গোয়ায় অনুষ্ঠিত, ভারতের ৫৩তম আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের মঞ্চে জুরি বোর্ডের চেয়ারম্যান নাদাভ লাপিড ঠিক কী বলেছিলেন? বলেছিলেন, ‘কাশ্মীর ফাইলস’ ছবিটি তাঁদের ‘জুরি সদস্যদের’ মনে হয়েছে কদর্য, প্রচারমূলক এবং এ রকম একটি মর্যাদাপূর্ণ উৎসবের শৈল্পিক প্রতিযোগিতায় স্থান পাওয়ার পক্ষে বেমানান। তিনি এ-ও বলেছিলেন, এই মঞ্চে খোলাখুলি নিজের অনুভূতি তিনি নির্দ্বিধায় প্রকাশ করছেন, কারণ তাঁর ধারণা, এ রকম একটি চলচ্চিত্র উৎসব সমালোচনাকেও খোলামনে গ্রহণ করতে পারে, শিল্পে এবং জীবনে সমালোচনা জিনিসটা অত্যাবশ্যক। নাদাভ লাপিডের মন্তব্য, উৎসবের আয়োজক এবং ছবি নির্বাচক সংস্থা ভারত সরকারের তথ্য-সম্প্রচার মন্ত্রকের অধীনস্থ ন্যাশনাল ফিল্ম ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশনের় ভাল লাগার কথা নয়। চলচ্চিত্র বিশেষজ্ঞ হিসাবে যাঁদের উৎসবে ডাকাই হয়েছে ছবির গুণাগুণ বিচার করে মত দেওয়ার জন্য তাঁরা নিদ্বির্ধায় সেই মত দেবেন এটাই স্বাভাবিক। এটাই জুরিদের কাজ। লাপিড সেটাই করেছেন। কিন্তু খোলামেলা সমালোচনা গ্রহণ বিজেপি রাজত্বে যে একেবারে নিষেধ, সেটা লাপিডের জানা ছিল না।
বাস্তবে কী ঘটল? ওই ছবির পরিচালক, এক মুখ্য অভিনেতা সহ বিজেপি শিবিরের লোকজন লাপিডের মন্তব্য নিয়ে খড়গহস্ত হয়ে উঠলেন। তাঁর ফোনে, মেলবে’, সোশাল মিডিয়ায় বিদ্বেষপূর্ণ মেসেজ এবং ব্যক্তি-আক্রমণের ফোয়ারা ছুটল। অর্থাৎ, একজন বিশিষ্ট চলচ্চিত্রকার, যিনি ‘গণতান্ত্রিক’ ভারতের চলচ্চিত্র উৎসবে আমন্ত্রিত অতিথি এবং বিচারক হয়ে অন্য দেশ থেকে এসেছেন, তিনি বুঝে গেলেন এই ভারতে খোলামনে মত প্রকাশ বিপজ্জনক। এবং আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র মহলেও বার্তা গেল, এ দেশে শাসকের মতই শেষ কথা। শিল্পবোদ্ধা সমালোচকেদের কর্তব্য হল সরকারের তালে তাল দেওয়া।
নরেন্দ্র মোদি থেকে শুরু করে আরএসএস-বিজেপি শিবিরের মাথারাও ভালোমতোই জানেন, যতই তারা ইতিহাস খুঁড়ে সত্য বের করার কথা বা কাশ্মিরী পণ্ডিতদের সুবিচার দেওয়ার কথা বলুন, বাস্তবে ‘দ্য কাশ্মীর ফাইল’ ছবিটি নির্মাণের পিছনে উদ্দেশ্য ছিল সম্পূর্ণ অন্য। এ ছবি ইতিহাসকে তুলে ধরেনি, ইতিহাস এবং ঘটনাকে বিকৃত করেছে। কাশ্মীর উপত্যকার দীর্ঘ বছরের সমন্বয়ী সংস্কৃতি ‘কাশ্মীরিয়ৎ’কে সম্পূর্ণ অস্বীকার করেছ়ে। কাশ্মীরে উগ্রপন্থীদের আক্রমণে অসংখ্য মুসলমান নাগরিকের মৃত্যুর উল্লেখমাত্র করেনি। মিলিটারির বুটের তলায় পিষ্ট কাশ্মীরের সাধারণ মানুষের জীবনযন্ত্রণাকে আড়াল করেছে। শুধু তাই নয়, পণ্ডিতদের ঘটনার পিছনে তৎকালীন সরকারের ভূমিকা এবং অপদার্থতা এড়িয়ে গিয়ে এই ছবি শুধুমাত্র সাম্প্রদায়িক হিংসা উস্কে দিতে চেয়েছে, প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছে মুসলমান মাত্রই বর্বর এবং সন্ত্রাসবাদী,পণ্ডিত বিতাড়নের জন্য সন্ত্রাসবাদীরা নয়, কাশ্মীরের মুসলমান ধর্মাবলম্বী সাধারণ মানুষও দায়ী।
বিবেক অগ্নিহোত্রীর কাশ্মীর ফাইলস যে কাশ্মীরী পণ্ডিতদের তুরুপের তাস করে মুসলিম-বিদ্বেষ প্রচারের একটি হাতিয়ার হয়ে উঠতে চেয়েছে এবং শিল্পগুণবিবর্জিত মোটা দাগের এই ছবিটি স্রেফ রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির জন্য আন্তর্জাতিক উৎসবের মঞ্চে তুলে আনা হয়েছে, এ কথা বুঝতে লাপিড সহ বিচক্ষণ চলচ্চিত্রকারদের অসুবিধা হয়নি। সমালোচনার উত্তরে লাপিড নিজের বক্তব্যে অনড় থেকে বলেছেন, ‘আমাদের সকলেরই ছবিটি দেখে মনে হয়েছে, সেখানে ধারাবাহিক ভাবে ঘটনা অতিরঞ্জিত করা হয়েছে, অশ্লীল এবং হিংসাত্মক বিষয় অপ্রাসঙ্গিক ভাবে টেনে আনা হয়েছে। হিংসার বীজ বপন করার উদ্দেশ্যেই এমনটা করা হয়েছে বলে মনে হয়েছে আমাদের সকলের।” জুরি বোর্ডের আরও তিন সদস্য এই বক্তব্যকে সমর্থন করেছেন। লাপিড এ-ও বলেছেন, ছবিটির মধ্যে তিনি সরকারের কাশ্মীর নীতির প্রতি সমর্থন এবং ফ্যাসিবাদের চরিত্রলক্ষণ খুঁজে পেয়েছেন। জুরিদের এই মত স্বাভাবিক ভাবেই বিজেপির নেতা-মন্ত্রীরা মানেননি। বিরোধিতা করতে তাঁরা স্বভাবসিদ্ধ চেনা ছকে মাঠে নেমেছেন। কেউ বলেছেন, লাপিড পণ্ডিতদের ইতিহাস না জেনেই সমালোচনা করছেন, কেউ পরোক্ষে লাপিডকে বিশ্বাসঘাতক বলে বসেছেন। যত বলেছেন, তত প্রকট হয়েছে বিজেপির অন্দরের মিথ্যাচার এবং স্ববিরোধিতা। যেমন, জম্মু-কাশ্মীরের বিজেপি মুখপাত্র রবীন্দ্র রায়না বলেছেন, লাপিডের উচিত উদ্বাস্তু পণ্ডিতদের ক্যাম্পগুলো ঘুরে তাঁদের দুর্দশা দেখে আসা। অর্থাৎ তাঁর কথা অনুযায়ী, কাশ্মীরী পণ্ডিতরা এখনও উদ্বাস্তু শিবিরে প্রবল কষ্টের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। কিন্তু প্রশ্ন হল, ঘটনার তিন দশক পরেও এখনও পণ্ডিতদের ক্যাম্পে দিন কাটাতে হচ্ছে কেন? বিগত সরকারগুলোর মতো পণ্ডিতদের ঘটনাকে ভোট বাে’র পুঁজি করা ছাড়া ‘হিন্দুত্বের মসিহা’ বিজেপি সরকার তাঁদের প্রতি কী দায়িত্ব পালন করেছে? যে তৎপরতায় কেন্দ্রীয় সরকার কাশ্মীর ফাইলস-এর প্রচার-বিজ্ঞাপন করেছে, বিগত আট বছরের বিজেপি জমানায় পণ্ডিতদের উপত্যকায় ফেরাবার ব্যাপারে সরকারের সেই তৎপরতার একাংশও দেখা গেল না কেন?
বাস্তব হল ১৯৯০ থেকে ২০২১ পর্যন্ত কাশ্মীরে ৮৯ জন হিন্দু পণ্ডিত খুন হয়েছিলেন। আর অ-হিন্দু খুন হয়েছেন ১৭২৪ জন। ৩৭০ ধারা রদের পর নতুন করে ১৯ জন পণ্ডিত খুন হয়েছেন। সন্ত্রাসবাদীদের হুমকির সামনে ৫৬টি পণ্ডিত পরিবারকে অন্যত্র যেতে হয়েছে। অর্থাৎ পণ্ডিতদের জন্য চোখের জল ফেলে প্রচার নিতে সরকার এবং বিজেপি যতটা তৎপর, তাঁদের সুরক্ষা দেওয়ার জন্য এদের মাথাব্যথা ততটাই কম।
সংখ্যাতত্ত্ব দেখাচ্ছে, সন্ত্রাসবাদের শিকার অহিন্দুরাও। যাদের হত্যার দায় সরকার এড়াতে পারে না। এই সত্য ঢাকতেই লাপিডকে আক্রমণ করে শোরগোল ফেলে দিয়েছে বিজেপি।
লাপিড কাশ্মীরের পণ্ডিততদের ঘটনাকে কোনও ভাবে অস্বীকার করেননি, তাদের দুঃখকেও ছোট করেননি। বস্তুত, ভারতের রাজনীতির সাথে, বিজেপির ভোটে জেতা বা না জেতার সাথে লাপিডের কোনও দেওয়া-নেওয়া নেই। তাঁর সমালোচনার লক্ষ্য কাশ্মীর ফাইলস ছবি। তিনি মনে করিয়ে দিয়েছেন, ইতিহাসের বিয়োগান্তক ঘটনা নিয়ে ‘সিরিয়াস’ ছবি হওয়া উচিত– এরকম স্থূল ঘৃণার বেসাতি নয়। লাপিড যা বলেছেন, ভারতে ছবিটি মুক্তি পাওয়ার পরে বহু মানুষ, চলচ্চিত্র বিশেষজ্ঞও সেগুলো বলেছিলেন। শিল্পী যদি ইতিহাসের ট্র্যাজেডিকে শিল্পে তুলে আনেন, তবে মানুষ বস্তুনিষ্ঠ পথেই শিল্পে সেই ট্র্যাজেডির কারণ খুঁজবে, মানুষে মানুষে বিদ্বেষের বিষ সরিয়ে সুস্থ সুন্দরকে দেখতে চাইবে। যে ছবি দেখে দর্শক একটি বিশেষ ধর্মের মানুষের বিরুদ্ধে হিংসাত্মক স্লোগান দিতে থাকে, সেটা আর যা-ই হোক, শিল্প নয়।
কাশ্মীরের পণ্ডিতদের সুবিচার দেওয়া বলতে যারা মুসলমান বিদ্বেষের ঢেউ তোলা বোঝেন, তারা স্বভাবতই বোঝেননি যে, ইহুদিবিদ্বেষের বিরোধিতা করা, ইহুদিনিধন যজ্ঞের নিন্দা করা মানেই ইহুদিবাদী ইজরায়েলি রাষ্ট্রকে সমর্থন করা নয়। সে জন্যই, লাপিডকে ইহুদি নিধন হলোকাস্টের সমর্থক বলে বিজেপি দাগিয়ে দিতে চেয়েছে।
ছবির গুণাগুণের তোয়াক্কা না করে সরকারের আশীর্বাদধন্য ছবিটি অনায়াসে ইফির মঞ্চ পর্যন্ত পৌঁছে গেয়েছিল, কিন্তু সেখানেই বিপত্তি ঘটল। আমন্ত্রণ করে আনা এই ইজরায়েলি পরিচালক, যিনি স্বীয় শিল্পক্ষেত্রেও নিজের দেশের সরকার এবং রাষ্ট্রে সমালোচনা করে থাকেন, কাশ্মীর ফাইলকে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করলেন। লক্ষণীয়, ভারতের ইজরায়েলি রাষ্ট্রদূত নায়োর গিলন, লাপিডের মন্তব্যের জন্য ক্ষমা চেয়ে বলেছেন, লাপিডের উচিত লজ্জিত হওয়া, অন্য দেশের মাটিতে অতিথি হয়ে গিয়ে তাঁর এই মন্তব্য ভারতে বসবাসকারী ইজরায়েলিদের অস্বস্তির কারণ হবে।
লাপিডের মন্তব্যের দায় কেন এবং কী ভাবে ইজরায়েলের মানুষের ওপর বর্তাবে, একটি ছবি সম্পর্কে নিজের মতামত জানাতে জুরি হিসাবে একজন চলচ্চিত্রকার কেন লজ্জিত হবেন, এর মধ্যে রাষ্ট্রদূত কেন হস্তক্ষেপ করবেন বা একটি ছবির বিশ্লেষণ কেন আন্তঃরাষ্ট্র্র সম্পর্কে প্রভাব ফেলবে, এ-সব প্রশ্নের কোনও উত্তর নাওর গিলোন বা নরেন্দ্র মোদিদের কাছে নেই। কারণ বাস্তবে দুই দেশের সাধারণ মানুষ নয়, অস্বস্তিতে পড়েছেন এবং পড়বেন দুই দেশের সরকার, মালিক পক্ষ। আজকের পুঁজিতান্ত্রিক দুনিয়ায় দুটো দেশের সম্পর্ক মানে দুই দেশের সরকার এবং তার রক্ষক মালিক শ্রেণির ব্যবসার সম্পর্ক, সাধারণ মানুষের শ্রমে গড়ে ওঠা সম্পদের পাহাড় লুটে কে কত মুনাফা করতে পারে তার প্রতিযোগিতা। তাই সেই সম্পর্কের কেন্দ্রে থাকে এক শতাংশ পুঁজিমালিকের স্বার্থ, নিরানব্বই শতাংশ জনগণের স্বার্থরক্ষা বা উন্নতি নয়। রাষ্ট্রপ্রধানরা মুখে যতই গণতন্তে্রর জয়গান করুন বা গণতন্তে্রর মন্দিরে মাথা ঠুকুন, বাস্তবে গণতন্ত্রকে গলা টিপে হত্যা করার ক্ষেত্রে হিন্দুত্ববাদী ভারত সরকার বা জিয়নবাদী সাম্রাজ্যবাদী ইজরায়েল উভয়েই পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী। সরকারি উৎসবে আমন্ত্রিত চলচ্চিত্রকার যতক্ষণ সরকারের সমর্থক, ততক্ষণই তিনি ‘স্বাধীন’। অন্যথায় তাঁর ব্যক্তিগত মতপ্রকাশের পরিসরে রাষ্ট্রীয় নজরদারি তো চালানোই যায়, ব্যক্তিগত আক্রমণ করা, একঘরে করে দেওয়াও ‘গণতান্ত্রিক’ রাষ্ট্রে অসমীচীন নয়।