Breaking News

সাম্প্রদায়িক অপচেষ্টা রুখে দেবে বাংলাদেশের ছাত্র-জনতা– এ আমার বিশ্বাসঃ প্রভাস ঘোষ

৫ আগস্ট কলকাতায় রানি রাসমণি অ্যাভেনিউতে বিশিষ্ট মার্ক্সবাদী চিন্তানায়ক কমরেড শিবদাস ঘোষ স্মরণ দিবস উপলক্ষে আয়োজিত সমাবেশে এস ইউ সি আই (সি)-র সাধারণ সম্পাদক কমরেড প্রভাস ঘোষ বলেন, বাংলাদেশের ছাত্রসমাজ এক ঐতিহাসিক আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। দিনের পর দিন লাঠি, গুলি, বেয়নেটের সম্মুখীন হয়ে কয়েকশো প্রাণ শহিদের মৃত্যুবরণ করার পরেও সরকারের পতনের দাবিতে সেখানকার ছাত্র-জনতা লড়ে যাচ্ছেন। বাংলাদেশে এ এক ব্যাপক গণঅভ্যুত্থান। আজকেও লক্ষ লক্ষ লোক রাস্তায়। একটু আগে খবর এসেছে এই জনগণের দাবিতে ওখানকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন। মিলিটারি ক্ষমতা হাতে নিতে চেয়েছিল। জনগণ তার বিরোধিতা করে বলছে, মিলিটারি শাসন নয়, অন্তর্বর্তী সরকার চাই। এখন তা নিয়ে আলোচনা চলছে। এ কথা আপনাদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, একদল প্রচার করছে, এর পিছনে ইসলামিক মৌলবাদী শক্তি জামাত, বিএনপি আছে– এটা আদৌ ঠিক নয়। আপনারা লক্ষ করলে দেখবেন, লক্ষ লক্ষ ছাত্রছাত্রীর কণ্ঠে রবীন্দ্রসঙ্গীত, নজরুলগীতি, দ্বিজেন্দ্রলালের গান, সত্য চৌধুরীর ‘মুক্তির মন্দির সোপান তলে’, এই সব গান যা এক সময় ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনে এই বাংলার যৌবনকে উজ্জীবিত করেছিল। বিপ্লববাদকে অনুপ্রাণিত করেছিল। যার প্রভাব গোটা ভারতবর্ষে সঞ্চারিত হয়েছিল। সেই গানই আজ বাংলাদেশের এই সংগ্রামী ছাত্র সমাজের কণ্ঠে। এই গান গেয়েই তারা শয়ে শয়ে শহিদের মৃত্যু বরণ করেছেন।

আপনারা জানেন কি না আমি জানি না, কুমিল্লার একটা ইউনিভার্সিটির ছাত্রীদের হোস্টেলে হলের নাম ছিল শেখ হাসিনার নামে। এই ছাত্রসমাজ সেই নাম পাল্টে দিয়ে নাম করেছে শান্তি এবং সুনীতির নামে। কে এই শান্তি-সুনীতি? এই বাংলার লোক অনেকে ভুলে গেছেন, দু’জনেই ছিলেন স্কুলছাত্রী। অত্যাচারী ব্রিটিশ জেলা ম্যাজিস্টে্রটকে গুলি করে শাস্তি বিধান করেছিলেন। সেই শান্তি ও সুনীতিকে স্মরণ করেই তারা হলের নাম রেখেছে। আজকের বাংলাদেশ অবিভক্ত বাংলার যে গৌরবময় ঐতিহ্য, সেই ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী হিসেবেই এক সময় তাঁরা ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলন করেছিলেন, ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করেছিলেন। ঠিক তেমনই আজকে ওই সংসদীয় রাজনীতির ধ্বজাধারী, শত শত ছাত্রের হত্যাকারী শেখ হাসিনার পদত্যাগের দাবিতে সেখানকার ছাত্র-জনতা লড়াই করে যাচ্ছেন।

এই আন্দোলন ভারতবর্ষের বিরুদ্ধে নয়। ভারতবর্ষের জনগণের বিরুদ্ধে নয়। ভারতীয় শিল্পপতি এবং পুঁজিপতিরা যারা এই দেশকে লুণ্ঠন করছে তারা বাংলাদেশেও লুঠ চালাচ্ছে। তাদের সাথে চিনের সাম্রাজ্যবাদের প্রতিযোগিতা। ভারত সরকার যেহেতু শেখ হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে মুখ খোলেনি, বরং সমর্থন করে গেছে এতদিন, সে জন্য ভারত সরকারের বিরুদ্ধে, ভারতের পুঁজিপতি ও শিল্পপতিদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের জনসাধারণের ক্ষোভ দেখা গেছে।

৭ আগস্ট এক সাক্ষাৎকারে কমরেড প্রভাস ঘোষ বলেন, বাংলাদেশের এই ছাত্র আন্দোলনের দাবি সম্পূর্ণ ন্যায়সঙ্গত এবং গণতান্ত্রিক। হাজারে হাজারে লাখে লাখে ছাত্র-ছাত্রী বুলেটের সামনে দাঁড়িয়ে লড়াই করছে, প্রাণ দিয়েছে, রক্ত দিয়েছে। এদের কারও পরিচয় মুসলিম বা হিন্দু নয়। যাঁরা শহিদ হয়েছেন তাঁদের মধ্যে মুসলিম আছেন, হিন্দু আছেন। আওয়ামি লিগ সরকার ফ্যাসিস্ট কায়দায় নৃশংস ভাবে এই আন্দোলন দমন করতে নেমেছে। শান্তিপূর্ণ মিছিলকারীদের ওপরে প্রথমে ছাত্র লিগকে লেলিয়ে দিয়েছিল, পিছনে ছিল পুলিশ। আন্দোলনকারীরা রুখে দাঁড়ালে পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালায়। যার ফলে গোটা বাংলাদেশের ছাত্রসমাজ আরও ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। প্রতিবাদে মুখরিত হয়। জনসাধারণের মধ্যেও এর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ ধ্বনিত হতে থাকে। যত দিন গেছে সরকার ক্রমাগত গুলি চালিয়েছে। হয়তো দেখা যাবে, মৃতের সংখ্যা হাজার ছাড়িয়েছে। কেউ বলতে পারছেন না কতজন মারা গেছেন। এই আন্দোলন আদৌ কোনও মৌলবাদী শক্তি দ্বারা সংঘটিত হয়নি– এটা বাস্তব ঘটনা। এবং আন্দোলনের দাবি আদায় হয়েছে। হাসিনা পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন। এটা একটা ঐতিহাসিক বিজয়।

এই উপমহাদেশে একমাত্র শ্রীলঙ্কায় কিছুদিন আগে এই ধরনের একটা অভ্যুত্থান ঘটেছিল। সম্প্রতি বাংলাদেশেও দেখা গেল। এখানে কোনও রাজনৈতিক নেতার নেতৃত্ব ছিল না। কোনও পার্টি ছিল না। স্বতঃস্ফূর্ত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। একটা স্ফূলিঙ্গ থেকে বিরাট অগ্নিশিখা জ্বলে ওঠে। আন্দোলনটা সে ভাবেই গড়ে উঠেছিল।

এখন যেটা ঘটছে, আমার অনুমান, এর পিছনে কাজ করছে– যেহেতু আওয়ামি লিগ এবং ছাত্র লিগ পরাস্ত হয়েছে, ক্ষমতাচ্যুত হয়েছে, ফলে ক্ষিপ্ত হয়ে তারা আন্দোলনকারীদের কালিমালিপ্ত করার ষড়যন্ত্র করছে। এটা আমার অনুমান যে, এর সাথে যুক্ত বাংলাদেশের পুলিশ বাহিনী, যে পুলিশ বাহিনী গুলি চালিয়েছে। মিলিটারি কিন্তু বিশেষ ভাবে আক্রমণ করেনি। মিলিটারির নিচু তলার যারা ছিল, তাদের প্রবল চাপ ছিল অফিসারদের উপরে, যাতে তারা এই আন্দোলনে সশস্ত্র হামলা না চালায়। কিন্তু পুলিশ, হয়তো এর মধ্যে অধিকাংশই আওয়ামি লিগের সদস্য হিসেবে চাকরি পেয়েছে এবং এরাই নৃশংসভাবে এই আন্দোলন দমন করেছে। এখন এই পুলিশ কিন্তু রাস্তাঘাটে কোথাও নেই, মিলিটারি নেই। তা হলে এর পিছনে একটা ষড়যন্ত্র আছে বুঝতে হবে। তারা চেয়েছে, লুটতরাজ হোক, ভাঙচুর হোক। এরই সাথে সংখ্যালঘুদের কিছু ধর্মীয় স্থানেও হামলা হয়েছে। সংখ্যালঘুদের উপর কিছু জায়গায় আক্রমণ হয়েছে। কেউ নিহত হয়েছেন– এমন আমার বিশেষ জানা নেই। দুয়েকটা ঘটনা হয়তো বিচ্ছিন্ন ভাবে ঘটতেও পারে। কিন্তু যে মুহূর্তে এটা শুরু হয়েছে সেই মুহূর্তে আন্দোলনকারীরা এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে রাস্তায় নেমেছেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের এক সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদের একটি বিবৃতি আমি পড়ে শোনাচ্ছি। তাঁরা যে কতটা গুরুত্ব দিয়ে জিনিসটাকে দেখছেন, এ থেকেই বোঝা যায়। বিবৃতিতে লেখা হয়েছে– ‘আওয়ামি লিগ বিভিন্ন স্থানে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানদের উপর হামলা করে পুরনো বিভাজনের রাজনীতিকে চাঙ্গা করতে চাইছে। ছাত্র জনতাকে এই ষড়যন্তে্রর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর আহ্বান জানাচ্ছি। যেখানে মন্দির, প্যাগোডা কিংবা গির্জায় হামলা হবে সেখানে প্রতিরোধ গড়ে তোলো। হামলাকারীদের মোক্ষম জবাব নিশ্চিত করার আহ্বান জানাচ্ছি। আওয়ামি লিগের সকল নোংরা খেলাই আমরা নস্যাৎ করতে সফল হয়েছি, এ বারও সফল হব। জাতীয় ঐক্যই আমাদের শক্তি।’

এই তাঁদের আহ্বান। এই আহ্বানের ভিত্তিতে তাঁদের হাজার হাজার কর্মী নেমে গেছেন। বিভিন্ন ধর্মস্থানে তাঁরা পাহারা দিয়েছেন। আমি নিজে ফেসবুকে ছবি দেখেছি, মাদ্রাসার ছাত্ররা মন্দির পাহারা দিচ্ছেন। এই যে বিবৃতি তা প্রত্যেকটি মসজিদ থেকে পড়ে শোনানো হচ্ছে এবং হিন্দুদের পাড়া তাঁরা গার্ড করছেন, যাতে হামলা না হতে পারে। ফলে এখানে এ কথা মনে করার কোনও কারণ নেই যে এই লুঠতরাজ ও হামলার সাথে আন্দোলনকারীরা যুক্ত। বরং তারা এর প্রবল বিরোধী। একে রুখবার জন্য তারা সমস্ত শক্তি নিয়োগ করেছেন।

এই আন্দোলনই আগামী নির্বাচনে বিএনপি বা জামাতের ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা তৈরি করল কি না, এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন– আমি আগেই বলেছি, এটা গণতান্ত্রিক আন্দোলন, জনগণের দাবিতে আন্দোলন হয়েছে, ছাত্রদের দাবি জানানো হয়েছে। এখন এই সম্ভাবনা থাকতে পারে। আওয়ামি লিগের প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী হচ্ছে বিএনপি, জামাত। বাংলাদেশে বামপন্থী শক্তি অত্যন্ত দুর্বল এবং এই আন্দোলনে তাঁদের ভূমিকাও উল্লেখযোগ্য নয়। ফলে বিকল্প শক্তি হিসাবে বামপন্থীরা এখানে নেই। নির্বাচন হলে এরা হয়তো ক্ষমতায় আসতে পারে। কিন্তু আমি এ কথা বিশ্বাস করি, যে ছাত্রশক্তি, যে জনগণ আওয়ামি লিগের ফ্যাসিস্ট শাসনের বিরুদ্ধে, স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে, বিএনপি-জামাত একইভাবে যদি জনগণের স্বার্থের বিরুদ্ধে কাজ করে, সাম্প্রদায়িক রাজনীতির চর্চা করে এবং পুঁজিপতি শ্রেণির স্বার্থে শাসন চালায় তা হলে এই ছাত্রশক্তি, এই জনগণই তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে।

শুধু ফেসবুকেই নয়, এ দেশের সংবাদমাধ্যমের একাংশ এই আন্দোলন সম্পর্কে সাম্প্রদায়িক উস্কানিমূলক প্রচার চালাচ্ছে, যাতে জনগণের একটা অংশ বিভ্রান্ত হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে কমরেড প্রভাস ঘোষ বলেন, ভারতে যাঁরা সচেতন জনগণ, আমি মনে করি তাঁদের বিভ্রান্ত হওয়ার কোনও কারণ নেই। এর পিছনে আর একটা হীন উদ্দেশ্য কাজ করছে। আমাদের দেশে যারা মুসলিমবিরোধী, যারা উগ্র হিন্দুত্বের ও সাম্প্রদায়িকতার চর্চা করে, তারা সবসময় চেষ্টা করে মুসলিমদের বিরুদ্ধে যে কোনও ধরনের অজুহাত খাড়া করে একটা সাম্প্রদায়িক পরিবেশ সৃষ্টি করার। কোনও কোনও সংবাদমাধ্যম তাদের হয়ে এই কাজ করছে। ফেসবুকে এসব চলছে। কিন্তু এইসব সংবাদমাধ্যম তো এই কথা প্রচার করছে না যে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ কী আবেদন করেছেন! তারা তো এই কথা প্রচার করছে না যে মাদ্রাসার ছাত্ররা রাত জেগে মন্দির পাহারা দিচ্ছে, হিন্দু পাড়া গার্ড করছে! তারা প্রচার করছে সেগুলো, যা তাদের স্বার্থে কাজে লাগে। যাতে এখানে একটা মুসলিম বিরোধী সাম্প্রদায়িক পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারে। এখানে যাতে জনগণের ঐক্যকে ধ্বংস করতে পারে। এখানে তাদের হিন্দুত্বের ভোটব্যাঙ্ক যাতে সৃষ্টি করতে পারে।

আমি পশ্চিমবঙ্গের জনগণের কাছে, ভারতবর্ষের জনগণের কাছে আবেদন জানাব– তাঁরা যাতে এইসব অপপ্রচারে বিভ্রান্ত না হন। এর কোনও বাস্তবতা নেই। ওই আন্দোলনে, আমি আবারও বলছি, শুধু মুসলিম নয়, হিন্দু ছাত্রছাত্রীরাও প্রাণ দিয়েছে, একই দাবিতে একই রক্ত মিশেছে। এখানে কোনও সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদ ছিল না। আওয়ামি লিগের পক্ষ থেকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে এবং পুলিশ বাহিনীকে নিষ্ক্রিয় রেখে এই ষড়যন্ত্র চলছে, যাতে ওখানেও আন্দোলনকে কালিমালিপ্ত করা যায়। পিচমবঙ্গেও যাতে সাম্প্রদায়িক শক্তি জোরদার হয়। এটা লক্ষণীয় যে, এখানকার যারা হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তি তারা এটাকে কাজে লাগাবার অপচেষ্টা করছে। জনগণকে আমি আবেদন করব, তাঁরা যাতে বিভ্রান্ত না হন।