প্রধানমন্ত্রী ২৪ মার্চ সারা দেশে লকডাউন জারি করলে কী হবে, বস্তুত কাশ্মীর তো সেই গত বছরের আগস্ট মাস থেকেই ঘরবন্দি৷ তাদের জীবন ‘আনলক’ করার কোনও উদ্যোগ তো এতগুলি মাসেও সরকার নিল না৷ এই করোনা মহামারির আবহে একবার দেখা যাক কেমন আছে কাশ্মীর? তাদের জীবনের মূল্য কতটুকুই বা দিল কেন্দ্রীয় সরকার৷ বিশেষত রাজ্যের মর্যাদা হারানো কাশ্মীর তো এখন কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনেই৷
লকডাউন ঘোষণা করে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, প্রাণরক্ষা করাটাই এখন প্রধান কাজ৷ প্রাণে বাঁচলে আবার সব হবে৷ সারা দেশে তাঁরা কেমন প্রাণ বাঁচিয়েছেন তার জ্বলন্ত উদাহরণ হয়ে আছেন বেঘোরে প্রাণ হারানো শত শত পরিযায়ী শ্রমিক৷ আর তারই সাথে অবর্ণনীয় দুর্দশাগ্রস্ত শহর ও গ্রামের প্রায় ৮০ কোটি দরিদ্র মানুষ৷ কিন্তু আপাতত সে সব ছেডে এখন দেখা যাক শুধু কাশ্মীরকে৷
এ ক্ষেত্রে অবশ্য বিজেপি নেতারা বলতেই পারেন, অন্তত এই একটা পথে সারা দেশের সাথে কাশ্মীরকে এক করে দিতে পেরেছেন নরেন্দ্র মোদি৷ কাশ্মীরের মানুষের জীবনরক্ষার জন্য কী করেছে সরকার? সংবাদমাধ্যম জানাচ্ছে, ‘উপত্যকায় ৬৮ লক্ষ মানুষের জন্য বরাদ্দ মাত্র ২০০টি ভেন্টিলেটর, অথচ দশ জন নাগরিক পিছু মোতায়েন একজন সশস্ত্র আধা সেনা৷ ‘নতুন কোনও হাসপাতাল তৈরি, করোনা মোকাবিলার পরিকাঠামো গডে তোলা–এসব কাজে ‘সময় নষ্ট’ করেনি সরকার৷ দেশের কোথাও সাধারণ মানুষের জীবন রক্ষা সরকারের ধ্যান–জ্ঞান ছিল কি? সারা দেশেই সরকার লকডাউনের মধ্যে জীবন রক্ষার চেয়ে জোর দিয়েছে কীসে?
আকস্মিক লকডাউনে জনজীবনকে অচল করে দেওয়ায় সাধারণ মানুষ যখন চরম দুর্দশার মধ্যে পডেছে, সেই সময় দেখা গেল, এ ব্যাপারে উদাসীন এই সরকার কিন্তু কিছু ব্যাপারে অত্যন্ত সক্রিয়৷ ২৪ মার্চ ভোররাতে দিল্লির শাহিনবাগের প্রতিবাদী মঞ্চকে ভেঙে গুঁডিয়ে দেওয়া হয়েছে৷ করোনা সংক্রমণের অজুহাতে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে এনআরসি সিএএএ এবং এনপিআর বিরোধী প্রতিবাদী ধর্নামঞ্চগুলি তুলে নিতে বাধ্য করা হয়েছে৷ খুঁজে খুঁজে রাষ্ট্র বিরোধী কালাকানুনে গ্রেপ্তার করা হয়েছে শাহিনবাগ আন্দোলনের সংগঠকদের৷ জামিয়া মিলিয়া, জেএনইউ, আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিবাদী মুখগুলিকে এবং ভীমাকোরেগাঁও মামলায় জড়িয়ে বিভিন্ন বুদ্ধিজীবী ও শিক্ষাবিদদের৷ বহু লডাইয়ের ফলে অর্জিত দেশের শ্রম আইন পাল্টে ফেলার কাজটা অতিমারি রোখার থেকেও সরকারের কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়েছে৷ একই রকম ভাবে টেস্ট কিট, ওষুধ, পিপিই, ভেন্টিলেটরের সরবরাহ বাড়ানোর কাজের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইন বাতিলের কাজটি৷ ঠিক এই সময়টাকেই সরকার বেছে নিয়েছে কৃষি ফসলের ব্যবসাকে পুরোপুরি কর্পোরেট পুঁজির হাতে তুলে দেওয়ার নীতি চালু করার আদর্শ সুযোগ হিসাবে৷ জনবিরোধী জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১৯ কে কার্যকরী করার মওকা কেন্দ্রীয় সরকার ঠিক এই সময়েই পেয়েছে৷ কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের কাছে এসব ক্ষেত্রে লকডাউন বাধা হয়নি বরং সুবিধা হয়ে গেছে৷
কাশ্মীর উপত্যকায়ও এর ব্যত্যয় ঘটেনি৷ এমনিতেই গত বছর আগস্ট মাস থেকে গোটা কাশ্মীর উপত্যকা তালাবন্ধ হয়েই আছে৷৷ মোবাইল, ইন্টারনেট দীর্ঘকাল ধরে বন্ধ থেকেছে৷ ফলে কাশ্মীর সারা বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন৷ সংবাদ মাধ্যম সহ উপত্যকার মানুষের সমস্ত ধরনের গণতান্ত্রিক অধিকার কেডে নেওয়া হয়েছে৷ তাই করোনার আবহে আরেকটি লকডাউন কাশ্মীর উপত্যকার মানুষের কাছে নতুন বিপদের বার্তা নিয়ে এসেছে৷ যখন প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী লকডাউনের মধ্যে সারা দেশ যখন করোনা যুদ্ধে ব্যস্ত, সেই সময় কেন্দ্রীয় সরকার কাশ্মীরে ওষুধ–অক্সিজেন ভেন্টিলেটর–পিপিই নিয়ে মাথা ঘামায়নি৷ তারা তড়িঘড়ি জারি করেছে জম্মু–কাশ্মীরের ‘নতুন স্থায়ী অধিবাসী আইন’৷ যে আইনকে আবার ৭২ ঘন্টার মধ্যেই সংশোধন করতে হয়েছে৷ প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, গত বছর ৫ আগস্ট ৩৭০ ধারা বিলোপ করে জম্মু–কাশ্মীর রাজ্যকে ভেঙে দুটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে পরিণত করেছে কেন্দ্রীয় বিজেপি সরকার৷ একই সাথে ৩৫এ ধারা বাতিল করে দিয়েছে৷ তখন থেকেই ‘স্থানীয় অধিবাসী আইন’ পরিবর্তনের আশঙ্কা কাশ্মীর উপত্যকার প্রতিটি মানুষের মধ্যেই কাজ করছিল৷ এই ‘সংশোধিত অধিবাসী আইনের’ ফলে এক ধাক্কায় পূর্বতন জম্মু–কাশ্মীর রাজ্যের ‘অধিবাসীর’ যে সংজ্ঞা পাল্টে দেওয়া হল– এখন থেকে যারা টানা ১৫ বছর ওই অঞ্চলে বসবাস করছেন অথবা যারা ওই রাজ্যে সাত বছর পড়াশোনা করে দশম/দ্বাদশ শ্রেণির পরীক্ষা দিয়েছেন তাঁরাও সে রাজ্যের স্থায়ী অধিবাসী হিসেবে গণ্য হবেন৷ এছাড়া কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারীরা যারা ১০ বছর ওই রাজ্যে চাকরি করছেন তাদের সন্তানরাও স্থায়ী অধিবাসী হিসেবে চিহিণত হবেন৷ সংবিধানের ৩৭০ ধারা অনুযায়ী জম্মু–কাশ্মীরের অধিবাসীরাই সে রাজ্যে সরকারি চাকরি, বৃত্তি ও জমিজমা কেনার অধিকারী ছিলেন৷ নতুন সংশোধিত আইনের ফলে সেটা আর রইল না৷ স্বাধীনতার পর থেকে দিল্লির গদিতে যে সরকারই বসেছে, তারাই ৩৭০ ধারাকে দুর্বল করেছে৷ তবু এর জোরে যে সীমিত স্বায়ত্ত শাসন ও জনসংখ্যার বিন্যাস ছিল, বর্তমান সংশোধিত আইনের ফলে তা আর থাকছে না৷ বর্তমানে জম্মু–কাশ্মীর কেন্দ্র শাসিত রাজ্য হবার ফলে, অতি দ্রুততার সাথে কেন্দ্রীয় সরকার পরিবর্তিত আইনের প্রয়োগও শুরু করে দিয়েছে৷ কোভিড–১৯ ভাইরাসের সাথেই এই নতুন অধিবাসী আইন কাশ্মীরিদের ইতিমধ্যেই আহত মানসিকতার ওপর নতুন করে আঘাত হেনেছে৷ সরকার বার বার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে কাশ্মীরের পূর্ণ রাজ্যের মর্যাদা দ্রুত ফিরিয়ে দিয়ে সেখানে নতুন করে বিধানসভা নির্বাচন করা হবে৷ অথচ কাশ্মীরবাসীদের মতামত নেওয়ার জন্য এই সময়টুকু অপেক্ষা করার তর সয়নি মোদি সরকারের৷
স্থানীয় কাশ্মীরিদের প্রতিক্রিয়া
কেন্দ্রীয় সরকারের এই আইন পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত জম্মু–কাশ্মীরের বিভিন্ন মহলে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে৷ স্থানীয় কাশ্মীরিদের কাছে এই আইন তাদের জন্মভূমি থেকে উচ্ছেদের চেষ্টার হাতিয়ার হিসাবেই পরিগণিত হচ্ছে৷ তাঁরা দেখছেন একইসাথে এর দ্বারা দ্রুত সে জনবিন্যাসের চিত্রটির পরিবর্তন ঘটবে৷
প্রাক্তন এয়ার ভাইস মার্শাল কপিল কাক, যিনি সুপ্রিম কোর্টে ৩৭০ ধারা বাতিলের বিরুদ্ধে আবেদন করেছেন, তিনি আলজাজিরা টিভিকে জানিয়েছেন, ‘এত চুপিসারে বহিরাগতদের স্থায়ী বাসিন্দা করে দেওয়ার চেষ্টা কাশ্মীরিদের উদ্বিগ্ন করে তুলেছে৷’
আইনের অধ্যাপক শেখ সওকাত হোসেনের মতে, ‘এটা তো হতেই যাচ্ছিল৷ ৩৭০ ধারা বাতিলের আসল উদ্দেশ্য তো কাশ্মীরের জনবিন্যাসের ছবিটা পাল্টে দেওয়া’৷ মানবাধিকার কর্মী খুরাম পারভেজ এর মতে, ‘এই আইনের দ্বারা বহিরাগতরা দাবিদার হয়ে জম্মু–কাশ্মীরের বেকার সমস্যা বাড়িয়ে দেবে৷ এটা রাজ্যের কর্মহীন যুবকদের স্বার্থের পরিপন্থী৷’
জম্মু–কাশ্মীরের দুই প্রধান রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল কনফারেন্স ও পিডিপি তো বটেই কাশ্মীরের মানুষের সেন্টিমেন্টকে ধোঁকা দিতে কেন্দ্রীয় বিজেপি নেতৃত্বের লাইনের বাইরে গিয়ে জম্মুর স্থানীয় বিজেপি নেতারা পর্যন্ত ‘স্থায়ী অধিবাসী প্রশ্নে’ আশঙ্কা ব্যক্ত করে অমিত শাহকে চিঠি দিয়েছেন৷
গরিব কাশ্মীরিদের ওপর আসছে ভয়াবহ আক্রমণ
গত ৮ এপ্রিল কেন্দ্রশাসিত জম্মু–কাশ্মীরে একটি নতুন আদেশ বলে কাশ্মীরের দুই ঐতিহাসিক ‘ডাল’ ও ‘নিগিন’ লেকে নতুন হাউসবোট ও শিকারার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়৷ অতঃপর যা সব নিয়ম ও নথিভুক্তির জটিল প্রক্রিয়া বলা হয়েছে, তাতে আগামী দিনে এই অনুমোদনের জন্য বেশ কাঠখড় পোড়াতে হবে৷ কারণ, নাকি দূষণ নিয়ন্ত্রণ আপাত নিরীহ পরিবেশ বান্ধব এই আদেশনামার আডালে গরিব কাশ্মীরিরা তাদের ভাতে মারার অভিসন্ধি খুঁজে পাচ্ছেন৷ এর ফলে আগামী দিনে কাশ্মীরিরা ওই লেক দুটিতে হাউসবোট বা শিকারা চালাতে পারবেন না বলে আশঙ্কা৷ কারণ গোয়া বা কেরালায় যেমন নদী বা ‘ব্যাকওয়াটারে’ বিলাসবহুল হাউসবোট চলে, কাশ্মীরেও সরকার সেই ব্যবস্থা করতে চলেছে, যা এতদিন হাউসবোট চালিয়ে আসা সাধারণ কাশ্মীরিদের ধরাছোঁয়ার বাইরে৷ ফলে এই ব্যবসা বৃহৎ পর্যটন সংস্থা এবং করপোরেট হাউসের হাতে চলে যাবে বলে স্থানীয়দের বিশ্বাস৷ যা স্থানীয় বহু গরিব মানুষের জীবিকা কেড়ে নেবে৷
নতুন অধিবাসী আইন চালু করার সময় রাজ্য প্রশাসনের করোনা ভাইরাসের বিষয়টা মাথায় না থাকলেও উপত্যকায় ১০টি জেলায় কোটির অধিক বিশাল বিশাল ‘রাশিয়ান পপলার’ গাছ যা গত শতব্দীতে ৮১–৮২ সালে বিশ্ব ব্যাঙ্কের টাকায় সামাজিক বনসৃজন প্রকল্পে লাগানো হয়েছিল, যা বর্তমানে মূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদ, তাকে রাজ্যের ডেপুটি কমিশনার এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে অতি দ্রুততার সাথে কেটে ফেলার নির্দেশ দিয়েছেন৷ এই গাছ সাধারণ মানুষের জীবন জীবিকার সাথে যুক্ত৷ সম্প্রতি সরকারি আদেশনামায় বলা হয় এপ্রিলের প্রথমে এই গাছের যে পরাগ রেণু হয় তা কোভিড ১৯ সংক্রমণে সাহায্য করে৷ স্বাভাবিকভাবে পরিবেশবিদদের প্রশ্ন এত বছর তো এ প্রশ্ন ওঠেনি? সারা বিশ্বে বহু দেশে পাহাডি এলাকায় এই গাছ আছে৷ কবে কোথায় কোন বিজ্ঞানী এই তত্ত্ব দিলেন? কোনও নিশ্চিত প্রমাণ ছাড়াই এত অবিশ্বাস্য দ্রুততার কোনও সরকার লক্ষ লক্ষ গাছ কেটে ফেলতে পারে? তারা পরিবেশের ভারসাম্য নিয়ে এতটুকুও চিন্তিত হলে এটা সম্ভব হত? সরকারি আদেশে এও বলা হয় ওই গাছ নাকি ভূস্বর্গের জলস্তর নিম্নগামী করছে৷ ফলে ভবিষ্যতে কাশ্মীরে জলসংকট দেখা দেবে৷ প্রশ্ন উঠছে লকডাউনের মধ্যে কোনটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ? করোনা মহামারি রোধে তৎপরতা নাকি কোটির অধিক ‘রাশিয়ান পপলার’ গাছকে অবিশ্বাস্য দ্রুততায় কেটে ফেলা? এর ফলে যে দশটি জেলা জুড়ে কয়েক লক্ষ একর সরকারি খালি জমি তৈরি হবে সেটাই আসল লক্ষ্য নয় কি? কাশ্মীরের সাধারণ মানুষ আশঙ্কা করছেন এই জমিগুলি জমি–মাফিয়া ও কর্পোরেট হাউসের দখলে চলে যাবে৷ এর ফলে আরও কয়েক লক্ষ মানুষ তাদের জীবিকা হারাবেন৷
সাংবাদিকদের কণ্ঠরোধ গণতন্ত্রের কফিনে ঠোকা একটি পেরেক
২০ এপ্রিল জম্মু–কাশ্মীর পুলিশ মসরৎজারা নামে এক মহিলা সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ইউএপিএ ধারায় এফআইআর করেছে৷ অভিযোগ জারা ১৯ মাস আগে সেপ্ঢেম্বর ২০১৮–তে তার ইনস্টাগ্রামে একটি ছবি প্রকাশ করে৷ ২৬ বছরের তরুণী জারা ঝুঁকি নিয়ে সংবাদ তৈরি করার মতো সাহসী সাংবাদিক হিসেবে পরিচিত৷ তিনি ওয়াশিংটন পোস্ট, আল–জাজিরা সহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের হয়ে সাংবাদিকতা করেছেন৷ ওই ইনস্টাগ্রামের ছবিতে দেখা যাচ্ছে হিজবুল মুজাহিদিনের নিহত কমান্ডার বুরহান ওহানির ছবি সহ পোস্টার নিয়ে শিয়াপন্থী মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষরা মিছিল করছে৷ যে পোস্টারে ‘শহিদ বুরহান ওহানি’ কথাগুলো লেখা আছে৷ উল্লেখ্য ছবিটি বর্তমানে আন্তর্জাতিক সংবাদসংস্থা ‘গেইটি ইমেজের’ সম্পত্তি৷ একজন সাংবাদিক হিসাবে জারা নিরপেক্ষভাবে বাস্তব একটি ঘটনাকে তুলে ধরেছিলেন মাত্র৷ তিনি নিজে বুরহানকে শহিদ আখ্যা দেননি, বা তার সংগঠনের কাজকে সমর্থনও করেননি৷ সাংবাদিক হিসাবে ‘গ্রাউন্ড রিয়েলিটি’–কে তুলে ধরাই তাঁর কাজ৷ তিনি সেই দায়িত্ব পালন করেছেন৷ ১৯ মাস বাদে সম্প্রতি জম্মু–কাশ্মীরের পুলিশ তাকে সাবধান করে জানায় ওই ছবি পোস্ট করার জন্য তার বিরুদ্ধে ইউএপিএ ধারায় কানুনি প্রক্রিয়া চলছে৷ ওই এফআইআর–এ পুলিশ তাকে চিত্র সাংবাদিকের পরিবর্তে একজন ফেসবুক ব্যবহারকারী বলে উল্লেখ করেছে৷
শুধুমাত্র রিপোর্টে তথ্যের ভুলের জন্য রিপোর্টার পীরজাদা আশিককে জঙ্গি কার্যকলাপ বিরোধী আইনে থানায় আত্মসমর্পণ করতে বলা হয়েছে৷ গত ১৭ এপ্রিল শোপিয়ান জেলার দায়রুকিগাম অঞ্চলে পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, দুজন সন্ত্রাসবাদী পুলিশ ও সামরিক বাহিনীর গুলিতে প্রাণ হারায়৷ কিন্তু অজানিত কারণে তাদের দেহ আত্মীয়দের হাতে না দিয়ে ১৯০ কিলোমিটার দূরে বারমুলা জেলার একটি টিলায় তাদের কবর দেয় সরকারি সুরক্ষা বাহিনী৷ সাংবাদিক আশিকের অপরাধ হল নিহত ওই দুই যুবকের পরিবার থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে তিনি সংবাদে লিখেছিলেন, ওই পরিবারের আবেদন মেনে কর্তৃপক্ষ দেহ শনাক্ত করে কবর দেওয়ার অনুমতি প্রদান করেছিল৷ কর্তৃপক্ষের বক্তব্য তারা কবরের অনুমতি দেয়নি, দিয়েছিল কারফিউ পাস৷ শুধুমাত্র এই অজুহাতে ‘ফেক নিউজ’ তৈরির এই অভিযোগে তাকে অভিযুক্ত করা হয়েছে৷
গোহর গিলানি হলেন তৃতীয় সাংবাদিক যিনি গত ২১ এপ্রিল এই দানবীয় আইনের শিকার৷ বিজেপির গুড বুকে থাকা সাংবাদিক অর্ণব গোস্বামী যখন সরকারের পেটোয়া কিছু অজানা কাশ্মীরি রাজনৈতিক ব্যক্তিকে আগামী দিনের রাজ্যের ভবিষ্যৎ হিসেবে তুলে ধরেছিলেন, রিপাবলিক টিভিতে ওই প্রোগ্রামের সাথে যুক্ত করে সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিকভাবে কোনও প্রবাসী কাশ্মীরি, গিলানির একটি তির্যক মন্তব্য টুইট করে দেন৷ একেই রাষ্ট্র ও দেশের প্রতি বিদ্বেষ ও বিপদজনক বলে চিহ্ণিত করে জম্মু–কাশ্মীরের পুলিশের আইজি ২৪ এপ্রিল বিবৃতি দেন৷ এভাবেই লকডাউনে করোনার আবহে একের পর এক প্রতিবাদী ও নির্ভীক সাংবাদিকদের কণ্ঠ রোধ করা হচ্ছে৷
এই ঘটনার ঠিক ৮ দিন আগে ১৬ এপ্রিল জম্মু–কাশ্মীর পুলিশ প্রকাশ্য বিবৃতিতে জানায়, ‘কাশ্মীরের সাইবার পুলিশ নেট ব্যবহারকারীদের সমস্ত প্রোফাইল খেয়ালে রাখছে এবং যে সমস্ত বিষয়বস্তু আপলোড করা হচ্ছে তা নজরে রাখছে৷’ এমনকি অজানা প্রোফাইল থেকে যদি রাষ্ট্রবিরোধী কিছু আসে, তাকেও খুঁজে বের করে শাস্তি দেওয়া হবে৷ কাশ্মীরের নবগঠিত সাইবার পুলিশ স্টেশন, ‘সমস্ত কাশ্মীরিদের ইউএপিএ আইনকে ভালো করে লক্ষ করতে বলছে৷’ যেখানে রাষ্ট্রের প্রতি কোনও রকম অশ্রদ্ধাকে (পড়ুন সমালোচনা) আইনবিরোধী আখ্যা দেওয়া যাবে৷ দেশের কোনও অংশে স্বায়ত্তশাসনের দাবিও ওই আইনের আওতায় পড়ে যাবে৷ বিচ্ছিন্নতাবাদী কিংবা সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপে জড়িয়ে পড়ছেন যে সব সাধারণ মানুষ, তাঁদের ক্ষোভকে সহানুভূতির সাথে নিরসনের দাবিও সংশোধিত ইউএপিএ আইনে শাস্তিযোগ্য৷ ফলে এটা বুঝতে অসুবিধা হয় না সংবাদপত্রে প্রকাশিত কোনও সংবাদ যদি সরকারের পক্ষে অস্বস্তিকর হয়, তা উক্ত আইনের আওতায় চলে আসবে৷
প্রায় বছর ঘুরতে চলল কাশ্মীরে ‘ইলেকট্রনিক কারফিউ’ চলছে৷ দীর্ঘদিন তো কোনও ইন্টারনেট বা মোবাইল যোগাযোগ ছিল না৷ বর্তমানে তার সীমিত অর্থে (২জি) চালু হলেও সোশ্যাল মিডিয়াকে কড়া নজরে রাখা হয়েছে৷ যাতে কোনও কারণে সরকার বিরোধী কণ্ঠস্বর শোনা না যায়৷ এব্যাপারে দেশের বিচার ব্যবস্থা অদ্ভুত ধরনের নীরবতা, কোনও কোনও ক্ষেত্রে অসহিষ্ণুতা প্রদর্শন করেছে৷ ফলে কাশ্মীরের বিচ্ছিন্নতা বর্তমান রাষ্ট্র আইনের মান্যতা পেয়ে যাচ্ছে৷
গত আগস্টে ৩৭০ ধারা বিলোপ এর সাথে সাথে কাশ্মীরের সংবাদমাধ্যমের যতটুকু আপেক্ষিক স্বাধীনতা অবশিষ্ট ছিল তা লোপ পেয়েছে৷ এক অদ্ভুত ভয় সংবাদমাধ্যমকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে, প্রশাসন সমস্ত সরকারি বিজ্ঞাপন বন্ধ করে দেবে৷ সংবাদমাধ্যমকে কালাকানুনের নানা বেড়াজালে জড়িয়ে ফেলবে৷ ফলে অধিকাংশ সংবাদমাধ্যম স্বেচ্ছা নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছে৷ নিবন্ধকারদের বলা হচ্ছে, ‘হয় সুর নরম করুন, না হয় লেখা বন্ধ করুন৷’ বিষয়টা এখন এমন দাঁডিয়েছে কোনও সন্ত্রাসবাদী (জিহাদি) নিহত হলে শুধুমাত্র সরকারি ভাষ্য ছাপা হচ্ছে৷ আগে ওই নিহত ব্যক্তির পরিবারের সাথে যোগাযোগ করে কেন সে সন্ত্রাসবাদী (জিহাদি) হয়ে গেল সে সম্পর্কে বিভিন্ন বক্তব্য সম্বলিত খবর প্রকাশ করা সম্ভব ছিল৷ যার ফলে সারা দেশের মানুষ জানতে পারত সরকারের ভ্রান্ত নীতি কীভাবে শান্তিপ্রিয় কাশ্মীরিদের সন্ত্রাসবাদের ধ্বংসাত্মক পথে ঠেলে দিচ্ছে৷ এর ফলে সরকারের অস্বস্তি বাড়ত, কিন্তু সকল কাশ্মীরি মানুষকে সন্ত্রাসবাদী বলে দাগিয়ে দেওয়ার চক্রান্ত সফল করতে কিছুটা অসুবিধা হত সীমান্তের দুই পারেরই কায়েমী স্বার্থবাদীদের৷ এখন কেন করা হচ্ছে না? এই প্রশ্নের জবাবে উপত্যকায় সর্বাধিক প্রচারিত ইংরেজি দৈনিক ‘গ্রেটার কাশ্মীরে’র এক সাংবাদিককে জিজ্ঞাসা করতেই তিনি বলেন, ‘এটাই এখন দস্তুর’ অর্থাৎ স্বাভাবিক ঘটনা৷ গত বছর প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী সোহেল নকশবন্দী ‘গ্রেটার কাশ্মীর’ থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন৷ তিনি বুঝতে পারছিলেন তাঁর আঁকা কার্টুন ‘সেন্সর’ করা হচ্ছে৷ কেন্দ্রীয় তথ্য–সম্প্রচার মন্ত্রক জম্মু–কাশ্মীর প্রশাসনকে জানিয়েছে কোনও রকম ‘প্রতিবাদী শিল্পকে’ যেন সহ্য করা না হয়৷ প্রশাসনের এই ভয়ঙ্কর চাপের মুখে কাশ্মীরের সংবাদ মাধ্যম এক কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন৷ আগামী দিনে সেটা আরও কঠিনতর হতে চলেছে বলে আশঙ্কা৷ শুধু সাংবাদিক নন বহু সাধারণ মানুষকে দেশবিরোধী (!) আখ্যা দিয়ে ইউএপিএ–এর মত কালাকানুনের আওতায় জড়িয়ে দেওয়া হতে পারে বলে সাংবাদিকদের আশঙ্কা৷ সাম্প্রতিককালে কাশ্মীর উপত্যকার বিভিন্ন সাংবাদিককে যেভাবে ইউএপিএ সহ অন্যান্য কালাকানুন আটক করা হচ্ছে তাতে একটা বিষয় অত্যন্ত পরিষ্কার ৩৭০ ধারা বিলোপ করে বিশেষ স্ট্যাটাস কেডে নেওয়ার পর– তার প্রতিবাদ করা বা পুরনো অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টাকে রাষ্ট্রদ্রোহ হিসেবে দেখা হবে৷ কাশ্মীরের প্রশাসন চাপ ও ধমকি দিয়ে সংবাদমাধ্যমকে সেটাই বুঝিয়ে দিতে চেয়েছে৷
কাশ্মীরের সাংবাদিকদের স্বাধীনতা হরণ কেন্দ্রীয় সরকার যতই চেপে রাখার চেষ্টা করুক না কেন, তা সম্পূর্ণ সফল হয়নি৷ মশরৎ জারা’র ঘটনায় আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ভাষাবিদ ও মানবাধিকার কর্মী ‘নোয়াম চমস্কি’ সহ বিশিষ্ট ব্যক্তিরা এ ব্যাপারে রাষ্ট্রসঙেঘর হস্তক্ষেপ দাবি করেছেন৷ নিউইয়র্ক ও প্যারিসের সাংবাদিকদের অধিকার রক্ষা সংস্থা সিপিজে (কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টস) ও আর ডব্লিউ বি (রিপোর্টার উইদাউট বর্ডার) এই ঘটনার তীব্র নিন্দা করেছে৷
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ‘ফ্রিডম হাউস’ জানিয়েছে কাশ্মীরে মানবাধিকারের ওপর হস্তক্ষেপ বিশ্বের ২৫টি বড় গণতান্ত্রিক দেশের মধ্যে সবচেয়ে নিম্নগামী (সূচক স্তর ৭১)৷ প্রেসের স্বাধীনতার প্রশ্নে ভারতের অবস্থান ১৮০টি দেশের মধ্যে ১৪২তম৷
আজ যখন সারা দেশ অতিমারি করোনার আবহে লকডাউনের মধ্যে প্রায় ঘরবন্দি অবস্থায় আছে, কেন্দ্রীয় সরকার তখন করোনার বিরুদ্ধে লডাইয়ের কথা বলতে বলতে সাধারণ ও শ্রমজীবী মানুষের বিরুদ্ধে যাবতীয় কালাকানুনের অস্ত্র শানাচ্ছে৷ নিবন্ধের শুরুতেই তা বলা হয়েছে৷ আর করোনার আবহে কাশ্মীরের মানুষকে ‘ডাবল লকডাউন’ এর মার সহ্য করতে হচ্ছে৷ যদিও তাদের সেই কান্না এখন দেশবাসীর কাছে পৌঁছাচ্ছে না৷
কাশ্মীরে লকডাউন মানে নকডাউন
লকডাউনের কাশ্মীরে একটা পরিচিত দৃশ্য, ভোরে মসজিদের মাইকে ঘোষণা, ‘সবাইকে খেলার মাঠে সারিবদ্ধ ভাবে দাঁডাতে হবে৷’ কোন হতভাগ্যদের বেছে বেছে তুলে নিয়ে যাওয়া হবে, সেনাদের গাডিতে পিছনের সারিতে বসে থাকা বিড়াল (‘চর’) দের নির্দেশে কোন অজ্ঞাত স্থানে, তা কেউ জানে না৷ ‘ডাউন’ শব্দটি এখানে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে পরিবর্তিত হয়েছে৷ কখনও কিছু বিধিনিষেধ সহ কারফিউ, কখনও ‘ক্যাসো’(কর্ডন করে সার্চ করা) সহ ‘ক্র্যাকডাউন’৷
এই লকডাউনের আবহে ভীত কাশ্মীরিরা দেখছে কাকে যে করোনা আক্রান্ত সন্দেহে তুলে নিয়ে গিয়ে জন্তুসম বন্দিশালায় রেখে দেওয়া হবে, তা ঠিক করতে ডাক্তারদের চেয়েও ক্ষমতা বেশি ‘সুরক্ষা বাহিনীর’৷ এই আতঙ্কেস্বেচ্ছা আরোপিত হরতাল পালন করছে নিপীড়নের প্রতিবাদে৷ তাই স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসাটা কাশ্মীরিদের এখন কল্পনাবিলাস বলে মনে হয়৷ গ্রাম–শহরে অসংখ্য মানুষ গৃহহীন ও বেকার, তাদের কাছে বর্তমান সময়ে ‘স্টে হোম’, ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’ এইসব সরকারি নির্দেশের সাজানো কথাগুলি অর্থহীন বলে মনে হয়৷
উপত্যকার ২৮ বছরের বডি বিল্ডার মারুফ আহমেদ ভাট, ৪০০ ছররা গুলি শরীরে বহন করছে৷ প্রায় অন্ধ এই যুবক বহুবার নিজের হাতের শিরা কেটে আত্মহত্যা করে পরিবারকে আর্থিক বোঝা থেকে নিষ্কৃতি দিতে চেয়েছে, তার কাছে করোনা অতিমারি তো তুচ্ছ ব্যাপার বলে মনে হয়৷
আরেক জন তরতাজা যুবক যাকে ‘মিস্টার বডগাম’ বলা হত, সে ছিল একজন সফল কল সারাই এর মিস্ত্রি, যে কাজ করে যথেষ্ট রোজগার করত৷ ২০১৬ সালে বকরি ঈদের দিন ভেডার মাংস বিতরণ করতে গিয়েছিল৷ ফেরার পথে পুলিশের ছররা গুলির আঘাতে তার দৃষ্টি ও জীবনীশক্তি প্রায় নির্বাপিত৷ শরীরে মোট ৬৫০টি ছররা গুলি নিয়ে কোনও রকমে সে বেঁচে আছে৷ তার দীর্ঘশ্বাস, ‘আমার আঘাত করোনা ভাইরাসের থেকেও মারাত্মক, আর আমার সামাজিক দূরত্ব সে তো পৃথিবীতে যে কোনও মানুষের চেয়ে ঢের বেশি’৷
গত আগস্ট মাস থেকে এখন পর্যন্ত কাশ্মীরের দৃশ্যপটকে যদি একের পর এক সাজিয়ে দেখি তাহলে দেখতে পাব, উপর্যুপরি লকডাউনের ফলে উপত্যকার স্বাভাবিক সামাজিক জীবন, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা চূড়ান্ত সঙ্কটে৷ কেন্দ্রের বিজেপি সরকার একের পর এক নতুন আইন এবং নির্দেশনামার মাধ্যমে উপত্যকার অর্থনীতি, রাজনীতি ও সংস্কৃতিকে পঙ্গু করে দেবার ষড়যন্ত্র করছে বলে সর্বস্তরের কাশ্মীরের মানুষের আশঙ্কা৷ আজ সারা দেশের গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষের অভিজ্ঞতার সাথে মিলে যাচ্ছে কাশ্মীরের বুকে গণতন্ত্র হত্যার ছবিটি৷ তাই কাশ্মীরের মানুষের সমস্যা কেবল তাদেরই সমস্যা নয়, সারা দেশের গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষেরই সমস্যা৷ এনারসি, সিএএ, এনপিআর বিরোধী লডাইতে যেমন সারা দেশ জেগেছে তেমন করেই ভারতের সকল খেটে খাওয়া মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার লড়াইয়ের অঙ্গীকার করতে হবে কশ্মীরের মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারের লড়াইকে।
সূত্র :
The Statesman, 10.04.2020,
Al Jazeera News, 1.04.2020, Srinagar,
Peerzada Ashique 04.04.2020,
The Hindu, 1 April, 2020, Srinagar,
The Wire, 1 April & 27 April, 2020