এখন এ দেশে, বিশেষত বিজেপিশাসিত রাজ্যগুলিতে নিম্ন আদালতের কাজ কি মন্দির-মসজিদ বিতর্কে ইন্ধন দেওয়া? তা না হলে উত্তরপ্রদেশের সম্ভলের স্থানীয় আদালত কী করে একজন মাত্র আবেদনকারীর বক্তব্য শুনেই অতি দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে কয়েক ঘন্টার মধ্যে সেখানকার শাহী মসজিদের নিচে মন্দির খোঁজার জন্য সমীক্ষার কাজ শুরু করার নির্দেশ দিতে পারে? এর পরিণতিতে অশান্তি সৃষ্টি হলে পাঁচজন মানুষ পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারালেন। অথচ এই শাহী মসজিদ ভারত সরকারের নথিতে ‘ন্যাশনাল মনুমেন্ট’ হিসেবে স্বীকৃত, যা বর্তমানে টিকে থাকা ধর্মস্থানগুলির মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন স্থাপত্যগুলির অন্যতম।
এক পুরোহিত স্থানীয় আদালতে আবেদন করেছিলেন, তাঁর বিশ্বাস, এই মসজিদ নাকি বাবরের আমলে হরিহর মন্দির ভেঙে তৈরি হয়েছিল। এ দেশে এখন বিশ্বাসই যে ইতিহাস, বাস্তব, সত্যের উপরে স্থান পেতে পারে, তার নজির গড়ে রেখেছে বাবরি মসজিদ-রাম মন্দির মামলায় খোদ সুপ্রিম কোর্ট। ফলে অন্য পক্ষের বক্তব্য শোনার জন্য এতটুকু অপেক্ষা না করেই কয়েক ঘন্টার মধ্যে সমীক্ষা শুরু করাতে আদালতকে দ্বিতীয়বার ভাবতে হয়নি। ন্যায়বিচার তো অনেক দূরের বিষয়, এটা আদৌ কোনও বিচার বলেও কি বিবেচিত হতে পারে! যদিও বর্তমান ভারতে বিচারালয়গুলিতে প্রভাবশালী মহলের কাছে নতি স্বীকার না করা এবং অন্তত কিছুটা অর্থে ধর্মনিরপেক্ষ বিচারক, এমনকি তেমন আইনজীবীর দেখা পাওয়াও বেশ বিরল ঘটনা হয়ে উঠছে। সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বেঞ্চ ১৯৯১-এর উপাসনাস্থল সংক্রান্ত আইনের উল্লেখ করে নানা মসজিদে চলা এই ধরনের সমস্ত সমীক্ষা আপাতত বন্ধ রাখতে বলেছে। অবশ্য মসজিদের জমিতে মন্দির খোঁজার বিতর্কের প্যান্ডোরার বা’টির ঢাকনা আপাতত সুপ্রিম কোর্ট এঁটে দিলেও এর ভিতরের পোকাগুলি যে শীর্ষ আদালতের পুরনো কিছু রায়ে পুষ্টিলাভ করতে পেরেছে তা বললে খুব ভুল হবে না বোধহয়।
১৯৯১-এর উপাসনাস্থল আইনে বলা হয়েছিল, ১৯৪৭ সালে ভারতের স্বাধীনতার সময় কোনও ধর্মস্থানের চরিত্র যা ছিল তাকে এখন আর পাল্টানো যাবে না। সুস্পষ্ট এই নির্দেশিকা থাকা সত্ত্বেও ২০১৯-এ সুপ্রিম কোর্টে রাম জন্মভূমি-বাবরি মসজিদের বিষয়টিকে এই আইনের বাইরে আনা হয়েছিল। ধর্মীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর বিশ্বাসকে প্রাধান্য দেওয়ার নামে সেই দিন কেন একটা আইনের ব্যতিক্রম ঘটানো হল, কেনই বা সংবিধানে কথিত ধর্মনিরপেক্ষতারও ধার ধারল না দেশের সর্বোচ্চ আদালত– সেই প্রশ্নে আলোড়িত হয়েছিল দেশ। কিছুদিন পরেই তৎকালীন প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈ যখন রাজ্যসভার সদস্যপদ লাভ করলেন, দেশবাসীর মধ্যে স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠল, এটা কি তাঁর বিশেষ পুরস্কার বিজ্ঞানভিত্তিক অনুসন্ধান, ইতিহাস, যুক্তি, এমনকি আইন সমস্ত কিছুর ওপরে এক দল মানুষের বিশ্বাসকে স্থান দিয়ে সেদিন বিচারের নীতিকে মারাত্মকভাবে লঙ্ঘন করা হয়েছিল। সাম্প্রদায়িক রাজনীতির স্বার্থে শাসকদল বিজেপির ধর্মীয় মেরুকরণের অ্যাজেন্ডা চরিতার্থ হয়েছিল। কিন্তু এর ফলে প্রশাসনে, বিচারালয়ে আজও যতটুকু ধর্মনিরপেক্ষতা টিকে আছে তা ভীষণ ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
একই ঘটনার় পুনরাবৃত্তি দেখা গেছে ২০২২-এ জ্ঞানবাপী মামলার শুনানির সময়, মথুরার শ্রীকৃষ্ণের জন্মভূমি শাহি ঈদগা বা মধ্যপ্রদেশের কামাল-মওলা মসজিদের ক্ষেত্রে। দেখে মনে হয় যেন মসজিদের নিচে মন্দির ছিল, এই ধুয়ো তুলে আদালতে একবার মামলা করে ফেলতে পারলেই হল– আর কোনও সমস্যা নেই। এরপর হিন্দুত্ববাদীরা যেমনটি চায় আদালতে ঠিক তেমনটি ঘটতে থাকবে। আর বিজেপি এই ইস্যুটিকে নিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাবাবেগের দোহাই দিয়ে ভোটব্যাঙ্কের রাজনীতি করতে পারবে।
অযোধ্যা মামলার রায় ঘোষণার সময় দেশের শীর্ষ আদালত ঘোষণা করেছিল, ১৯৯১-এর উপাসনাস্থল আইন আর কখনও লঙ্ঘিত হবে না। অথচ জ্ঞানবাপী মামলায় এলাহাবাদ হাইকোর্ট সমীক্ষার নির্দেশ দিলে সর্বোচ্চ আদালতের তৎকালীন প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড় সেদিন তাতে স্থগিতাদেশ দেননি। এমনকি জ্ঞানবাপী মসজিদে পুজো করার নির্দেশেও ছাড়পত্র তিনি দিয়েছিলেন। এ ক্ষেত্রে ধর্মীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের বিশ্বাসই ছিল অজুহাত। জ্ঞানবাপী মামলায় বিচারপতি চন্দ্রচূড় মন্তব্য করেছিলেন, ১৯৯১ সালের উপাসনাস্থল আইনে নাকি উপাসনাস্থলের পুরনো চরিত্র নির্ধারণে সমীক্ষা চালাতে কোনও বাধা নেই। অবশ্য তিনি সম্প্রতি বলেছেন, এটা ছিল কেবলমাত্র মন্তব্য, একে রায়ের অংশ হিসাবে ধরার কারণ নেই। অথচ এই মন্তব্যের ভিত্তিতেই জ্ঞানবাপীতে পুজোপাঠ থেকে সমীক্ষা সবই চলতে দেওয়া হয়েছে। ধর্মীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ গোষ্ঠীর আস্থা অর্জন করতে গিয়ে বিচারব্যবস্থা যখন সংখ্যালঘু অংশের আস্থা হারিয়ে ফেলে, তাকে কি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বলা যায়? আসলে হিন্দু-মুসলিম বিরোধের স্থায়ী মীমাংসার জন্যই ভেঙে দেওয়া বাবরি মসজিদের জমিতেই রাম মন্দির তৈরির সিদ্ধান্ত– এ কথা বলা হলেও, এর মধ্য দিয়ে সেদিন সাম্প্রদায়িক বিভেদের যে বিষবৃক্ষ পোঁতা হয়েছে, তা আরও ডালপালা মেলেছে। এই পথ বেয়েই একটার পর একটা রাজ্যে বিজেপি ভোটের স্বার্থে মসজিদের নিচে মন্দির খোঁজার বাহানায় তাদের সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে পুষ্ট করতে পারছে।
বিশিষ্ট মার্ক্সবাদী দার্শনিক শিবদাস ঘোষ দেখিয়েছেন, শোষক ও শোষিতে বিভক্ত এই সমাজে রাষ্ট্রের অন্যতম স্তম্ভ রূপে বিচারবিভাগের ভূমিকা কখনও নিরপেক্ষ হতে পারে না। অন্য স্তম্ভগুলির মতোই পুঁজিবাদী রাষ্ট্রকাঠামোকে টিকিয়ে রাখতে এবং শাসক পুঁজিপতি শ্রেণির স্বার্থরক্ষায় বিচারবিভাগ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। অবশ্য মানুষ যাতে বিচারব্যবস্থার প্রতি একেবারে আাস্থা হারিয়ে না ফেলে তার জন্য মাঝে মাঝে জনগণের পক্ষেও কিছু কিছু রায় বিচারবিভাগ দিয়ে থাকে। এটা দেখিয়েই কর্পোরেট মালিকদের নিয়ন্ত্রিত সংবাদমাধ্যম নিপীড়িত মানুষকে বোঝায়– বিচারব্যবস্থাই তোমাদের শেষ আশ্রয়। তাদের উদ্দেশ্য প্রতিবাদের রাস্তায় যাওয়া থেকে মানুষকে বিরত করা। সম্ভলে পাঁচজন মানুষের রক্তের দাগ সহজে মোছার নয়। সেখানে যে বিভেদ, দাঙ্গা, হানাহানির পরিবেশ তৈরি হয়েছে, তার প্রতিষেধক কী? খেটে খাওয়া মানুষের ঐক্য বিনষ্টকারী সমস্ত অপচেষ্টা রুখে দিতে জনজীবনের সমস্যা নিয়ে ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ গণতান্ত্রিক আন্দোলনই এই ধরনের হীন কাজের সামনে প্রতিরোধ তৈরি করতে পারে।