হঠাৎই সিঙ্গুর আবার সংবাদপত্রে আলোচ্য বিষয় হয়ে উঠেছে। আলোচনার সূত্রপাত শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের একটি বক্তব্যকে কেন্দ্র করে। ২৬ জুলাই পিটিআইকে দেওয়া এক স্বাক্ষাৎকারে শিল্পমন্ত্রী বলেছেন, টাটা গোষ্ঠীর সঙ্গে তাঁদের কোনও বিরোধ নেই, সিঙ্গুর কাণ্ডের জন্য টাটাদের দায়ী করা চলে না। তিনি আরও বলেছেন, দোষ তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকারের, যারা গা-জোয়ারি করে কৃষকের জমি দখলে নেমেছিল।
এই সাক্ষাৎকারের পরই রাজ্যের একটি প্রথম সারির দৈনিক পত্রিকা সম্পাদকীয় লিখে কিছু প্রশ্ন তুলেছে। সম্পাদকীয়তে তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকার ও বিরোধী আন্দোলনকারী উভয়ের সমালোচনা করা হয়েছে। বামফ্রন্ট সরকার সম্পর্কে বলেছে, ‘আমরা ২৩৫ ওরা ৩০’ এর দম্ভে, রাষ্ট্রের দমন পীড়ন বাহিনীকে ব্যবহার করে কৃষকদের গণতান্ত্রিক প্রতিবাদকে দুরমুশ করে দিয়ে, স্বৈরশাসকের কায়দায় যেভাবে ১০০০ একর জমি দখল করা হয়েছে তা চূড়ান্ত নিন্দনীয়। সিঙ্গুর নিয়ে সিপিএমের অবস্থান যে ভুল ছিল, দলগতভাবে তা স্বীকার না করার ফলেই যে সিপিএমের ভোট ব্যাঙ্কের বিপুল ক্ষয়, সম্পাদকীয়তে তা উল্লেখ করা হয়েছে।
পাশাপাশি আন্দোলনকারীদের সম্পর্কে পত্রিকাটির অভিযোগ, সিঙ্গুর আন্দোলন যে সিপিএম সরকারের অগণতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে, রাজ্যে শিল্পায়নের বিরুদ্ধে নয়, তা স্পষ্ট করে বলা হয়নি। দ্বিতীয়ত, তারা জমি নিতে দেবেন না বলেছেন, জমি অধিগ্রহণের বিকল্প পন্থা বলেননি। পত্রিকাটির সুনির্দিষ্ট অভিযোগ, কোন পথে গেলে রাজ্যে সত্যিই শিল্পায়ন ঘটতে পারে, বিরোধী তৃণমূল কংগ্রেস সেই আলোচনায় শাসক পক্ষকে টানতে পারেনি।
এ রাজ্যের মানুষ জানেন, সিঙ্গুর আন্দোলনের সূচনাকারী এবং অন্যতম স্থপতি ছিল এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট)। অথচ সম্পাদকীয়তে তার কোনও উল্লেখ নেই। দ্বিতীয়ত, এই আন্দোলন যে আদৌ শিল্পায়নের বিরুদ্ধে নয়, তা গোটা সিঙ্গুর আন্দোলনের পর্ব জুড়ে এস ইউ সি আই (সি) দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বহুবার বলেছে এবং এ কথাও যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করে দেখিয়েছে, সিঙ্গুরে সিপিএম সরকার যা করছে তা আদৌ শিল্পায়ন নয়। শিল্পায়নের নামে বহুফসলি কৃষিজমি দখল করে রিয়েল এস্টেট কারবারই যে আসল উদ্দেশ্য তা বহু বার দলীয় মুখপত্র গণদাবীতে বলা হয়েছে। পাশাপাশি এও দেখানো হয়েছে, পুঁজিবাদী অর্থনীতির ভয়াবহ মন্দাজনিত পরিস্থিতিতে কেন শিল্পায়ন হতে পারে না। অর্থনীতিতে মন্দা মানে বাজার সঙ্কট, মানে লোকের ক্রয়ক্ষমতা তলানিতে। এই অবস্থায় শিল্প পণ্য কিনবে কে? দেশের ৮০ শতাংশ মানুষ গরিব নিম্নবিত্ত। অন্ন বস্ত্র শিক্ষা চিকিৎসা ইত্যাদি জীবনধারণের প্রাথমিক উপাদানগুলোজোগাড় করতেই তারা হিমসিম খাচ্ছে। এদের ধ্বংসপ্রাপ্ত ক্রয়ক্ষমতার উপর ভিত্তি করে কি কখনও শিল্পায়ন হতে পারে? হতে যে পারে না, আজ রাজ্যে রাজ্যে অসংখ্য বন্ধ কারখানা এবং শিল্প উৎপাদনের শোচনীয় হাল তারই সাক্ষ্য দেয়। পুঁজিবাদী আর্থিক নীতিতে সর্বোচ্চ মুনাফা অর্জনই উৎপাদনের লক্ষ্য। ফলে মুনাফা সর্বোচ্চ করতে সর্বোচ্চ শোষণ চলে। আর এটাই ডেকে আনে পুঁজিবাদের সঙ্কট, শিল্পের সঙ্কট। এই অবস্থায় শুধু শিল্পায়ন করব, এই প্রতিজ্ঞার দ্বারা শিল্প হতে পারে না। তাই আজ ভারতের কোনও রাজ্যেই শিল্পায়ন হচ্ছে না। একটা দুটো বিচ্ছিন্ন বিক্ষিপ্ত পুঁজিনির্ভর শিল্প এখানে সেখানে হতে পারে। এর বেশি নয়। শ্রমিক প্রধান শিল্প বন্ধ করে, যন্ত্র প্রধান শিল্প– সর্বোচ্চ মুনাফার অন্যতম শর্ত। তাই কারখানা হলেও কর্মসংস্থান হচ্ছে না। এই অবস্থায় শিল্পায়নের স্লোগান নিছক ভাঁওতা ছাড়া কিছু নয়। বাস্তবে বেকার সমস্যা সমাধানের জন্য শিল্পায়নের রুদ্ধ দরজা খুলে দিতে হলে পুঁজিবাদী অর্থনীতিকে পাল্টে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি প্রবর্তন করা জরুরি। এস ইউ সি আই (সি) ছাড়া এ কথাটা কোনও দলই বলেনি, বলছেও না। ফলে আন্দোলনকারী সকলকে এক বন্ধনীতে ফেলে যে অভিযোগ সম্পাদকীয়তে করা হয়েছে তা ভিত্তিহীন।
প্রশ্ন হল, সিঙ্গুর আন্দোলনের ১২ বছর পর হঠাৎ শিল্পমন্ত্রী এই বিবৃতি দিলেন কেন? টাটাদের সাথে তাদের অর্থাৎ তৃণমূলের কোনও বিরোধ নেই একথা ঘটা করে বলার হেতু কী? হেতু স্পষ্ট, তা হল একচেটিয়া পুঁজিগোষ্ঠী টাটাদের এই বার্তা দেওয়া যে, আমরা তোমাদেরই লোক। তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী যে উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, ‘টাটার কেশাগ্রও স্পর্শ করতে দেব না’, বর্তমান শিল্পমন্ত্রীর বক্তব্যের উদ্দেশ্যও ঠিক তাই। অর্থাৎ চাই পুঁজিপতিদের ব্যাকিং।
সিপিএম নেতা জ্যোতি বসুর মতোই প্রায় প্রতি বছর শিল্প সম্মেলন করে শিল্পপতি ধরে আনার জন্য মুখ্যমন্ত্রী সিঙ্গাপুর থেকে লন্ডন ছুটলেও এবং বহু লক্ষ কোটি টাকা বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি এলেও বাস্তবে সিপিএম আমল থেকেই উল্লেখ করার মতো কোনও শিল্প পশ্চিমবঙ্গে হয়নি। এদিকে বেকার সমস্যা তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। এক সময় তেলেভাজা শিল্প, মুড়িভাজা শিল্প—- এসব বলে তৃণমূল সরকার জনমানসে প্রবল সমালোচিত হয়েছে। সিপিএম, বিজেপি পুঁজিবাদের প্রকৃত সংকটকে আড়াল করে সিঙ্গুর নিয়ে চোখের জল ফেলে। একদল শিক্ষিত মানুষও এই সিঙ্গুর প্রশ্নে সাময়িকভাবে বিহ্বল হয়ে পড়েন। যুক্তি দিয়ে তারা বিচার করে দেখেন না, গুজরাটের সানন্দে আঁতুড়ঘরেই ন্যানোর ইন্তেকাল ঘটল কেন? সেখানে তো আন্দোলন হয়নি। আসলে ন্যানোর মৃত্যু ঘটেছে বাজার সঙ্কটের অনিরসনীয় রোগে। সিঙ্গুরে ন্যানো হলে এইই ঘটত।
সিঙ্গুরে শিল্প হলে জমিদাতা পরিবার কি সত্যিই চাকরি পেত? পশ্চিম মেদিনীপুরের শালবনিতে যারা জমি দিয়েছেন, তারা কি সত্যিই চাকরি পেয়েছেন? এ বিষয়ে সিপিএম এর মুখপত্র ‘গণশক্তি’ ১ আগস্ট ২০২১ লিখেছে, এই কারখানায় ১২০০ জমিদাতা পরিবারের মাত্র ১৭৯ জনের কাজ জুটেছে। তার বেশিরভাগই ঠিকাদারের অধীনে। ৪২ জন সরাসরি কোম্পানির ব্যবস্থায় কাজ পেয়েছে। এখন জমিদাতা পরিবারের কর্মরত ৮৫ জনের কাজ ছাঁটাই করে দিয়ে বিহার ঝাড়খণ্ড থেকে কম বেতনের শ্রমিক এনে কাজ করানো হচ্ছে। সিঙ্গুরে ন্যানো হলে এটা যে ঘটত না তার গ্যারান্টি কী? আগেই বলা হয়েছে, পুঁজিবাদী অর্থনীতির মূল লক্ষ্য সর্বোচ্চ মুনাফা অর্জন। তা নিশ্চিত করতে শ্রমিকের পরিবর্তে যন্ত্রের ব্যবহার, স্থায়ী শ্রমিকের পরিবর্তে ঠিকা শ্রমিক নিয়োগ, মজুরি কম দেওয়া, বেশি সময় খাটানো ইত্যাদি শ্রমিক বিরোধী নীতি ভারত সহ সব পুঁজিবাদী দেশেই চলছে। সিঙ্গুরে ন্যানো হলে শালবনির ছায়াই পড়ত।
সিঙ্গুরে আন্দোলনকারীরা– বিশেষ করে এস ইউ সি আই (সি) বিকল্প জমির কথা বলেনি, এটাও মিথ্যাচার। এস ইউ সি আই (সি) বলেছিল, সিঙ্গুরের তিন ফসলি জমিতে নয়, শিল্প সম্ভব হলে করা হোক পুরুলিয়া বাঁকুড়ার অনুর্বর জমিতে, জঙ্গলমহলের এক ফসলি জমিতে, অথবা ৫৬ হাজার বন্ধ কারখানার জমিতে বা এস ই জেড এর জন্য অধিগৃহীত জমিতে। কিন্তু তৎকালীন সিপিএম সরকার এসব প্রস্তাবে কান দেয়নি। বিজেপির ‘মন্দির ওহি বানায়েঙ্গের’ মতো সিঙ্গুরের ওই জমিতেই শিল্প হবে– এই অনড় মনোভাবই পরিস্থিতিকে জটিল করেছে। শেষ পর্যন্ত রাজ্যপালের মধ্যস্থতায় স্থির হয়, এক হাজার একর নয়, ৪০০ একর জমিতে শিল্প হবে। আন্দোলনকারীরা তা মেনেও নেয়। এই রাজভবন চুক্তির পর বেশি লোভনীয় অফার পেয়ে হঠাৎ টাটারা সিঙ্গুর ছেড়ে গুজরাটের সানন্দে যাওয়ার কথা ঘোষণা করে। ফলে তাদের চলে যাওয়ার দায় আন্দোলনকারীদের উপর বর্তায় কী করে?