২৪ মার্চ পাঞ্জাবের মানসায় সিপিআই (এম–এল) লিবারেশন–এর দশম পার্টি কংগ্রেসের প্রকাশ্য অধিবেশনে আমন্ত্রিত এসইউসিআই (সি)–র কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য কমরেড সত্যবান নিম্নের ভাষণটি রাখেন৷
সিপিআই (এম–এল) লিবারেশনের দশম পার্টি কংগ্রেসের প্রকাশ্য অধিবেশনে আজ আমি এসইউসিআই (কমিউনিস্ট)–এর কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষ থেকে আপনাদের বিপ্লবী অভিনন্দন জানাচ্ছি৷ আপনাদের এই পার্টি কংগ্রেস এমন একটা সময়ে অনুষ্ঠিত হচ্ছে যখন এই দেশের এবং গোটা বিশ্বের পরিস্থিতি অত্যন্ত সঙ্কটে৷ সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলি গোটা বিশ্ব জুড়ে একের পর এক ধ্বংসলীলা চালাচ্ছে৷ আমেরিকা সহ এইসব সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলির সঙ্গে ভারতীয় পুঁজিপতিরা অত্যন্ত খোলাখুলি বিপজ্জনকভাবে হাত মিলিয়ে চলছে৷
আপনারা জানেন, ভারতীয় পুঁজিপতিরা সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলির সঙ্গে একযোগে বিশ্বায়নের নীতি চালু করে বিদ্যমান অর্থনৈতিক সঙ্কট সমাধানের যে কথা ঘোষণা করেছিল, তা ব্যর্থ হয়েছে৷ চীন ও রাশিয়ার নবগঠিত সাম্রাজ্যবাদী জোটের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে আমেরিকা জাপান, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ার সাম্রাজ্যবাদী জোটের সঙ্গে ভারত সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করছে৷ দেশের ভিতরেও মেহনতি জনতার শেষ রক্তবিন্দুটুকুও শোষণ করে তাদের প্রাণের বিনিময়ে ভারত রাষ্ট্র নিজের পুঁজিবাদী অর্থনীতিকে অতি দ্রুত আরও শক্তিশালী করে তুলছে৷ শুধু যে খেটে–খাওয়া মানুষকে ব্যাপক শোষণ ও নিপীড়ন করা হচ্ছে তাই নয়, তাদের মধ্যেকার ঐক্য ধ্বংস করতে সমাজের নানা সামাজিক ও ধর্মীয় অংশগুলিকে একে অপরের বিরুদ্ধে উস্কানি দিয়ে শত্রুতা এবং ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গা–হাঙ্গামা ও সংঘর্ষ সৃষ্টি করা হচ্ছে৷ এ হল এক ফ্যাসিবাদী কৌশল এবং আমাদের অবশ্যই এ বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে৷
বর্তমানে গোটা বিশ্ব জুড়ে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা আরও বেশি বেশি করে ফ্যাসিবাদের আশ্রয় নিচ্ছে৷ শুধু নগ্ন সামরিক একনায়কতন্ত্র বা স্বৈরাচারী শাসনের রূপে নয়, সংসদীয় কাঠামোর মধ্যে একদলীয় বা দ্বিদলীয় শাসনের আড়ালেও ফ্যাসিবাদ আজ প্রতিটি পুঁজিবাদী দেশের বৈশিষ্ট্য৷ আপনারা লক্ষ করছেন যে ভারতে মুষ্টিমেয় বহুজাতিক ও একচেটিয়া ব্যবসায়ীদের হাতে গোটা অর্থনীতি কুক্ষিগত৷ কেন্দ্রীভূত প্রশাসন সর্বত্রই উচ্চতম আমলাদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে৷ বিচারবিভাগকেও নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে৷ সংস্কৃতির ক্ষেত্রেই আক্রমণ সবচেয়ে মারাত্মক৷ বিজ্ঞান ও ইতিহাস বিকৃত করে অন্ধ ভক্তি ও উগ্র জাতিবিদ্বেষের সংস্কৃতি গড়ে তোলার চেষ্টা হচ্ছে৷
প্রায় প্রতিটি দেশেরই একই চিত্র৷ বহু দিন আগেই মহান লেনিন ও স্ট্যালিন এ বিষয়ে আমাদের সতর্ক করেছেন৷ তাঁদের শিক্ষা রয়েছে আমাদের কাছে৷ আমরা নিজেরা দীর্ঘদিন ধরেই বুঝতে পারছি যে পুঁজিবাদ আজ আর গণতন্ত্র বা ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাস করে না৷ আমলাতন্ত্র ও সামরিকতন্ত্রের উপর তার প্রধানত নির্ভরশীলতা৷ পুঁজিবাদী রাষ্ট্র ক্রমেই বহুজাতিক ও একচেটিয়া পুঁজির আরও বেশি দাসানুদাস হয়ে পড়ছে৷ কংগ্রেসের আমল থেকেই এর শুরু৷ প্রথম থেকে তারা এ বিষয়ে জোর দিয়েছিল৷ এখন বিজেপি নগ্নভাবে সেই একই পথ ধরেছে৷ এর প্রতিরোধ করতে হবে আমাদের৷ নির্বাচনী জোট করে বা নির্বাচনী লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে একে প্রতিরোধ করা যাবে না৷ ধারাবাহিক বামপন্থী গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও বিপ্লবী আন্দোলনের মাধ্যমেই একে প্রতিরোধ করা সম্ভব৷
দেশে নানা স্বতঃস্ফূর্ত বিক্ষোভ আন্দোলন সংঘটিত হয়ে চলেছে৷ কিন্তু আজ প্রয়োজন সঠিক নেতৃত্বে সুসমন্বিত, সুসংগঠিত আন্দোলন৷ বামপন্থীরা ছাড়া অন্য কোনও শক্তি এটা গড়ে তুলতে পারে না৷ এটাই আজ সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন৷ বামপন্থী আন্দোলনের এই ঢেউ গোটা দেশে মানুষের ঐক্য রক্ষা করবে৷ শ্রমিক, কৃষক, শোষিত–নিপীড়িত মানুষের অধিকার যা বর্তমানেনির্মম আক্রমণের মুখে পড়ছে, বামপন্থী আন্দোলনের তরঙ্গই তাকে রক্ষা করতে পারে৷ মুক্তির স্বপ্ণ, ভগৎ সিং সহ স্বাধীনতা আন্দোলনের বীর শহিদদের স্বপ্ণ বুকে নিয়ে যে দিনটির জন্য আমরা রক্তপতাকা হাতে অপেক্ষা করছি, সেই দিন নিশ্চয়ই আসবে৷ দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও আমাদের কত সাথী প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন৷ তাঁদের আত্মবলিদানের মর্যাদা রক্ষা করতে এ ছাড়া অন্য পথ নেই৷ ফলে বাম ঐক্যের লক্ষ্যে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে এবং আমাদের বিশ্বাস সিপিআই (এম–এল)–লিবারেশনের এই দশম পার্টি কংগ্রেস সেই লক্ষ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে৷
(৭০ বর্ষ ৩৫ সংখ্যা ২০ এপ্রিল, ২০১৮)