পশ্চিমবঙ্গে ভোট শেষ হয়েছে। এ রাজ্যে বিজেপি গদি দখলে ব্যর্থ হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে বিজেপির সর্বভারতীয় এবং রাজ্য নেতাদের অশ্লীল এবং চরম সাম্প্রদায়িক উচ্চকিত প্রচার আপাতত থেমেছে। বিজেপির এই ব্যর্থতায় পশ্চিমবঙ্গের মানুষ যেন কিছুটা হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে। একই সাথে দেখা যাচ্ছে উত্তরপ্রদেশের পঞ্চায়েত ভোটেও বিজেপি বিরোধী বিক্ষোভ ফেটে পড়েছে। বারাণসী, অযােধ্যা সহ বহু জায়গাতেই তাদের ফল অত্যন্ত খারাপ।
কিন্তু বিজেপিকে নির্বাচনী লড়াইতে পরাস্ত করার পিছনে কি তৃণমূল কংগ্রেসের প্রতি মানুষের আস্থাই কাজ করেছে? ভুলে গেলে চলবে না পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা ভোটের আগে রাজ্যে ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেসের সরকারের বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভের কথা কিছু কম শোনা যাচ্ছিল না। কিন্তু সে ক্ষোভ বিক্ষোভের প্রতিফলন ভোটের| মেশিনে বিশেষ পড়েনি। তার জন্য তৃণমূল কংগ্রেস নেতৃত্ব যদি ভেবে নেন তাদের বিরুদ্ধে ওঠা সমস্ত অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হয়ে গেল, তাহলে জনমতের প্রতি চরম অসম্মান করবেন তারা। বস্তুত, বিজেপি বিরোধী প্রবল জনমতই জিতিয়েছে তৃণমূল কংগ্রেসকে।
এই নির্বাচনের আগে সারা ভারতেই গণতান্ত্রিক বোধ সম্পন্ন মানুষ অওয়াজ তুলেছিলেন, ‘নো ভোট টু বিজেপি’– বিজেপিকে একটিও ভোট নয়। ২০১৯ সাল থেকেই এনপিআর-এনআরসিসিএএ বিরোধী যে আন্দোলন দেশে দানা বাঁধছিল ২০২০ তে এসে তা কিছুটা থমকে গিয়েছিল করোনার কারণে। কিন্তু এই আন্দোলনকে সারা ভারতে ছড়িয়ে দিয়েছিল একদিকে গণতন্ত্র প্রিয় সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত উদ্যোগ। প্রথম থেকেই সঠিক বামপন্থী রাজনীতির ভিত্তিতে এস ইউ সি আই (সি) সারা ভারতেই বিজেপি সরকারের এই আক্রমণের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তুলতে অত্যন্ত সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের মাটিতে এস ইউ সি আই (সি) দলের প্রচেষ্টাতেই সমাজের নানা স্তরের মানুষকে যুক্ত করে গড়ে উঠেছে ‘এনআরসি বিরোধী নাগরিক কমিটি’। যাতে দলমত নির্বিশেষে আইনজীবী, বুদ্ধিজীবী, খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ সহ ছাত্র-যুব-মহিলার সামিল হয়েছেন। পশ্চিমবঙ্গের নানা জেলায় বিভিন্ন সম্প্রদায়, দলিত, ও আদিবাসী সহ নানা জাতি গোষ্ঠীর মধ্যে বিজেপি সিএএ-কে নিয়ে যে মিথ্যা খোয়াব দেখানোর চেষ্টা করছিল তাকে অনেকটাই প্রতিহত করার কাজ করেছে এই এনআরসি বিরোধী গণকমিটি এবং তার নেতৃত্বে আন্দোলন।
বিজেপি সরকার করোনা মহামারির মধ্যে ৩টি কৃষক বিরোধী কৃষি আইন পাশ করিয়ে নেয়। কিন্তু ২০২০-র নভেম্বর থেকে যে একটানা কৃষক আন্দোলন দিল্লি সীমান্তে চলছে তা সারা দেশের সামনে বিজেপি সরকারের জনবিরোধী চরিত্র অনেকটা প্রকাশ্যে এনে দিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে এই কৃষক আন্দোলনের বার্তা গ্রামাঞ্চলে আলোড়ন তুলেছে। কিন্তু তাকে পশ্চিমবঙ্গের মাটিতে আন্দোলনের রূপ দেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে গেছে একমাত্র এস ইউ সি আই (সি)। বৃহৎ বামপন্থী বলে পরিচিত সিপিএম তার সাংগঠনিক শক্তিকে কাজে লাগিয়ে পশ্চিমবঙ্গে এ নিয়ে কোনও সুসংহত আন্দোলন গড়ে তোলেনি। অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি বিরোধিতার প্রধান দাবিদার তৃণমূল কংগ্রেস চাষিদের পক্ষে কিছু কথা বললেও কর্পোরেট পুঁজি মালিকদের চটানোর ঝুঁকি নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে কার্যত কিছু করেনি। শুধু তাই নয়, সংসদীয় স্ট্যান্ডিং কমিটিতেও কৃষি বিলের কোনও বিরোধিতা করেনি। এস ইউ সি আই (সি) দল এবং তার কৃষক সংগঠন, শ্রমিক সংগঠন সহ নানা গণসংগঠন লাগাতার এই নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের জেলায় জেলায় নানা কর্মসূচি চালিয়ে গেছে। যে প্রচেষ্টা তিল তিল করে বিজেপিকে রোখার জমি রাজ্য জুড়ে তৈরি করেছে। বিজেপি সরকার জাতীয় শিক্ষানীতি-১৯ এর মধ্য দিয়ে একদিকে যেমন সার্বজনীন সামগ্রিক শিক্ষা বন্ধ করে দিতে চেয়েছে। গরিব ঘরের সন্তানদের কেবলমাত্র অক্ষর পরিচয় এবং কিছু হাতের কাজ শেখানোর মধ্যেই আটকে রাখার পরিকল্পনা করেছে। সাধারণ ঘরের ছাত্রছাত্রীদের মাতৃভাষা সহ ইংরেজি শেখানোর দায়িত্বকে কার্যত ঝেড়ে ফেলে দিচ্ছে। শিক্ষার সামগ্রিক বেসরকারিকরণ করছে। সবচেয়ে উদ্বেগের হল তারা শিক্ষার বৈজ্ঞানিক ভিত্তিমূলেই আঘাত করছে। শিক্ষার নামে কুসংস্কার, ধর্মীয় গোঁড়ামি, অন্ধবিশ্বাসকে দেশে ছড়িয়ে দিতে চাইছে। এর বিরুদ্ধেও আন্দোলন গড়ে তুলছে এস ইউ সি আই (সি) দল। এই দলের উদ্যোগেই গড়ে উঠেছে সেভ এডুকেশন কমিটি। যে গণকমিটি সমাজের বিশিষ্ট মানুষ, শিক্ষাবিদ সহ বহু পেশার মানুষের মধ্যে ধর্ম-বর্ণ-সম্প্রদায়-রাজনৈতিক বিশ্বাস নির্বিশেষে বিজেপির সর্বনাশা শিক্ষানীতিকে যে কোনও মূল্যে রোখার মন-মানসিকতা তৈরি করছে।
পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি মারাত্মকভাবে সাম্প্রদায়িক প্রচার শুরু করেছিল। আট দফা ভোটের প্রতিটি দফাতেই প্রচারে তারা যে ভাষায় উগ্র সাম্প্রদায়িক উস্কানি দিয়েছে তা এ রাজ্যে অতীতে মানুষ কখনও শোনেনি। তাদের বিজ্ঞাপনে পর্যন্ত প্রধান লক্ষ্য ছিল সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতি সংখ্যাগুরুর বিদ্বেষ জাগিয়ে তোলা। দেখানোর চেষ্টা করছিল পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষের রক্ষাকর্তা হল বিজেপি। সাধারণ মানুষের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির হীন লক্ষ্যে এই মারাত্মক বিষাক্ত প্রচারের বিরুদ্ধে বিজেপি বিরোধী তৃণমূল কংগ্রেস প্রকৃত ধর্মনিরপেক্ষতার পরিবর্তে পাল্টা নরম হিন্দুত্বের আশ্রয় নিয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী থেকে শুরু করে তাদের প্রার্থীদের কাজই হয়েছিল মন্দিরে মন্দিরে ঘুরে, অথবা সভায় নানা মন্ত্র আউড়ে নিজেদের হিন্দুত্ব জাহির করা। অন্যদিকে সিপিএম কংগ্রেস জোট বিজেপির প্রচারে শঙ্কিত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ভোটকে নিজেদের ঝুলিতে নেওয়ার চেষ্টায় চরম সাম্প্রদায়িক এবং মৌলবাদী আব্বাস সিদ্দিকির হাত ধরেছে। দুপক্ষেরই এই ভূমিকায় বিজেপির সাম্প্রদায়িক রাজনীতিই যে মান্যতা পেয়ে যায়, এর ফলে যে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণে বিজেপির সুবিধা হয় তা এই সব দলের নেতৃত্ব বুঝতেই চাননি। এর বিপরীতে দাঁড়িয়ে এস ইউ সি আই (সি) তুলে ধরেছে যথার্থ ধর্মনিরপেক্ষতা কেন খেটে খাওয়া মানুষের স্বার্থেই প্রয়োজন সেই কথা। তুলে ধরেছে সংগ্রামী বামপন্থার ঝাণ্ডাকে। বাংলা তথা ভারতের নবজাগরণের মনীষীদের নাম আউড়ে তাঁদের শিক্ষার যে বিকৃতি বিজেপি ঘটাতে চাইছিল তার বিপরীতে এস ইউ সি আই (সি) তুলে ধরেছে নবজাগরণের প্রকৃত শিক্ষাকে। খেটে খাওয়া মানুষের লড়াইটা যে ধর্ম-বর্ণ-জাতপাত নির্বিশেষে একই, এই সত্য শুধু স্লোগানে নয়, এস ইউ সি আই (সি) তা তুলে ধরেছে একটানা চালিয়ে যাওয়া নানা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। শিক্ষার দাবি, বিদ্যুতের দাবি, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের মূল্যবৃদ্ধি রোখার দাবি, তেল-গ্যাসের লাগামছাড়া দাম কমানোর দাবিতে লাগাতার আন্দোলন গড়ে তুলেছে এই দল। আশা কর্মীদের দাবি, পৌর স্বাস্থ্যকর্মীদের দাবি, পরিচারিকাদের দাবি নিয়ে আন্দোলন গড়ে তুলেছে। একই সাথে ক্ষুদ্র-মাঝারি চাষি, খেতমজুর, গ্রাম এবং শহরের জব কার্ড হোল্ডার, যুবশ্রী এমপ্লয়মেন্ট ব্যাঙ্কে নাম লেখানো যুবক-যুবতীদের নিয়ে আন্দোলন করেছে এই দল। গণআন্দোলনই হল সেই শক্তি যা কার্যকরীভাবে সাম্প্রদায়িকতার মোকাবিলা করতে পারে। মহান মার্কসবাদী চিন্তানায়ক শিবদাস ঘোষের শিক্ষার আলোকে এই আন্দোলনকে এস ইউ সি আই (সি) নিছক কিছু নির্বাচনী সাফল্য জোগাড়ের লক্ষ্যে পরিচালিত করেনি। করেছে সংগ্রামী বামপন্থার মর্যাদাকে প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে। আন্দোলনে যে মানুষগুলি এসেছেন, তারা ভোট ব্যাঙ্কের রাজনীতির হিসাব কষার বদলে মর্যাদাময় জীবনের স্বপ্ন দেখতে শিখেছেন।
এই হল সেই শক্তি যার দ্বারা বিজেপির ফ্যাসিবাদী রাজনীতি, সাম্প্রদায়িক বিভেদের রাজনীতি, মানুষকে বিভক্ত করে রেখে একচেটিয়া কর্পোরেট পুঁজিপতিদের সেবা করার রাজনীতিকে মোকাবিলা করা সম্ভব। বিজেপির সর্বনাশা রাজনীতিকে রোখার জন্য নির্বাচনে যে ভূমিকা পালন করেছে এস ইউ সি আই (সি) তাকে কেবলমাত্র ভোট সংখ্যা বা আসন সংখ্যা দিয়ে বোঝা যাবে না। যথার্থ বামপন্থার শক্তি হিসাবে তা প্রতিক্রিয়ার শক্তির বিরুদ্ধে দেওয়াল তুলেছে। এই সংগ্রামী বামপন্থার রাজনীতিকে বাংলার সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী, সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী মানুষ সাদরে গ্রহণ করেছেন। ভোটের নিরিখে কে হারবে কে জিতবে হিসাব কষে বিজেপিকে রোখার জন্য ভোটটা যারা তৃণমূলকেও দিয়েছেন, তারাও অনেকে বলেছেন, সঠিক রাজনৈতিক বক্তব্য তুলে ধরেছে একমাত্র এস ইউ সি আই (সি)। এই রাজনীতির শক্তি যত বাড়বে তত দুষ্ট রাজনীতিকে মোকাবিলা করার শক্তি বাড়বে।