আফ্রিকার দেশ সুদানের আকাশ গত একমাস ধরে গোলাগুলির ধোঁয়ায় কালো, বাতাসে বারুদের গন্ধ। পশ্চিম সুদানে রাজধানী খারতুম ও ডারফুর এলাকায় দেশের সেনাবাহিনী ও আধাসেনা বাহিনীর সংর্ঘষে বিপন্ন বাসিন্দাদের জীবন। জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে ঘরবাড়ি, দোকানপাট। খাদ্য-পানীয়ের অভাবে বিপন্ন আতঙ্কিত মানুষ মৃত্যুর দিন গুনছেন। একটি সূত্র অনুযায়ী সুদানে ইতিমধ্যে মারা গেছেন প্রায় পাঁচশো জন। আহত ৪ হাজারের বেশি। দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন ২১ হাজারেরও বেশি নাগরিক।
এপ্রিলের মাঝামাঝি সুদানের বর্তমান শাসক, সামরিক বাহিনী ‘সুদানিজ আর্মড ফোর্সেস’ (এসএএফ)-এর প্রধান জেনারেল আবদেল ফাতাহ আল-বুরহানের সঙ্গে সশস্ত্র সংঘর্ষ শুরু হয়েছে আধাসেনা বাহিনী ‘র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস’ (আরএসএফ)-এর প্রধান জেনারেল মহম্মদ হামদান ডাগালো-র, যিনি হেমেদতি নামে বেশি পরিচিত।
তেল, প্রাকৃতিক গ্যাস, সোনা সহ মূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদ ও লোহিত সাগরের তীরে ভূ-রাজনৈতিক ভাবে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানের জন্য আমেরিকা সহ নানা সাম্রাজ্যবাদী দেশের লোভের নজরে থাকা সুদান বহু বছর ধরেই রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে রয়েছে। ১৯৫০-এর দশকে মিশর ও ইংল্যান্ডের দখল থেকে স্বাধীনতা লাভের পর সুদান একের পর এক সামরিক অভ্যুত্থান, দেশের ভিতরে উপজাতিগুলির মধ্যে সংঘাত, গৃহযুদ্ধ ইত্যাদিতে বার বার বিধ্বস্ত হয়েছে। সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করে ১৯৮৯-তে সুদানের প্রেসিডেন্ট হন জেনারেল ওমর আল বশির। পশ্চিমী সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সুদান বরাবরই বিরোধিতার ঐতিহ্য নিয়ে চলেছে। প্রেসিডেন্ট বশিরও সেই পথেই চলেছিলেন। সাম্রাজ্যবাদী থাবা বসাতে উদগ্রীব আমেরিকা সহ পশ্চিমী দেশগুলি নানা ভাবে সুদানে অস্থিরতা তৈরির চেষ্টা চালাতে থাকে। ২০০০-এর প্রথম দশকে ডারফুরে আরব এবং অ-আরব উপজাতি সংঘর্ষ সামাল দিতে হেমেদতির নেতৃত্বে স্থানীয় ‘ঝঞ্ঝাবিদ’ বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে প্রেসিডেন্ট বশির তৈরি করেছিলেন আরএসএফ নামে আধাসামরিক বাহিনী। সংঘাত দমন করতে গিয়ে নাগরিকদের উপর প্রেসিডেন্ট বশির নির্মম দমন-পীড়ন চালাচ্ছেন– এই অভিযোগে সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলি বশিরের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতে অভিযোগ তোলে। নানা ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে ২০১১ সালে সুদান ভাগ হয়ে দক্ষিণ সুদান নামে নতুন একটি দেশের জন্ম হয়। তেলের খনির অধিকাংশেরই দখল নিয়ে নেয় এই দক্ষিণ সুদান।
সুদানের শাসনক্ষমতা থেকে যায় প্রেসিডেন্ট বশিরেরই হাতে। তাঁর আমলেই নতুন সাম্রাজ্যবাদী রাশিয়া লোহিত সাগরে একটি নৌ-ঘাঁটি তৈরির চুক্তি করে সুদানের সঙ্গে, যেখানে কয়েকশো নৌ-সেনা, একটি পরমাণুশক্তি চালিত যুদ্ধজাহাজ সহ চারটি যুদ্ধজাহাজ থাকবে বলে প্রেসিডেন্ট বশিরের সঙ্গে কথা হয় রাশিয়ার কর্তাদের। এতে পশ্চিমী সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলি, বিশেষত আমেরিকা রুষ্ট হয়।
এদিকে দেশ ভাগ হওয়ার পর থেকে ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক দুরবস্থা, মূল্যবৃদ্ধি ও বেকারত্বের প্রবল সমস্যা সামাল দিতে পারছিলেন না প্রেসিডেন্ট বশির। নানা ধর্ম ও উপজাতিগত সংঘর্ষও একটানা চলেছিল দেশ জুড়ে। এই অবস্থায় ২০১৮-র ডিসেম্বরে অর্থনৈতিক সমস্যায় জর্জরিত সুদানের সাধারণ মানুষ প্রেসিডেন্ট বশিরের পদত্যাগ ও গণতন্ত্রের দাবিতে পথে নামে। আন্দোলন ব্যাপক রূপ নেয়। পুঁজিবাদী শাসনে জীবনযন্ত্রণায় অতিষ্ঠ নাগরিকদের এই ন্যায্য আন্দোলনে নানা অপশক্তি ঢুকিয়ে দিতে সক্ষম হয় মতলববাজ মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ সহ অন্য সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলি। তাদের উদ্দেশ্য ছিল, রাশিয়ার সঙ্গে সুদানের নৌ-ঘাঁটি সংক্রান্ত চুক্তি বানচাল করে দেওয়া। দাবি তোলা হয়, এই চুক্তি নতুন করে পর্যালোচনা করতে হবে। সামরিক বাহিনীর একটি গোষ্ঠী আন্দোলনকারীদের সঙ্গে যোগ দেয়। পদত্যাগ করতে বাধ্য হন বশির। কয়েকটি রাজনৈতিক দল, সামরিক বাহিনীর ওই গোষ্ঠী ও ব্যবসায়ীদের জোটের একটি সার্বভৌম কাউন্সিল অন্তর্বর্তী সরকার তৈরি করে শাসন ক্ষমতায় বসে। প্রধানমন্ত্রী হন আবদুল্লা হামদক। সিদ্ধান্ত হয়, এই অন্তর্বর্তী সরকার ২০২২-এর মধ্যে নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক সরকার গড়ার দিকে এগোবে।
কিন্তু তার আগেই ২০২১ সালের অক্টোবরে দেশের সামরিক বাহিনীর কর্তা বুরহান, আরএসএফ কর্তা হেমেদতির সঙ্গে জোট করে একটি অভ্যুত্থান ঘটান এবং প্রধানমন্ত্রী হামদককে ক্ষমতা থেকে হঠিয়ে সার্বভৌম কাউন্সিলের প্রধান হয়ে বসেন জেনারেল বুরহান। এই অভ্যুত্থানকে সমর্থন করে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ এবং সুদানের প্রতিবেশী সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরশাহী ইত্যাদি দেশ। অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে আন্দোলনরত নিরস্ত্র জনতার উপর নির্মম হামলা চালায় বুরহান সরকার, পাশে থাকে হেমেদতি বাহিনী। মৃত্যু হয় গণতন্ত্রকামী বহু আন্দোলনকারীর। এবার সুদানের শাসন ক্ষমতার দখল নিয়ে এই বুরহানের সঙ্গেই দ্বন্দ্ব বেধেছে তাঁর সেই সময়ের সহযোগী হেমেদতির। আরও একবার ভয়াবহ দুর্গতি নেমে এসেছে সুদানের সাধারণ মানুষের জীবনে।
বস্তুত, ‘২১ সালে বুরহান সরকার গঠনের পর থেকেই সুদানে আধিপত্য বিস্তারের লক্ষে্য সেনাপ্রধান ও আধাসেনা কর্তার মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব শুরু হয়, যাকে সেই সময় থেকেই উস্কানি দিয়ে চলেছে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ সহ পশ্চিমী সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলি। সঙ্গে রয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরশাহী, সৌদি আরব, মিশর, লিবিয়া ইত্যাদি প্রতিবেশী দেশ। বুরহান ও হেমেদতি, দু’জনকেই দফায় দফায় এই দেশগুলির সঙ্গে যোগাযোগ করতে দেখা গেছে। ওয়াকিবহাল মহলের বক্তব্য অনুযায়ী মিশর রয়েছে সুদানের সামরিক বাহিনী তথা বুরহানের পাশে। অন্যদিকে সংযুক্ত আরব আমিরশাহী ও লিবিয়ার সমর্থন হেমেদতির আরএসএফ-এর দিকে।
সুদানে দীর্ঘদিন ধরেই রাশিয়া ও চিনের প্রভাব রয়েছে। প্রেসিডেন্ট বশিরের আমল থেকেই সুদানকে অধিকাংশ অস্ত্রশস্ত্র জোগান দিত রাশিয়া। আফ্রিকায় আধিপত্য বিস্তারে আগ্রহী বর্তমান সাম্রাজ্যবাদী রাশিয়া নিজেদের অর্থনৈতিক ও ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ পূরণে সুদানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ইদানীং আরও বাড়ানোর চেষ্টা করছে। সম্প্রতি রুশ বিদেশমন্ত্রী সুদান সফরে এসে বুরহান ও হেমেদতি– দু’জনের সঙ্গেই কথাবার্তা বলেছেন। সুদানকে অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ করে নিরাপত্তা দেওয়ার বিনিময়ে সেখানে লোহিত সাগরের উপকূলে রুশ নৌ-ঘাঁটি তৈরির পুরনো চুক্তি পরিণতির দিকে যাচ্ছে বলে জানা গেছে। এছাড়া সোনা সহ সুদানের মূল্যবান খনিজ পদার্থ নিষ্কাশন নিয়েও রুশ-সুদান আলোচনা হয়েছে। সুদানের এই খনিগুলির নিরাপত্তার জন্য রাশিয়া অনেক দিন ধরেই ভাড়াটে সেনা নিয়োগ করে আসছে। এর পাশাপাশি, মধ্য আফ্রিকায় যেখানে ইতিমধ্যেই রুশ বেসরকারি পুঁজি ব্যবসা করছে এবং মোতায়েন রয়েছে শত শত রুশ সেনা, সেখানে যাতায়াতের জন্য সুদানের আকাশপথ ব্যবহার করা রাশিয়ার জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।
চিনের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। সুদানের সঙ্গে চিনের সুসম্পর্কের ইতিহাস অনেক পুরনো। ১৯৯০-এর দশকে সুদানের তৈলক্ষেত্র উন্নয়নে চিন নানা ভাবে সাহায্য করেছিল। প্রেসিডেন্ট বশিরের আমলে আমেরিকা সুদানের উপর যে বিধিনিষেধ চাপিয়েছিল সে সব অগ্রাহ্য করে তার সাম্রাজ্যবাদী প্রতিদ্বন্দ্বী চিন অস্ত্র বিক্রি করা ছাড়াও অন্যান্য ক্ষেত্রে সুদানের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক বজায় রেখে চলেছে। সৌদি আরবে গত ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত আরব দেশগুলির সঙ্গে চিনের শীর্ষ বৈঠকের সময়ে চিনের প্রেসিডেন্ট সুদানের জেনারেল বুরহানকে সহযোগিতার সম্পর্ক বজায় রাখার আশ্বাস দেন। আরব দুনিয়া ও পশ্চিম এশিয়ায় আধিপত্য বিস্তারের পথে পা-বাড়াতে সুদানের সঙ্গে সুসম্পর্ক আজকের সাম্রাজ্যবাদী চিনেরও তাই একান্ত প্রয়োজন।
ফলে অর্থনৈতিক, কূটনৈতিক ও ভূ-রাজনৈতিক কারণে রাশিয়া ও চিন এই দুই দেশের পক্ষেই সুদানের বর্তমান রাজনৈতিক অস্থিরতা ক্ষতিকারক। এদিকে আমেরিকা, ইংল্যান্ড ইত্যাদি পশ্চিমী সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলি এবং সুদানের প্রতিবেশী সৌদি আরব, মিশর ও সংযুক্ত আরব আমিরশাহীর মতো দেশগুলির আবার লাভ এতেই। কারণ, এই গৃহযুদ্ধ ও রাজনৈতিক অস্থিরতার সুযোগ নিয়ে কখনও বুরহান, কখনও হেমেদতির পাশে দাঁড়িয়ে, তাদের বিরোধ উস্কে দিয়ে সুদানে নিজেদের প্রভাব বাড়িয়ে নিতে চায় এই শক্তিগুলি।
সব মিলিয়ে সুদানে এখন যা চলছে, তা আসলে একদিকে মার্কিন নেতৃত্বাধীন সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ও অপর দিকে রুশ ও চিন সাম্রাজ্যবাদের মধ্যেকার ছায়াযুদ্ধ, যার মূল্য দিচ্ছে সেখানকার সাধারণ মানুষ। সুদানের কমিউনিস্ট পার্টি এবং দেশের শিক্ষিত সচেতন অংশ যাঁরা গণতন্তে্রর দাবিতে প্রেসিডেন্ট বশিরের বিরুদ্ধে আন্দোলনে একজোট হয়েছিলেন, তাঁরা অবিলম্বে সংঘর্ষ বন্ধ করা, অস্ত্রশস্ত্র বাজেয়াপ্ত করা এবং শহর ও গ্রামগুলি থেকে সেনা ও আধা-সেনাদের সরিয়ে নেওয়ার দাবি করেছেন। সুদানের কমিউনিস্ট পার্টি দেশে শান্তি, সুস্থিতি ফিরিয়ে আনার লক্ষে্য অবিলম্বে সংঘর্ষ বন্ধের দাবিতে দেশের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার ডাক দিয়েছে। গোটা বিশ্বের গণতান্ত্রিক চেতনাসম্পন্ন মানুষ ও কমিউনিস্ট শক্তিগুলির কাছেও তাঁরা আবেদন জানিয়েছেন, সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে সুদানের জনগণের সংগ্রামকে তাঁরা যেন সমর্থন করেন।
(তথ্যসূত্রঃ নিউজউইক ৯০- ২৭ এপ্রিল ‘২৩, ইন ডিফেন্স অফ মার্ক্সিজম- ১৭ এপ্রিল ‘২৩, সুদানের কমিউনিস্ট পার্টির বিবৃতি- ১৮ এপ্রিল ‘২৩)