সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলির কুম্ভীরাশ্রুতে বিভ্রান্ত হবেন না

ভারত ও বাংলাদেশ এক সময় একটি দেশেরই অন্তর্ভুক্ত ছিল। দুই দেশের সাধারণ মানুষের মতামতের বিরুদ্ধে গিয়েই সাম্রাজ্যবাদী শাসক ইংরেজ এবং হিন্দু ও মুসলিম সাম্প্রদায়িক সংগঠনগুলির ষড়যন্ত্রে ঘটেছিল দেশবিভাগ। ভারত ও বাংলাদেশের অবস্থান পাশাপাশি হওয়ায়, বাংলাদেশ এবং এই পশ্চিমবঙ্গে ভাষা এক হওয়ায় এবং উভয় ধর্মের মানুষেরই উভয় দেশে আত্মীয়-স্বজন থাকায় দেশবিভাগের তিক্ততাকে অতিক্রম করে অর্থনৈতিক লেনদেনের পাশাপাশি দুই দেশের মধ্যে সাংস্কৃতিক আদানপ্রদানও দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে।

মাত্র চার মাস আগে গত আগস্টে সারা বিশ্বের মানুষ দেখল, বাংলাদেশের ছাত্র-জনতা এক ঐতিহাসিক আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে কী ভাবে ফ্যাসিবাদী আওয়ামি লিগ সরকারকে গদিচ্যুত করল। কোটা বিরোধী ছাত্র আন্দোলন ধীরে ধীরে বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে রূপান্তরিত হয় এবং পরে তা সরকার বিরোধী আন্দোলনের রূপ নেয়। আওয়ামি লিগ সরকার সেই আন্দোলনকে রক্তের বন্যায় ভাসিয়ে দেয়। কিন্তু তাতেও শেষ রক্ষা হয় না। হাসিনা সরকারের পতন হয় এবং শেখ হাসিনা দেশ থেকে পালিয়ে ভারত সরকারের আশ্রয় নেন। এই আন্দোলনে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে ছাত্র জনতা পাশাপাশি দাঁড়িয়ে পুলিশের অত্যাচার সহ্য করেছে, জেলে গিয়েছে, গুলিতে প্রাণ দিয়েছে।

কিন্তু কিছুদিন পর থেকেই দেখা গেল বাংলাদেশের পরিবেশ খানিকটা উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। সংখ্যালঘু হিন্দুদের ওপর আক্রমণের কয়েকটি ঘটনা ঘটে গেছে এবং সেগুলিকে শতমুখে প্রচার করে ‘বাংলাদেশে হিন্দুরা বিপন্ন’ ধুয়া তুলে প্রবল শোরগোল ফেলেছে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ও সোসাল মিডিয়া এবং এ দেশের মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক সংগঠনগুলি। এই প্রচারে প্রভাবিত হয়ে পড়ছে এ দেশের বহু মানুষ। কিন্তু বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নানা সূত্রে উঠে আসছে অন্য ছবি।

বাস্তবে এই আন্দোলন যেহেতু ছিল স্বৈরাচারী হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে এবং আন্দোলনের উপর যেহেতু হাসিনা সরকার নির্মম অত্যাচার চালিয়েছিল, তাই বিজয়ের পর জনগণের রোষ গিয়ে পড়ে হাসিনার দল আওয়ামি লিগের নেতা-কর্মীদের উপর– যাঁদের অনেকেই আন্দোলনকারীদের উপর অত্যাচারে হাত লাগিয়েছিল। এই নেতা-কর্মীদের মধ্যে হিন্দু-মুসলমান দুই ধর্মের মানুষই আছে। কিন্তু বাংলাদেশ যেহেতু মুসলিম প্রধান তাই হিন্দু আওয়ামি লিগ নেতা-কর্মীদের উপর প্রতিশোধের মনোভাবকে হিন্দুদের উপর আক্রমণ হিসাবে দেখাতে শুরু করে বাংলাদেশের হিন্দু মৌলবাদী সংগঠনগুলি। ভারতের হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলি তাদের সুরে সুর মেলায়। পাশাপাশি, বিরোধী জামায়তে ইসলাম এবং বিএনপি ইসলামপন্থী রাজনীতির চর্চা করায় বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের সাধারণ মানুষ মূলত ছিল আওয়ামি লিগের সমর্থক– ঠিক যেমন ভারতে সংখ্যালঘু অংশের মানুষ হিন্দুত্ববাদী বিজেপির বিরোধী শাসক দলগুলিকেই সমর্থন করে। এই অবস্থায় বাংলাদেশের সংখ্যাগুরু মৌলবাদী সংগঠনগুলি নিজেদের সক্রিয় করে তুলতে এবং জনমনে জায়গা করতে আওয়ামি লিগ বিরোধী মনোভাবকে কাজে লাগিয়ে সে দেশের হিন্দুদের আক্রমণের নিশানা করে। যদিও এ কথা সত্যি যে, বৈষম্য বিরোধী আন্দোলন সে দেশে গণতান্ত্রিক দাবিগুলিকে সামনে রেখে যে ভাবে লড়াই করেছে, তা উভয় ধর্মের মানুষের মধ্যে একটা ঐক্যের বাঁধন তৈরি করে দিয়েছে। সেই বাঁধনটাই সংখ্যাগুরু মৌলবাদীদের এই আক্রমণকে অনেকখানি সংযত থাকতে বাধ্য করেছে। দেখা গেছে, মৌলবাদীদের আক্রমণ রুখতে বৈষম্য বিরোধী ছাত্রমঞ্চের সদস্যরা রাত জেগে হিন্দুদের মন্দির এবং ব্যবসা-সম্পত্তি পাহারা দিয়েছে। এটি একটি লক্ষণীয় ইতিবাচক দিক।

বাংলাদেশের হিন্দুদের আওয়ামি লিগকে সমর্থন করার মানে এই ছিল না যে, আওয়ামি লিগ সরকার হিন্দুদের স্বার্থের রক্ষক। বাস্তবে হিন্দুদের এই সমর্থনকে আওয়ামি লিগ ভোটব্যাঙ্ক হিসাবেই কাজে লাগিয়েছে। আবার যখন তার সংখ্যাগুরু ভোটব্যাঙ্কে ফাটল দেখা দিয়েছে তখন অনায়াসে হিন্দু মন্দিরের উপর আক্রমণ, দুর্গাপুজোয় বাধা দেওয়ার মতো ঘটনা ঘটতে দিয়ে একদিকে মুসলিম ভোটব্যাঙ্ক রক্ষা করেছে, অন্য দিকে সংখ্যালঘু হিন্দুদের ত্রাতা হিসাবে নিজেকে হাজির করেছে। ঠিক যে ঘটনা স্বাধীনতার পর থেকে ভারতেও ঘটে চলেছে। সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে দীর্ঘ সময় সংখ্যলঘুরা কংগ্রেসকে সমর্থন করলেও কংগ্রেস শাসনে দেশে নানা সময়ে ছোট-বড় অসংখ্য দাঙ্গা সংগঠিত হয়েছে। দেখা গেছে, সেগুলিতে নেতৃত্ব দিয়েছেন কংগ্রেস নেতারাই। কংগ্রেস প্রকাশ্যে বলেছে, এত দিন তারা সংখ্যালঘুর রাজনীতি করেছে, এখন সংখ্যাগুরুর রাজনীতি করবে। অর্থাৎ হিসাবটা ভোটের। এ রাজ্যে যত দিন সিপিএম শাসনক্ষমতায় ছিল, রাজ্যের সংখ্যালঘুরা তাদেরই সমর্থক হিসাবে পরিচিত ছিল। শাসক দলের বদল ঘটতেই এই সমর্থন বদলে তৃণমূল কংগ্রেসের ঝুলিতে আসে। তার মানে এই নয় যে, এই সব শাসক দলগুলি সংখ্যালঘুদের হিতাকাঙ্খী। দীর্ঘ ৩৪ বছর এ রাজ্যে সিপিএম ক্ষমতায় থাকার পরও সংখ্যালঘুদের আর্থিক অবস্থা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা কোন তলানিতে পৌঁছেছিল ২০০৬ সালে সাচার কমিশনের রিপোর্ট তা প্রকাশ্যে এনেছিল। তৃণমূল শাসনেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। আসলে পুুঁজিবাদী শাসনে সংখ্যালঘু, সংখ্যাগুরু প্রত্যেকেই শোষিত-বঞ্চিত।

বাংলাদেশের সাম্প্রতিক পরিস্থিতিকে উপলক্ষ করে এ রাজ্যে বিজেপি নেতাদের ভয়ঙ্কর রকমের সক্রিয় হয়ে ওঠার ঘটনা কারও চোখ এড়ায়নি। কেন্দ্রের বিজেপি সরকার এ নিয়ে যতটা না সক্রিয় এ রাজ্যের বিজেপি নেতারা সে দেশের সংখ্যালঘু-স্বার্থের চ্যাম্পিয়ন হিসাবে নিজেদের তুলে ধরতে এবং এ রাজ্যে হিন্দু ভোটকে সংহত করতে তার থেকে বেশি সক্রিয় হয়ে পড়েছে। রাজ্যের এক শীর্ষ নেতা তো এমনকি পেট্রাপোল সীমান্তে সভা করে দুই দেশের আর্থিক লেনদেন বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি পর্যন্ত দিয়েছেন। যদিও দুই দেশের বাণিজ্যিক আদান-প্রদান একই রকম ভাবে চলছে এবং ভারত সরকার এমন কোনও ইঙ্গিত এখন পর্যন্ত দেয়নি। এই নেতারাই এ দেশে সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে ঘৃণা তৈরির লক্ষে্য অবিরত বিষোদগার করে চলেছেন। এ দেশে মূল্যবৃদ্ধি, বেকারত্ব, দুর্নীতি প্রভৃতি যে সব সমস্যাগুলি ধর্ম নির্বিশেষে সাধারণ মানুষের জীবনকে জেরবার করে দিচ্ছে তা নিয়ে এই নেতাদের টুঁ শব্দ করতে দেখা যায়নি। সম্প্রতি আর জি করে চিকিৎসক ছাত্রীর ধর্ষণ ও খুনের বিরুদ্ধে এবং স্বাস্থ্যক্ষেত্রে দুর্নীতি ও থ্রেট সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে গোটা রাজ্য উত্তাল হয়ে উঠলেও এই সব নেতাদের তাতে সামিল হতে দেখা যায়নি। প্রথম দিকে এই গণআন্দোলনকে সরকার বিরোধী আন্দোলনে পরিণত করে ক্ষমতায় যাওয়ার রাস্তা প্রশস্ত করার চেষ্টা ব্যর্থ হলে রণে ভঙ্গ দেন তাঁরা। তাঁরাই আজ বাংলাদেশের উদ্ভূত পরিস্থিতিকে পুঁজি করে সাম্প্রদায়িক রাজনীতিতে নেমে পড়েছেন। বাংলাদেশে হিন্দুদের একাংশ যে আক্রমণের সম্মুখীন হচ্ছেন, তাকে সে দেশের হিন্দুদের ওপর মুসলমানদের আক্রমণ হিসাবে প্রচার করছেন। অথচ বাস্তবে বাংলাদেশের নাগরিকদের একটি ছোট অংশই শুধু মৌলবাদী সংগঠনগুলির সঙ্গে যুক্ত। বাকি অধিকাংশ নাগরিকই অন্য ধর্মের দেশবাসীর প্রতি আদৌ বিদ্বেষের মনোভাব নিয়ে চলেন না। ঠিক যেমন ভারতের হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষের সংখ্যগরিষ্ঠ অংশেরই দেশের মুসলমান নাগরিকদের প্রতি বিন্দুমাত্র বিদ্বেষ নেই। বিজেপিকে যাঁরা ভোট দেন তাঁরাও এমনকি বিজেপির হিন্দুত্ববাদী মতাদর্শের অনুগামী নন। তাঁদের বেশির ভাগই সাধারণ মানুষ, যারা দু-বেলা দু-মুঠো খাবারের সন্ধান করতেই বেশি ব্যস্ত থাকেন– হিন্দুত্ববাদ নিয়ে মাথা ঘামানোর মতো সময় তাঁদের নেই।

মনে রাখতে হবে ভারত এবং বাংলাদেশ– দুই দেশেরই সাম্প্রদায়িক শক্তি একে অপরের পরিপূরক এবং একে অপরকে শক্তিশালী করছে। যখন চরম দারিদ্র, মূল্যবৃদ্ধি, বেকারত্ব, ছাঁটাই ইত্যাদি পুঁজিবাদসৃষ্ট সংকটে জনজীবন চূড়ান্তভাবে বিপর্যস্ত এবং এই সবের বিরুদ্ধে সকল সম্প্রদায়ের শ্রমিক-কৃষক-মধ্যবিত্ত জনগণের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম একান্ত প্রয়োজন, তখন সাম্প্রদায়িকতা সেই ঐক্যকেই বিনষ্ট করছে। দুই দেশের ক্ষেত্রেই কথাটি সত্য। দুই দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষই আজ পুঁজিবাদী ব্যবস্থার ফল হিসাবে অসংখ্য সংকটে জর্জরিত। রুটি-রুজি, শিক্ষা-স্বাস্থ্য বা গণতান্ত্রিক অধিকারের দাবিতে যখনই তাঁরা বিক্ষোভে ফেটে পড়েন, সেখানে ধর্ম-বর্ণ-জাতপাতের ভেদাভেদ থাকে না। কারণ পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় মালিকী শোষণ কোনও মানুষকেই রেয়াত করে না, সে তিনি যে ধর্মেরই হোন না কেন। বাংলাদেশের জনসাধারণের ক্ষেত্রেও এ জিনিস বারে বারে দেখা গিয়েছে– মুক্তিযুদ্ধ, এরশাদ বিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনেও। ধর্ম নির্বিশেষে মানুষের এই ঐক্য বাংলাদেশে যথেষ্ট সক্রিয়। এই শক্তি অতীতের মতোই এ বারও বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলিকে নিশ্চয় পরাস্ত করতে সক্ষম হবে।

সংখ্যালঘুদের উপর আক্রমণই হোক কিংবা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাই হোক, তা কখনওই কোনও ধর্মের সাধারণ মানুষ সংগঠিত করে না। এর মূল কারণ রাজনৈতিক। অর্থাৎ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থেকেই কিছু ধুরন্ধর রাজনৈতিক শক্তি এমন আক্রমণ বা দাঙ্গায় মদত দিতে থাকে। যতই সম্প্রদায়গত স্বার্থের কথা বলুক, কোনও দেশের কোনও সাম্প্রদায়িক সংগঠনই সেই সম্প্রদায়ের যথার্থ বন্ধু হতে পারে না। সম্প্রদায়ের স্বার্থের কথা বলে বাস্তবে তারা শুধুমাত্র নিজেদের স্বার্থকে চরিতার্থ করে এবং শোষক পুঁজিপতি শ্রেণির বিরুদ্ধে লড়াই থেকে বিরত রাখে। তাই বিজেপি এবং তার সহযোগী শক্তিগুলি যখন বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের নামে চোখের জল ফেলে তখন তাকে কুমীরের চোখের জল ছাড়া আর কী-ই বা বলা যায়। এরা বাংলাদেশ নিয়ে যে আবেগ দেখাচ্ছে তার ছিটেফোঁটাও নেই মণিপুর নিয়ে। ফলে ভণ্ডামি আজ নগ্ন। এদের মতলববাজ রাজনীতির ফাঁদে পা দিয়ে অপপ্রচারের স্রোতে ভেসে গেলে চলবে না। এটা আনন্দের বিষয় যে, বাংলাদেশের মুসলিম-হিন্দু নির্বিশেষে শুভবুদ্ধির মানুষেরা এই দুষ্ট রাজনীতির প্রতিবাদ জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন।