স্বাধীনতা পরবর্তী ভারতে গণআন্দোলনের ইতিহাসে ‘সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামে’ কৃষকদের বীরত্বপূর্ণ লড়াই এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা। বামপন্থার ভেকধারী শাসকের অনাচারের বিরুদ্ধে সেদিন কৃষক সহ সাধারণ মানুষ যে ভাবে চোখে চোখ রেখে গর্জে উঠেছিলেন তা গোটা দেশের জনসাধারণের মনে প্রেরণার সঞ্চার করেছিল। সম্প্রতি ‘সিঙ্গুরঃ এক লড়াইয়ের ইতিহাস’ শীর্ষক বইটি প্রকাশিত হল। লেখিকা অমিতা বাগ ওই আন্দোলনে অন্যতম সংগঠকের ভূমিকা পালন করেছিলেন। বিশিষ্ট চিকিৎসক ডাঃ বিপ্লব চন্দ্র ‘প্রকাশকের কথায় লিখেছেন, ‘‘লেখিকা …সিঙ্গুরের জমি রক্ষার লড়াইয়ে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত ছিলেন। তিনি দেখেছেন, আন্দোলনের সূচনা পর্ব থেকে এই আন্দোলনের বিভিন্ন মোড় ও গতিপথ।”
এই আন্দোলন যখন চলছিল আমরা তখন কৈশোর পেরিয়ে যৌবনের দ্বারে পা রাখছি। এর ঘটনাবলি মনে যে গভীর রেখাপাত করছিল তা বলাই বাহুল্য। আজ দীর্ঘ ১৬ বছর পর যখন এই বই পাঠ করছি, প্রতিটি পাতার অক্ষরগুলো কেমন যেন জীবন্ত ছবি হয়ে চোখের সামনে ফুটে উঠছে।
সিঙ্গুর আন্দোলন আমাদের রাজ্যে বহু প্রশ্ন উত্থাপন করেছিল। শিল্প না কৃষি, বেকারদের কর্মসংস্থান কী ভাবে হবে, শিল্পের জন্যে বৃহৎ পুঁজির মালিকের ইচ্ছাই কি প্রাধান্য পাবে– ইত্যাদি নানা প্রশ্ন জনমানসে দেখা দিয়েছিল। লেখিকা এই বইতে চেষ্টা করেছেন সেই সব প্রশ্ন এবং আন্দোলনই কী ভাবে তার উত্তর যুগিয়েছিল তা তুলে ধরতে। পুলিশ যখন কৃষক রমণীর চুলের মুঠি ধরে টানতে টানতে নিয়ে যাচ্ছে তৎকালীন শাসকদল সিপিএমের মুখ্যমন্ত্রী ক্ষমতার মদমত্ততায় বলেছিলেন, ‘টাটার কেশাগ্র স্পর্শ করতে দেব না।’ সেদিন সিপিএম গোটা রাজ্য জুড়ে প্রচার করেছিল যে, সিঙ্গুরে টাটার ন্যানো গাড়ির কারখানা স্থাপন হলেই লক্ষ লক্ষ কর্মসংস্থান হয়ে পশ্চিমবঙ্গের বেকার সমস্যার সমাধান হবে। কিন্তু আন্দোলনের মধ্য থেকে উঠে আসা ক্ষুরধার যুক্তি শাসকের অসার প্রচারের ফানুসটা ফাঁসিয়ে দিয়েছিল অচিরেই। মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য শাসকের কোনও কৌশলই কার্যকর হয়নি। একচেটিয়া পুঁজিমালিকের সেবায় মরিয়া শাসকের অত্যাচার মোকাবিলা করতে গণআন্দোলনের অগ্নিশিখায় তপ্ত সাধারণ মানুষ কী সাহসের পরিচয় দিয়েছিলেন, লেখিকা খুব সুন্দরভাবে তা তুলে ধরেছেন।
আরেকটি বিতর্কও সিঙ্গুর আন্দোলনকে ঘিরে চলে, এই আন্দোলনের সূচনা কে করেছিল? এই বিতর্কটা আরও বেশি প্রকট হয় যখন বর্তমান পশ্চিমবঙ্গ সরকার স্কুলের পাঠ্য বইয়ে ‘সিঙ্গুর আন্দোলন’কে অন্তর্ভুক্ত করে তার যাবতীয় কৃতিত্ব মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দে্যাপাধ্যায়কে অর্পণ করে। সরকারি বইয়ে লেখা হয়, ‘১৮ জুলাই ২০০৬ ধানের চারা পুঁতে সিঙ্গুরে আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন জননেত্রী মমতা বন্দে্যাপাধ্যায়’! এই প্রশ্নের স্পষ্ট উত্তর দিয়েছেন লেখিকা। তিনি লিখছেন, ‘‘…প্রকৃত সত্য হল, বাজেমেলিয়ার নিউ উজ্জ্বল সংঘ ক্লাবের সামনে টাটার পরিদর্শক টিমের গাড়ি ঘিরে ২৫ মে, ২০০৬ প্রথম বিক্ষোভ হয়েছিল। এই বিক্ষোভে কোনও দল বা সংগঠন নেতৃত্ব দেয়নি। সিঙ্গুরের সাধারণ মানুষ কৃষক-খেতমজুর-ভাগচাষি এবং তাদের পরিবারের মা-বোনেরা সেদিন বিক্ষোভে সামিল হয়েছিলেন। এর আগে ২০-২১ মে, ২০০৬ হাতে লেখা পোস্টারে প্রতিবাদ জানিয়ে বলা হয়েছিল, ‘উর্বর কৃষিজমিতে টাটার কারখানা হতে দিচ্ছি না’, যা গ্রামের দেওয়ালে দেওয়ালে এস ইউ সি আই (সি) দলের স্থানীয় কর্মীরা লাগিয়েছিলেন।” আন্দোলনের দুইপর্যায়ে তৃণমূল কংগ্রেস সহ অন্যান্য দলের ভূমিকা এবং আন্দোলনের গতিধারা অক্ষুণ্ন রাখতে নানা সময়ে এস ইউ সি আই (সি) দলের ভূমিকা কী ছিল, তা স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছেন লেখিকা।
কোনও উল্লেখযোগ্য আন্দোলন সম্পর্কে রচিত বইয়ে লেখক বা লেখিকার নিজস্ব মতামত, বিশ্বাস ও উপলব্ধি প্রতিফলিত হবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা, সেই বইয়ে দেওয়া তথ্য, বক্তব্য, মন্তব্য সত্যনিষ্ঠ এবং ইতিহাসসম্মত কি না! সেই বিচারে বইটি সসম্মানে উত্তীর্ণ হয়েছে। বইয়ের ভিতর প্রতিটি ঘটনাবলির প্রেক্ষিতে নিজস্ব মন্তব্য ছাড়াও, আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দলের নেতাদের মন্তব্য, তৎকালীন সরকারের মন্ত্রীদের মন্তব্য, তৎকালীন শাসকদলের অবস্থান এবং আন্দোলন সম্পর্কে তাদের প্রকাশনা, বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবর, ২০১১-র পর পরিবর্তিত সরকারের সিঙ্গুর সম্পর্কে অবস্থান, জমি অধিগ্রহণ সম্পর্কিত সুপ্রিম কোর্টের মামলা এবং তার রায় ইত্যাদি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে লেখিকা তাঁর বইয়ে যুক্ত করেছেন। আন্দোলন সম্পর্কিত নানা রঙিন ছবিও বইটিতে যুক্ত করা হয়েছে।
সভ্যতার যাবতীয় ইতিহাসটাই হল সংগ্রামের ইতিহাস। সিঙ্গুরের জমি রক্ষার লড়াইয়ে মানুষ যেভাবে অত্যাচারী শাসকের চোখে চোখ রেখে লড়াই করেছেন, জীবন কুরবানি দিয়েছেন তা সকল সংগ্রামী মানুষের কাছে প্রেরণার। বিশেষ করে শহিদ রাজকুমার ভুল এবং শহিদ তাপসী মালিকের আত্মবলিদান এই আন্দোলনের ইতিহাসে স্বর্ণোজ্জ্বল দুটি নাম। এই বই সেই সকল শহিদের নাম শ্রদ্ধার সাথেই স্মরণ করেছে। লেখিকা নিজে কৃষক পরিবারের সন্তান হওয়ায় কৃষকদের জানকবুল এই লড়াইতে নিজেকে সামিল করে আন্দোলনকারীদের অবদান ঘনিষ্ঠভাবে প্রত্যক্ষ করেছেন এবং তাঁদের প্রত্যেকের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এই লড়াই লড়েছেন। ফলে তাঁর অভিজ্ঞতাকে যখন তিনি অক্ষরের মালায় গেঁথেছেন, তা অত্যন্ত বিশ্বাসযোগ্য হয়ে পাঠকের মনকে যে নাড়া দেবে তা নিঃসন্দেহে বলা যায়। আশা করি, এই বই মানুষের কাছে পৌঁছে জীবনের লড়াইয়ের পাথেয় হিসাবে তাঁদের মনোবল জোগাবে।
শাসক কোনওদিনই শেষ কথা বলেনি, বলেছে জনগণ। বিশেষ করে উল্লেখ করা দরকার যে তৎকালীন শাসকদল সিপিএম যে অন্যায় করেছিল তার জন্য জনসমক্ষে ক্ষমা চাওয়া তো দূর, উল্টে সেই একই উদ্ধত মেজাজ এবং চূড়ান্ত অহমিকা নিয়ে নিজেদের কর্মকাণ্ডের পক্ষে অযৌক্তিক বক্তব্য রেখে চলে আজও। ভাবখানা এমন যে সেদিনের আন্দোলন সম্পূর্ণ ভুল এবং টাটার সিঙ্গুর ছেড়ে চলে যাওয়াটাই এ রাজ্যে শিল্পের দুরবস্থার জন্যে দায়ী! এর স্পষ্ট জবাব দিয়েছে এই বই।
আজ যখন দেশের বিভিন্ন প্রান্তে মানুষ নানা অনাচারের বিরুদ্ধে লড়ছেন, শাসকের জনবিরোধী নীতির বিরুদ্ধে লাগাতার আন্দোলন গড়ে তুলছেন, সর্বোপরি এই শোষণমূলক সমাজ ভাঙার লড়াইতে যাঁরা নিজেদের নিয়োজিত করেছেন, তাঁদের কাছে এই বই প্রেরণার উৎস হবে, এই আশা থাকছেই।
সৌপ্তিক পাল, পাইকপাড়া