কাজ করল না প্রধানমন্ত্রীর বিদ্বেষ-বিষ ছড়িয়ে বিভাজনের চেষ্টা। হিন্দু ভোটকে একত্রিত করতে রামমন্দির তৈরি এবং নির্মাণ শেষ হওয়ার অনেক আগেই বহু আড়ম্বরে তার উদ্বোধনও ব্যর্থ হয়েছে। খোদ অযোধ্যা যে-লোকসভার অন্তর্গত উত্তরপ্রদেশের সেই ফৈজাবাদ কেন্দ্রেই পরাজিত হয়েছে বিজেপি। বিভেদ তৈরির লক্ষ্য থেকে রাজস্থানের যে বাঁশওয়াড়া কেন্দ্রে প্রথম মোদি বলেছিলেন, বিরোধীরা জিতলে হিন্দুদের সম্পত্তি, এমনকি মহিলাদের মঙ্গলসূত্রও অনুপ্রবেশকারী মুসলমানদের মধ্যে বিলিয়ে দেবে, সেই কেন্দ্রেও বিজেপি পরাস্ত হয়েছে। গুজরাটের যে কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে মুসলমানদের বিরুদ্ধে হিন্দুদের বিক্ষুব্ধ করে তুলতে বলেছিলেন, বিরোধীরা জয়ী হলে হিন্দুদের বাড়িতে দুটি মহিষ থাকলে একটি কেড়ে নিয়ে মুসলমানদের দিয়ে দেবে সেই বনসকন্থা আসনে বিপুলভাবে জয়ী হয়েছে কংগ্রেস। নিজেকে পরমাত্মার প্রেরিত দূত হিসাবে নরেন্দ্র মোদির ঘোষণাও কাজ করেনি। ভয়াবহ বেকারত্ব, ব্যাপক মূল্যবৃদ্ধি রোধে মোদি সরকারের ব্যর্থতা, কৃষকদের ফসলের ন্যায্য দাম ও এমএসপির দাবি, কৃষক আন্দোলনে দমন-পীড়ন– এই সব কিছু শাসক বিজেপির সাম্প্রদায়িক প্রচারকে ছাপিয়ে গেছে। সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে প্রত্যাখান করেছে মানুষ। গুরুত্ব দেয়নি মোদির গ্যারান্টিকেও।
প্রধানমন্ত্রী, স্বারাষ্ট্রমন্ত্রী সহ বিজেপি নেতাদের সীমাহীন ঔদ্ধত্য, যা খুশি করার মনোভাব, শ্রমজীবী মানুষের প্রতি চরম উপেক্ষা, একচেটিয়া পুঁজির নির্লজ্জ দাসত্ব সাধারণ মানুষের মধ্যে যে সরকার বিরোধী মনোভাবের জন্ম দিয়েছিল তারই প্রকাশ ঘটেছে নির্বাচনের ফলে। একক ভাবে ৪০০ আসন পার করা দূরের কথা, একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা থেকেই বহু দূরে থেকে গেল বিজেপি।
২০১৪তে কংগ্রেস সরকারের ব্যাপক দুর্নীতির এবং জনবিরোধী নীতির বিরুদ্ধে ক্ষিপ্ত মানুষ কংগ্রেস সরকারের পতন ঘটিয়েছিল। আচ্ছে দিনের স্লোগান দিয়ে, ১০০ দিনের মধ্যে মূল্যবৃদ্ধি রোধ করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে, বছরে ২ কোটি কর্মসংস্থানের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এসেছিল বিজেপি। বাস্তবে গত দশ বছরে মূল্যবৃদ্ধি, বেকারি আকাশ ছুঁয়েছে। মালিকী শোষণ মাত্রছাড়া হয়েছে। ধনী-দরিদ্রে ফারাক অতীতের সমস্ত সীমা ছাড়িয়ে গেছে। নতুন শিক্ষানীতিতে শিক্ষাব্যবস্থাকে পুরোপুরি বেসরকারিকরণ করে শিক্ষাকে পণ্যে পরিণত করা হয়েছে। সরকারি চিকিৎসার সুযোগ বাতিল করে স্বাস্থ্যকে স্বাস্থ্য-ব্যবসায়ীদের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে। সরকারি ক্ষেত্রে নিয়োগকে শূন্যে নামানো হয়েছে। সব মিলিয়ে সাধারণ মানুষের সমস্যা সমাধানে বিজেপি সরকার চরম ব্যর্থ। এই সরকারের বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভকে পুঁজি করে আজ আবার শক্তিবৃদ্ধি করেছে পুঁজিপতি শ্রেণির অপর বিশ্বস্ত দল কংগ্রেস এবং তার নেতৃত্বাধীন জোট।
এই অবস্থায় যে দল বা যে জোটই সরকার গড়ুক তাতে মানুষের জীবনে দুর্দশার পরিবর্তন আশা করার মতো কোনও কারণই নেই। নির্বাচনে শাসক দলগুলির কে কম, কে বেশি দুর্নীতিবাজ তাই নিয়ে কাদা ছোঁড়াছুড়ি, কুকথার বর্ষণ এবং ব্যাপক সাম্প্রদায়িক প্রচারে পিছনে চলে গিয়েছে মানুষের জীবনের জ্বলন্ত সমস্যাগুলি। স্পষ্টতই এগুলি নিয়ে শাসক-বিরোধী নেতাদের এতটুকু মাথা ঘামাতে দেখা যায়নি। নির্বাচনী প্রচারকে তুঙ্গে তুলতে শাসক এবং বিরোধী উভয় পক্ষই হাজার হাজার কোটি টাকা ঢেলেছে। কারা দিল এই টাকা? দিয়েছে পুঁজিপতিরা।
নতুন সরকারও তাই অতীতের মতোই জনগণ নয়, মালিক শ্রেণির স্বার্থ রক্ষা করেই চলবে। তাই নির্বাচন শেষ না হতে দুধের দামবৃদ্ধি ঘোষণা করে দিয়েছে সরকার। অন্য ক্ষেত্রগুলিতেও দামবৃদ্ধি কেবল সময়ের অপেক্ষা। চলতে থাকবে ব্যাপক বেসরকারিকরণ। বাড়বে আরও ছাঁটাই। এই অবস্থায় সাধারণ মানুষের জীবনের বাড়তে থাকা সঙ্কটের কোনও সুরাহা কোনও সরকারই করবে না। নূ্যনতম দাবি আদায় করতে হলেও সাধারণ মানুষের আজ আন্দোলন গড়ে তোলা ছাড়া আর কোনও রাস্তা নেই। তাই শোষিত মানুষকে আজ সঠিক নীতি এবং সঠিক নেতৃত্বে সংঘবদ্ধ হতে হবে এবং জীবনের দাবিগুলি নিয়ে ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। সাধারণ মানুষের সামনে বাঁচার জন্য এটিই একমাত্র রাস্তা।