এ বারের বিধানসভা নির্বাচনে প্রকৃত অর্থে জয়ী হয়েছে বাংলার সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী চেতনা। সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে, ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে, ক্ষমতার দম্ভ, অর্থের ঔদ্ধত্য, জনবিরোধী আর্থিক নীতির বিরুদ্ধে বাংলার মানুষ সচেতন ভাবে তাদের রায় দিয়েছেন। এই রায়ের দ্বারা প্রমাণ হল, রামমোহন, বিদ্যাসাগর থেকে শুরু হয়ে একদিকে রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, নজরুল, অন্য দিকে ক্ষুদিরাম, মাস্টারদা, দেশবন্ধু, নেতাজি প্রমুখের চিন্তা ও কর্মে সমৃদ্ধ। নবজাগরণের চেতনা, স্বাধীনতা আন্দোলনের চেতনা আজও বাংলার মানুষ তাদের চিন্তায় ও কর্মে বহন করে চলেছে। কংগ্রেস, সিপিএম, তৃণমূলের শাসনে তাদের কার্যকলাপ এর অনেক ক্ষতি করতে পারলেও আজও যা অবশিষ্ট রয়েছে তা দিয়েই বাংলার মানুষ বিজেপির মতো একটা উগ্র সাম্প্রদায়িক এবং শক্তিশালী ফ্যাসিস্ট শাসক শক্তিকে রুখে দিতে পেরেছে। স্বাভাবিক ভাবেই এই রায়। সারা দেশে বাংলার মানুষের উদারবাদী মানসিকতাকে, ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে কঠোর মনোভাবকে মর্যাদার সঙ্গে উঁচুতে তুলে ধরেছে। অথচ বিজেপি তো কম চেষ্টা করেনি। বাংলার শাসনক্ষমতার দখল নিতে সে কার্যত তার সব শক্তি নিয়োগ করেছিল। গোটা সংগঠনকে সে এই নির্বাচনে নামিয়ে দিয়েছিল। দেশের প্রধানমন্ত্রী এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী একটি রাজ্যের নির্বাচনে জিততে শত কোটি টাকার বিমান খরচ করে নিত্যযাত্রীর ভূমিকা নিচ্ছেন, যা নজিরবিহীন। তারা ছাড়াও তাদের নানা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীরা, সর্বভারতীয় পদাধিকারীরা অজস্র সভা করেছেন। প্রধানমন্ত্রী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সহ সব নেতারাই একদিকে যেমন প্রতিশ্রুতির ফুলঝুরি ছুটিয়েছেন, তেমনই প্রত্যেকের লক্ষ্য ছিল তীব্র সাম্প্রদায়িক প্রচার তুলে ধর্মীয় মেরুকরণ ঘটানো। তারা প্রায় প্রতিটি বক্তৃতায় দেশভাগের স্মৃতিকে খুঁচিয়ে তুলেছেন, ‘ছোট ছোট পাকিস্তানের’ কথা বলেছেন, সংখ্যালঘুদের ঘাড় ধরে সীমান্ত পার করে দেওয়ার কথা বলেছেন, তারা জয়ী হলে উত্তরপ্রদেশের মতো এ রাজ্যেও ‘অ্যাষ্টি-রোমিও’ পুলিশের কথা, লাভ জিহাদ আইন তৈরির কথা বলেছেন। কিন্তু কেন্দ্রে বিজেপির সাত বছরের শাসন এবং রাজ্যে রাজ্যে বিজেপি শাসনের অভিপ্রতা এতই তিক্ত ও মর্মান্তিক যে, বিজেপি নেতাদের এই শুন্যগর্ভ প্রতিশ্রুতি কিংবা তীব্র সাম্প্রদায়িক প্রচার কোনও কিছুই মানুষের বিচারবুদ্ধিকে গুলিয়ে দিতে পারেনি। বিজেপির হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তানের রাজনীতিকে বাংলার মানুষ প্রত্যাখ্যান করেছে।
মানুষ ভুলতে পারেনি এক বছর আগেকার সেই রাতারাতি লকডাউন ঘোষণার কথা, যা লক্ষ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিকের জীবনকে নরক করে তুলেছিল। সন্তান কাঁধে নিয়ে বৃদ্ধ বাবা-মা, স্ত্রীর হাত ধরে সেই হাজার হাজার কিলোমিটার পথ হাঁটার কষ্টের কথা কি মনুষ ভুলতে পারে। ভুলতে পারে কি পথশ্রমে, খিদে-তেষ্টায় ক্লান্ত শ্রমিকদের সেই পথেই প্রাণত্যাগের ঘটনা! লকডাউনে কাজ হারিয়েছেন কয়েক কোটি মানুষ। ভিক্ষার মতো কয়েক মাস রেশন দিয়েই তা বন্ধ করে দিয়েছে বিজেপি সরকার। কর্মহীন, অন্নহীন, চিৎিসাহীন মানুষ যখন বাঁচার আশায় সরকারের কাছে সাহায্যের আবেদন করে চলেছে তখন প্রধানমন্ত্রী ব্যস্ত থেকেছেন হাজার হাজার কোটি টাকা খরচে রামমন্দির নির্মাণের জন্য ভূমিপুজোয়। বিজেপি নেতারা নিশ্চয় ভেবেছিলেন ধর্মের জিগির তুলে তারা মানুষকে খিদের কথা ভুলিয়ে দিতে পারবেন। বাস্তবে পারেননি। করোনা মহামারিতে মানুষ যখন দেশজুড়ে প্রতিদিন হাজারে হাজারে মারা যাচ্ছে, হাসপাতালে বেড পাচ্ছে না, অক্সিজেন পাচ্ছে না, ভ্যাসিনের সরবরাহ নেই মানুষ দিনের পর দিন লাইনে দাঁড়িয়ে ফিরে আসছে, দিলি সহ সর্বত্র গণচিতা জ্বলছে তখন প্রধানমন্ত্রী দিল্লি সাজাতে তার সাধের প্রকল্প ‘সেন্ট্রাল ভিস্টা’ সফল করতে কুড়ি হাজার কোটি টাকা খরচ করছেন। মানুষ প্রধানমন্ত্রীর এই অমানবিকতাকে ঘৃণা করেছে, দেশের মানুষের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা বলে মনে করেছে, মনুষ্যত্বের অপমান বলে মনে করেছে।
মানুষ যখন রোজাগারহারা হয়ে কার্যত দিশেহারা তখন কেন্দ্রের বিজেপি সরকার লাগাতার গ্যাসের দাম, কেরোসিনের দাম বাড়িয়েছে, ডিজেল-পেট্রোলের দাম বাড়িয়েছে, এমনকি নির্বাচন চলার সময়েও সারের দাম দ্বিগুণ করে দিয়েছে। নিম্নবিত্ত, অবসরপ্রাপ্ত মানুষদের অনেকেরই একমাত্র অবলম্বন স্বল্পসঞ্চয়ের সুদকে তলানিতে নিয়ে গেছে। সরষের তেল সহ নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রতিটি জিনিসের দাম লাফিয়ে বেড়েছে, অথচ সরকার চুপ করে থেকেছে। বিজেপি সরকারের কৃষিনীতি কার্যত গোটা কৃষিব্যবস্থাটিকে একচেটিয়া পুজির হাতে তুলে দেওয়ার দাসখত। তার বিরুদ্ধে কৃষকদের প্রতিবাদকে সরকার অবজ্ঞা করেছে, নির্মম ভাবে দমন করেছে, আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করেছে। দেশের বেশির ভাগ অংশ কৃষকরা এবং তাদের উপর নির্ভরশীল সাধারণ মানুষ সরকারের অমানবিক, অগণতান্ত্রিক আচরণকে একেবারেই ভাল ভাবে নেয়নি। বিজেপি সরকার যে শিক্ষানীতি নিয়েছে তারও একমাত্র উদ্দেশ্য শিক্ষাকে পুঁজিপতিদের হাতে মুনাফার পণ্য হিসাবে তুলে দেওয়া। মানুষ সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে আতঙ্কিত হয়েছে। বিজেপি সরকার কর্মসংস্থানের কোনও ব্যবস্থাই করতে পারেনি। দেশ ছেয়ে গেছে কর্মহীন যুবক-যুবতীতে। বিজেপির বিরুদ্ধে পিএম কেয়ার্স ফাল্ড, নির্বাচনী বন্ড, যুদ্ধবিমান কেনা নিয়ে দুর্নীতির এত অভিযোগ উঠেছে যে তৃণমুলের দুর্নীতির বিরুদ্ধে তোলা তাদের অভিযোগগুলি সত্যি হলেও মানুষের কাছে তা গুরুত্বহীন হয়ে গেছে। বিজেপি নেতাদের প্রতিদিন হেলিকপ্টার, বিমানে যাতায়াত, ফাইভ স্টার হোটেলের বিলাসবহুল জীবন, অর্থ এবং বৈভবের চোখধাঁধানো প্রকাশ দেখে রাজ্যের সাধারণ মানুষ এই সব নেতাদের নিজেদের দুঃখময় জীবনের সহমর্মী বলে ভাবতে পারেনি। বিজেপির আইটি সেল সোসাল মিডিয়ায় মিথ্যা প্রচারের ঝড় তুলেছে। হাজার হাজার কোটি টাকার বিজ্ঞাপনে মানুষের মুখ ঢেকে দিয়েছে। নির্বাচন কমিশনের কার্যকলাপ কার্যত বিজেপিকেই সব দিক থেকে সুবিধা করে দিয়েছে। কেন্দ্রীয় বাহিনীকেও তারা ইচ্ছামতো কাজে লাগিয়েছে। কিন্তু কেন্দ্রের শাসক দল হিসাবে বিজেপির দাপট কিংবা তাদের নেতাদের বিলানো ধর্মান্ধতা ও সাম্প্রদায়িকতার আফিম বাংলার মানুষের চেতনাকে আচ্ছন্ন করতে পারেনি। অথচ রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধেও মানুষের ক্ষোভ কম ছিল না। তা সত্ত্বেও বাংলার মানুষের চেতনা তাকে বিবেচনায় ভুল করতে আপাতত মানুষের রায় ফ্যাসিস্ট শক্তিকে ক্ষমতা থেকে দূরে রাখতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু বিজেপির সাম্প্রদায়িক রাজনীতি সম্পূর্ণ পরাস্ত হয়ে গেছে, এটা ভাবা ভুল। পুঁজিপতি শ্রেণি নিজের স্বার্থে এদের বাঁচিয়ে রাখবে এবং আবার সামনে আনার চেষ্টা করবে। নির্বাচনী দীর্ঘ প্রচারে কম বিষ ছড়াননি বিজেপি নেতারা। সেই বিষ পরিষ্কার করার দায়িত্ব সচেতন মানুষকেই নিতে হবে। | তার জন্য আদর্শগত ভাবে, রাজনৈতিক ভাবে বিজেপিকে নীতি ও রাজনীতির বিরুদ্ধে আপসহীন সংগ্রাম পরিচালনা করতে হবে। মনে রাখতে হবে, মেহনতি মানুষের ধর্ম একটাই, জাত একটাই তারা শোষিত। রুটি-রুজির সংগঠিত আন্দোলনে, শোষণ-নিপীড়ন, বেকারি-গরিবির বিরুদ্ধে, শিক্ষা-চিকিৎসার অধিকার রক্ষার লড়াইয়ে অংশ নেওয়া মানুষের তাই কোনও ধর্ম হয় না, জাত হয় না, বরং ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মানুষের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনই একমাত্র পরে তার অধিকার ছিনিয়ে আনতে।