ভারতে কৃষিসংকট, ক্ষুদ্রশিল্পের উপর আক্রমণ, দলিত ও সংখ্যালঘু নিগ্রহ ইত্যাদি সমস্যা নিরসনের লক্ষ্যে ভূমি অধিকার আন্দোলনের উদ্যোগে ২১ মার্চ দিল্লির কনস্টিটিউশন ক্লাবে এক গুরুত্বপূর্ণ কনভেনশন অনুষ্ঠিত হয়৷ সেখানে আমন্ত্রিত হয়ে বক্তব্য রাখেন এস ইউ সি আই (সি) পলিটব্যুরো সদস্য কমরেড অসিত ভট্টাচার্য৷ এই আন্দোলনের নেতা–কর্মীদের সম্বোধন করে কমরেড ভট্টাচার্য বলেন,
অতি গুরুত্বপূর্ণ এই সভা আয়োজন করার জন্য প্রথমেই আমি ভূমি অধিকার আন্দোলন কমিটির নেতা এবং সংগঠকদের আন্তরিক অভিনন্দন জানাই৷ কৃষক সমাজ যে সব জ্বলন্ত সমস্যায় জর্জরিত, তার সবগুলিই উত্থাপন করেছে ভূমি অধিকার আন্দোলন কমিটি, সেগুলি নিয়ে বিশদ আলোচনার দরকার নেই, কারণ আপনারা সেগুলি ভাল করেই জানেন৷ আমি এদেশের কৃষক সমাজের অন্য কতকগুলি গুরুত্বপূর্ণ দাবি আদায়ে আন্দোলনের পথ সম্পর্কে আমাদের দল এস ইউ সি আই (সি)–র দৃষ্টিভঙ্গি আপনাদের সামনে তুলে ধরতে চাই৷
প্রথমেই আমি যে বিষয়টি বলতে চাই তা হল, বর্তমান পরিস্থিতিতে গণতান্ত্রিক আন্দোলন পরিচালনা করতে হলে বিধানসভা ও সংসদের বাইরে সংগ্রাম চালানো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ৷ আমরা খুবই আনন্দিত যে এই আন্দোলন আপনারা সঠিক পথেই করে চলছেন৷ আমাদের দেশের মতো একটি পুঁজিবাদী দেশে জনগণের সংগ্রামই হল শেষ কথা৷ তাই সঠিক পথে কৃষক সমাজের আন্দোলন আজ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ৷ আমাদের দেশের জনসংখ্যার বেশিরভাগ অংশ, ৮০ শতাংশ বা তারও বেশি কৃষিকাজে যুক্ত৷ এবং এটাও বাস্তব সত্য যে, গ্রামগুলিতে তীব্র বৈষম্য বিরাজ করছে৷ যত দিন যাচ্ছে ধনী কৃষক আরও ধনী হচ্ছে এবং দরিদ্র চাষি দরিদ্রতর হচ্ছে, ঠিক যেমন গোটা দেশে প্রতি দিন, প্রতি মুহূর্তে ধনীরা আরও ধনী হচ্ছে এবং গরিবরা আরও গরিব হয়ে পড়ছে৷ আপনারা নিশ্চয় জানেন যে দরিদ্র ও প্রান্তিক কৃষকরা আজ ক্রমেই ভিখারিতে পরিণত হচ্ছে৷ দ্রুত তারা তাদের জমি হারাচ্ছে৷ এই ভূমিহীন চাষিরা গ্রামে বেঁচে থাকার কোনও উপায় খুঁজে না পেয়ে যে কোনও রকম কাজের তাগিদে শয়ে শয়ে হাজারে হাজারে শহর ও আধা–শহরগুলির দিকে ছুটে যাচ্ছে৷ কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই জীবিকার সন্ধান না পেয়ে তারা চরম দুর্দশাগ্রস্ত হয়ে পড়ছে, এমনকী অনেকের অকালে মৃত্যুও ঘটছে৷ এদের জীবনে কিছুটা সুরাহা আনার লক্ষ্যে এই জ্বলন্ত সমস্যা নিয়ে আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য কৃষক আন্দোলনের নেতা ও সংগঠকদের প্রতি আমরা ঐকান্তিক আবেদন জানাই৷
আমরা দেখছি লক্ষ লক্ষ গরিব চাষি তাদের জমি ধনী কৃষকদের হাতে তুলে দিতে বাধ্য হচ্ছে৷ আমি নিশ্চিত, এই বিষয়টিকে যে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়, সে ব্যাপারে আপনারা সকলেই একমত৷ সমাধানের জন্য উপযুক্ত পদক্ষেপ নিতে সরকারকে অবশ্যই বাধ্য করতে হবে৷ আমার মনে হয় আপনাদের নিশ্চয় এ বিষয়টিও জানা আছে যে, ঐক্যবদ্ধ ও শক্তিশালী কৃষক আন্দোলনের চাপে সার ও অন্যান্য কৃষি উপকরণের দামে এবং ব্যাঙ্ক ঋণ মকুবের ক্ষেত্রে যেটুকু সুবিধা আদায় করা গেছে, কেন্দ্রীয় সরকার ও রাজ্য সরকারগুলির পূর্ণ মদতে তার সুফল চলে যাচ্ছে কেবল ধনী কৃষকদের ও কর্পোরেটদের হাতে৷ আমরা দৃঢ় ভাবে বিশ্বাস করি, এই ষড়যন্ত্র বানচাল করতে, এই বিশ্বাসঘাতকতাকে পরাজিত করতে এবং দরিদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের আইনসঙ্গত অধিকারগুলিকে রক্ষা করতে শক্তিশালী ও ঐক্যবদ্ধ কৃষক আন্দোলন জরুরি প্রয়োজন৷ ঐক্যবদ্ধ কৃষক আন্দোলনকেই নিশ্চিত করতে হবে, ন্যূনতম সহায়ক মূল্য ও ঋণ মকুবের মতো যেসব দাবিগুলি সরকার মানতে বাধ্য হচ্ছে, তার সুফল যেন ধনী চাষিরা লুটে না নিতে পারে৷ এর জন্য দরকার শক্তিশালী আন্দোলন এবং গ্রাম স্তরে গণকমিটি গঠন৷ আমার মনে হয়, আপনারা এও লক্ষ করেছেন যে, শিক্ষায় দীক্ষায় আলোকপ্রাপ্ত মানুষজনের একটি বড় অংশও চাষিদের এই ভয়ঙ্কর দুরবস্থা সম্পর্কে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছেন৷ আমরা ভুলে যেতে পারি না যে, হাজার হাজার গরিব, সম্পূর্ণ রূপে বিপর্যস্ত কৃষক অন্য পথ খুঁজে না পেয়ে আত্মহত্যার পথ অবলম্বন করছে৷ আমরা মনে করি, সাহস ও দৃঢ়তার সঙ্গে আমাদের এই পরিস্থিতির মোকাবিলায় এগিয়ে এসে লাগাতার শক্তিশালী ও ব্যাপক গণসংগ্রাম গড়ে তোলা প্রয়েজন যাতে এই অসহনীয় অবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়ার কিছু কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে সরকার বাধ্য হয়৷
শুধু কৃষক সমাজ নয়, সমস্ত অংশের খেটে খাওয়া মানুষই আজ সম্পূর্ণ ধ্বংসের মুখে দাঁড়িয়ে এবং আমরা দেখছি, সমস্ত অংশের খেটে খাওয়া মানুষ, মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের কাছে বেঁচে থাকাই চরম দুরূহ হয়ে উঠছে৷ তাদের অস্তিত্বই আজ বিপন্ন হয়ে পড়ছে৷ বেকারত্ব, মূল্যবৃদ্ধি, দুর্নীতি ইত্যাদির মতো জ্বলন্ত সমস্যাগুলি কী তীব্র আকার নিয়েছে তা নিয়ে বিস্তৃত ব্যাখ্যায় আমি যাচ্ছি না, কারণ তা আপনাদের জানা৷ দরিদ্র কৃষকদের মতো শ্রমিক শ্রেণিও আজ সবচেয়ে দুর্দশাগ্রস্ত৷ যে বিষয়টিতে আমি জোর দিতে চাই তা হল, সমস্ত স্তরের নিপীড়িত মানুষকে যুক্ত করে সম্ভাব্য বৃহত্তম ঐক্য গড়ে তুলে একের পর এক শক্তিশালী গণতান্ত্রিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে আমাদের৷ এই কারণে দেশ জুড়ে এই ধরনের ঐক্যবদ্ধ ন্যায়সঙ্গত গণতান্ত্রিক আন্দোলনগুলি এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য উপযুক্ত রাজনৈতিক মঞ্চ গড়ে ওঠা প্রয়োজন৷ এটাই বর্তমান সময়ের জরুরি প্রয়োজন৷ আপনাদের ভেবে দেখার জন্য বলতে চাই, এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের যেমন সংসদীয় মঞ্চকে পূর্ণ রূপে ব্যবহার করতে হবে, তেমনই এক মুহূর্তের জন্যও ভুললে চলবে না যে সংসদের বাইরে শক্তিশালী গণআন্দোলন গড়ে তোলা এক্ষেত্রে অধিক গুরুত্বপূর্ণ৷ ঐতিহাসিক ভাবেই এ সত্য স্বীকৃত৷ আমাদের দৃঢ় অভিমত, আরএসএস–বিজেপির ঘৃণ্য সাম্প্রদায়িকতা, জঘন্য বিভেদ নীতি ও ফ্যাসিস্টসুলভ কার্যকলাপ প্রতিরোধ করতে জনগণকে যুক্ত করে ধারাবাহিক গণতান্ত্রিক আন্দোলন গড়ে তোলাই হল সবচেয়ে শক্তিশালী ও প্রধান হাতিয়ার৷ আইনসভার ভিতরে ও বাইরে আপসহীন সংগ্রাম গড়ে তোলার ঐতিহাসিক দায়িত্ব গ্রহণ করার এটাই উপযুক্ত সময়৷
পরিশেষে, গোটা দেশ জুড়ে শক্তিশালী কৃষক আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য নেতা ও সংগঠক সহ আপনাদের সকলকে আমি আবারও আন্তরিক অভিনন্দন জানাই৷ বাস্তবিকই, আপনাদের এই উদ্যোগ গোটা রাজনৈতিক পরিবেশকে প্রাণবন্ত করে তুলেছে৷ খেটে খাওয়া মানুষ আজ অত্যন্ত উৎসাহিত৷ শোষিত ও নিপীড়িত কৃষক সমাজের ন্যায়সঙ্গত দাবি আদায়ের এই সংগ্রামের প্রতি আমরা আমাদের দলের পক্ষ থেকে পূর্ণ সমর্থন ও সহযোগিতা জ্ঞাপন করছি৷
সংগ্রামী কৃষক সংগঠনগুলির ঐক্য জিন্দাবাদ
ভূমি অধিকার আন্দোলন জিন্দাবাদ
70 Year 34 Issue13 April, 2018