকল্পাধীন এলাকা নয়, প্রকল্পের পার্শ্ববর্তী এলাকার হাজার হাজার মানুষের স্বাস্থ্যের ভয়ঙ্কর সমস্যা দেখা দেবে, উর্বর জমি বন্ধ্যা হবে, ৩০৭ একর বনভূমি ধ্বংস হবে এবং প্রাকৃতিক ভারসাম্য, জলবায়ুর সমস্যা দেখা দেবে– যা পরিবেশগত সমস্যার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সব মিলে এলাকায় জনজীবন যে বিপন্ন হবে, তা নিয়ে বিজ্ঞানভিত্তিক কোনও পদক্ষেপের কথা জনগণের সামনে তুলে ধরা হয়নি। বিভিন্ন বিষয়ের বিজ্ঞানী, স্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞ, পরিবেশবিদরা এ নিয়ে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন।
এই সভা অত্যন্ত উদ্বেগের সাথে লক্ষ করছে, প্রকল্প এলাকার সম্ভাব্য ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ এবং জনসাধারণের কাছে সমস্ত বিষয় খোলামেলা রাখার পরিবর্তে কত দ্রুত কয়লা প্রকল্পের কাজ শুরু করা যায় এবং ওখানকার মানুষকে উচ্ছেদ করা যায় সেই বিষয়ে সরকার এবং তার প্রশাসন খুবই তৎপর। শুধু তাই নয়, ওখানকার মানুষ যারা এই ধরনের সরকারি পদক্ষেপের বিরোধিতা করছেন তাদের হুমকি দেওয়া, থানায় নিয়ে গিয়ে চাপ সৃষ্টি করা, মিথ্যা কেসে ফাঁসিয়ে দেওয়ার ভয় দেখানো, ওখানকার লোকজনের ওপর পুলিশ ও সরকারি দলের লোকদের কড়া নজরদারি শুরু করা, তাদের এমনকি আত্মীয়দেরও গ্রামে আসা-যাওয়ার উপর নজরদারি চলতে থাকে। ওখানকার দশটি মৌজায় জরুরি প্রয়োজনেও জমি কেনাবেচা বন্ধ করে ধীরে ধীরে একটা ভয়ের বাতাবরণ এবং শ্বাসরোধকারী পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হয়েছে।
কনভেনশনের দাবি ১। দেওয়ানগঞ্জে নিরীহ গ্রামবাসী মহিলাদের ওপর বর্বরোচিত হামলায় জড়িত পুলিশ এবং সমাজবিরোধীদের কঠোর শাস্তি দিতে হবে, ২। আহতদের চিকিৎসার পরিপূর্ণ দায়িত্ব সরকারকে নিতে হবে। ৩। কয়লা খনির যে কোনও কাজ এখন বন্ধ সামগ্রিক বিষয়গুলি শুধু পছন্দমত ব্যক্তিবিশেষের কাছে নয়, জনগণের কাছে প্রকাশ্যে রাখতে হবে, ৪। প্রস্তাবিত কয়লা খনির ডিপিআর, স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, পরিবেশবিদ, ভূ-বিজ্ঞানী, খনি বিশেষজ্ঞদের মতামত জনসাধারণের কাছে শ্বেতপত্র আকারে প্রকাশ করতে হবে, ৫। এলাকাবাসী এবং জনসাধারণের জীবন-জীবিকা সম্পর্কে আবেগ ও উদ্বেগকে আঘাত করে বলপূর্বক জমি দখল করা চলবে না, ৬। হাজার হাজার মানুষকে উচ্ছেদ করে খনি প্রকল্প চালু করা চলবে না। |
সভা এ-ও লক্ষ্য করছে, মুখ্যমন্ত্রীর ‘জোর করে জমি নেওয়া হবে না’ এই ঘোষণা থেকে অতি দ্রুত সরে এসে জমি দেওয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি শুরু হয়েছে। যা এলাকা ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্যই কার্যত হুমকি। গত ২৩ ডিসেম্বর হিংলো গ্রাম পঞ্চায়েতের দেওয়ানগঞ্জে শাসক দলের পক্ষ থেকে লোকজন জড়ো করে খনির দাবিতে বিরাট মিছিল হয়। স্বভাবতই গ্রামবাসীরা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। এলাকার মানুষজন, বিশেষত আদিবাসী মহিলারা সংঘবদ্ধ হয়ে প্রতিবাদ জানান। তাদের তীব্র প্রতিবাদের ফলে মিছিল না করেই তারা ফিরে যেতে বাধ্য হয়। এই ঘটনার পরপরই তারা ওইদিনই আবার সংঘবদ্ধ হয়ে সন্ধ্যার অন্ধকারে বিশাল পুলিশবাহিনী নিয়ে গ্রামবাসীদের ওপরে অতর্কিতে নির্বিচার আক্রমণ চালায়। লক্ষ্যবস্তু হয়ে দাঁড়ায় বিশেষত মহিলারা। শুধু তাই নয়, আহত মহিলাদের যাতে চিকিৎসা করাতে বাইরে না নিয়ে যেতে পারে, সেজন্য গ্রাম থেকে বেরোনোররাস্তা পুলিশ এবং শাসক দল আশ্রিত সমাজবিরোধীরা অবরোধ করে রাখে। গ্রামবাসীরা অনেক ঘুরপথে দূরবর্তী মল্লারপুর হাসপাতালে আহতদের চিকিৎসা করাতে নিয়ে যেতে বাধ্য হন।
সভা অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে বলতে চায়, মুখে গণতন্ত্র, গণতান্ত্রিক উপায় ইত্যাদি গালভরা কথা বলে পূর্বের সরকারের মতোই এই সরকারও স্বৈরাচারী ভূমিকা গ্রহণ করছে। ডেউচা-পাঁচামি এলাকাতে জমি অধিগ্রহণ করার ক্ষেত্রে সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম-লালগড়ের ছায়া দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। শাসক বদলালেও দৃষ্টিভঙ্গি এবং কর্মপন্থার পরিবর্তন যে আদৌ ঘটেনি তা আবারও প্রমাণ হচ্ছে। মানুষকে বোঝানোর ঘোষণা বাস্তবে বর্তমানে প্রহসনে পর্যবসিত হয়েছে। সরকার কাজ হাসিল করার জন্য এলাকার মানুষকে লাঠি দিয়ে বোঝানোর ঘৃণিত পথ নিয়েছে। নাগরিক সভা নিরীহ গ্রামবাসীদের উপর পুলিশ এবং দলীয় সমাজবিরোধীদের নির্বিচার এই আক্রমণের তীব্র নিন্দা করছে। এই সভা দৃঢ় অভিমত ব্যক্ত করে বলতে চায়, জনগণের ন্যায়সঙ্গত দাবিতে যেকোনও আন্দোলন– তা দিল্লির উপকণ্ঠে দীর্ঘ এক বছর ধরে চলা কৃষক আন্দোলন হোক, কিংবা সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের আন্দোলনই হোক– শাসকের ভূমিকা একই এবং তা হল জোর-জবরদস্তি, আক্রমণ, নির্বিচারে অত্যাচার।
সভা দাবি জানায়, দেওয়ানগঞ্জে নিরীহ গ্রামবাসী মহিলাদের ওপর বর্বরোচিত হামলায় জড়িত পুলিশ এবং সমাজবিরোধীদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমুলক ব্যবস্থা, আহতদের চিকিৎসার পরিপূর্ণ দায়িত্ব সরকার এবং তার প্রশাসনকে নিতে হবে। কয়লা খনির যে কোনও কাজ এখন বন্ধ করে সামগ্রিক বিষয়গুলি শুধু পছন্দমতো ব্যক্তিবিশেষের কাছে নয়, জনগণের কাছে প্রকাশ্যে রাখতে হবে, প্রস্তাবিত কয়লা খনির ডিপিআর, স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, পরিবেশবিদ, ভূ-বিজ্ঞানী, খনি বিশেষজ্ঞদের মতামত জনসাধারণের কাছে শ্বেতপত্র আকারে উপস্থিত করতে হবে, এলাকাবাসী এবং জনসাধারণের জীবন জীবিকা সম্পর্কে আবেগ ও উদ্বেগকে যে কোনও ধরনের আঘাত করে জোর করে জমি দখল করে, হাজার হাজার মানুষকে উচ্ছেদ করে খনি প্রকল্প চালু করা চলবে না।
এলাকাবাসী এবং জনগণের কাছে এই সভা আহ্বান করছে, দাবি আদায়ে ঐক্যবদ্ধ সংগঠিত প্রতিবাদ প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তুলুন। সংগঠিত জনগণের প্রতিরোধ আন্দোলন যে কতটা শক্তিশালী হতে পারে তা ইতিহাস বারেবারে প্রমাণ করেছে। যত বড় স্বৈরাচারী শাসকই হোক, তার উদ্ধত মাথা যে নত করে দিতে পারে একমাত্র দীর্ঘস্থায়ী গণআন্দোলন– দিল্লির সফল কৃষক আন্দোলন তা আবারও প্রমাণ করল। এই আন্দোলন থেকে শিক্ষা নিয়ে ডেউচা-পাঁচামি এলাকা সহ বৃহত্তর ক্ষেত্রে জনস্বার্থে অত্যন্ত ন্যায়সঙ্গত দাবির ভিত্তিতে অবিচল দীর্ঘস্থায়ী আন্দোলন গড়ে তুলে সরকারের উপর চাপ সৃষ্টির জন্য নাগরিক সভা সকলের কাছে আহ্বান করছে।
এই প্রস্তাবকে উপস্থিত নাগরিকরা সর্বান্তকরণে সমর্থন করেন। এই আন্দোলন সঠিক পথে পরিচালনার জন্য একটি নাগরিক কমিটি গঠিত হয়।