বর্তমান সমাজ একটা প্রবাদবাক্য তোতাপাখির মতো আওড়ে সকলের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে– ‘চাচা আপন প্রাণ বাঁচা’, ‘আপনি বাঁচলে বাপের নাম’। কিন্তু সহকর্মীদের বিপদে নিজের প্রাণ দিয়ে এ সমস্তকেই নস্যাৎ করে দিল দরিদ্র পরিবারের যুবক সাহিন। বানতলা চর্মনগরীতে নিকাশি নালায় কাজ করতে গিয়ে দুর্ঘটনার কবলে পড়া সহকর্মীদের প্রাণ বাঁচাতে ছুটে গিয়েছিলেন ঠিকা শ্রমিক সাহিন। সহকর্মীদের ‘বাঁচাও বাঁচাও’ চিৎকার শুনে স্থির থাকতে পারেননি তিনি। অভুক্ত পরিবার, ভবিষ্যৎ-এর পিছুটান কোনও কিছুই আটকে রাখতে পার়েনি তাঁকে। কোনও নিরাপত্তা সরঞ্জাম ছাড়াই অন্ধকার গহ্বরে বিষাক্ত গ্যাসের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে তাদের উদ্ধার করেছে সে। কিন্তু দমবন্ধকর পরিবেশে বিষাক্ত গ্যাসের ছোবল থেকে নিজেকে বাঁচাতে পারেনি সাহিন। আটকে পড়ার দীর্ঘক্ষণ পর দমকল ও বিপর্যয় মোকাবিলা দপ্তর জেসিবি মেসিন দিয়ে পাইপ ভেঙে তার নিষ্প্রাণ দেহ উদ্ধার করে।
বানতলা চর্মনগরীতে নতুন জল পরিশোধন প্ল্যান্ট তৈরি করছে ক্যালকাটা মেট্রোপলিটন ডেভলপমেন্ট অথরিটি (কেএমডিএ)। তারা এই কাজের জন্য চুক্তির ভিত্তিতে শ্রমিক নিয়োগ করলেও তাদের নিরাপত্তা নিয়ে কোনও মাথাব্যথা নেই তাদের। তথাকথিত ‘উন্নয়নে’ শ্রমিকদের প্রাণ রক্ষার যে কোনও অ্যাজেন্ডা নেই– তা বানতলার ঘটনায় আরও একবার প্রকাশ্যে এল।
প্রয়োজনীয় সুরক্ষা ব্যবস্থা– মুখে অক্সিজেন মাস্ক, কোমরে সেফটি বেল্ট, চোখে ওয়াটারপ্রুফ চশমা, মাথায় আলোযুক্ত হেলমেট– পাইপে ঢুকে কাজ করা শ্রমিকদের জন্য কোনও কিছুরই ব্যবস্থা করেনি ঠিকাদার সংস্থা। মালিকরা জানে একেকটা দুর্ঘটনা ঘটে যাবার পর বিষয়টি নিয়ে একটু নাড়াচাড়া হবে, তারপর সব চাপা পড়ে যাবে। সরকারের জায়গা মতো নজরানা দিতে পারলেই সব ছাড়।
এর আগেও ম্যানহোল পরিষ্কার করতে গিয়ে বিষাক্ত গ্যাসে দম আটকে রাজ্যের নানা প্রান্তে শ্রমিক মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। সরকার বা প্রশাসনের কোনও হেলদোল দেখা যায়নি। কেন বারবার ‘সাহিন’দের মর্মান্তিক মৃত্যু বরণ করতে হয়? আর কিছুমাত্র দায়িত্ব পালন না করে, শ্রমিকদের নিরাপত্তার ন্যূনতম বন্দোবস্ত না করে কর্তৃপক্ষ ছাড় পেয়ে যায়? একের পর এক ঘটনা ঘটে চলে, দোষীদের শাস্তি তো হয়ই না, কয়েক দিন পর প্রচারের আলো সরে গেলে ধামাচাপা পড়ে যায় শ্রমিক মৃত্যুর মর্মস্পর্শী ঘটনাও। দিনের পর দিন সরকার ও প্রশাসনিক অবহেলার কারণে দীর্ঘ হয়ে চলে অসহায় শ্রমিকের মৃত্যু-তালিকা।
অবিলম্বে প্রশাসনের উচিত অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া এবং উপযুক্ত নিরাপত্তা ছাড়া কোনও শ্রমিককে ভূগর্ভে নামতে না দেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া। কিন্তু শুধু তাতেই এই মৃত্যু-মিছিল আটকানো যাবে না। দরকার সমাজ-মানসিকতা বদলের। মুনাফার লোভে ছুটে চলা এই পুঁজিবাদী সমাজে ক্ষমতাসীন সরকার, ক্ষমতাশালী দল এবং তাদের পেটোয়া কর্তাদের কল্যাণে শ্রমজীবী মানুষকে সম্পদ হিসাবে গণ্য করা হয় না, কিছু সংখ্যা হিসাবে দেখা হয়। সাহিনদের অকালে ঝরে যাওয়া তাদের কাছে একটা সংখ্যার বাড়া-কমা বৈ কিছু নয়। তাই বারবার এভাবেই মরতে হয় সাহিনদের। মানুষের ওপর মানুষের শোষণের ভিত্তিতে টিকে থাকা এই সমাজ নির্বাক হয়ে দেখতে থাকে সভ্যতার এই পিলসুজদের মর্মান্তিক মরণ।