স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছরকে ‘অমৃতকাল’ ঘোষণা করে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার দেশ জুড়ে নানা উৎসবে মেতেছে। কাদের ভাগে অমৃত জুটছে, আর কারা গরল ভোগ করছে, তার হিসেবের মধ্যে না ঢুকে নেতারা সেখানে উন্নয়নের লম্বা-চওড়া ফিরিস্তি দিচ্ছেন। সদম্ভে ঘোষণা করছেন, ভারত বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র। যদিও নানা শাসকের হাত ঘুরে বর্তমানে বিজেপির শাসনকালে ভারতে গণতন্ত্র কোথায় এসে পৌঁছেছে তা নিয়ে দেশের মানুষের অভিজ্ঞতা অত্যন্ত তিক্ত। গণতন্ত্রপ্রেমী বহু মানুষ প্রশ্ন তুলছেন– ভারতে গণতন্ত্র বলে সত্যিই কি কিছু আছে?
কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধীর সাংসদ পদ খারিজ নিয়ে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার যতই দাবি করুক, এ ক্ষেত্রে তাদের কোনও ভূমিকা নেই, যা ঘটেছে তা সংসদীয় আইন মেনে লোকসভার স্পিকারের নির্দেশেই– দেশবাসী মেনে নিতে পারেনি। সরকারের পরিকল্পনা ছাড়া যে এ ঘটনা ঘটতে পারে না, তা বোঝে না এমন মানুষ পাওয়া মুশকিল।
জনসাধারণের তিক্ত অভিজ্ঞতা যে, ভোটের বাজারে ভোটসর্বস্ব দলগুলির নেতা-মন্ত্রীদের মুখে কোনও লাগাম থাকে না। ভোটের বাজার গরম করতে তাদের মুখে অকথা-কুকথার বন্যা ছুটতে থাকে। এ ব্যাপারে ভোটবাজ দলগুলির কেউই বিশেষ পিছিয়ে নেই। তার সঙ্গে রয়েছে অসহিষ্ণুতা, শক্তিমদমত্ততা, পেশিশক্তির আস্ফালন, খুন, সন্ত্রাস এবং সর্বোপরি টাকার খেলা। বস্তুত, কর্পোরেট মালিকদের কাছে আত্মবিক্রয় করে যারা গদিতে বসার স্বপ্ন দেখে, সেইসব বুর্জোয়া রাজনীতির কারবারিদের চেহারাটা আজ এতই কালিমালিপ্ত যে মিথ্যাচার, ভ্রষ্টাচার, ভণ্ডামি, ফাঁকা প্রতিশ্রুতি ছাড়া জনগণকে তাদের আজ আর কিছু দেওয়ার নেই। এখানে বিজেপি, কংগ্রেস, তৃণমূল সবার চরিত্রই এক। বাকচাতুর্য এবং অবস্থানগত কিছু পার্থক্য ছাড়া এদের মধ্যে ফারাক বিশেষ কিছু নেই।
রাহুল গান্ধীর সাংসদ পদ খারিজ নিয়ে শোরগোলে নীরব মোদি, লোলিত মোদিরা যে আর্থিক অপরাধে অপরাধী এবং তাদের দেশছাড়ার পিছনে কোনও না কোনওভাবে মোদি সরকারের ভূমিকা রয়েছে, এই সত্যটি সম্পূর্ণ চাপা পড়ে গেল! প্রধানমন্ত্রী ও এই দুই অপরাধীর পদবীর যে আকস্মিক ও কাকতালীয় মিল, কেন্দ্রের বিজেপি সরকার ক্ষমতা ও প্রচারের জোরে তাকেই প্রধান বিষয় করে তুলল। বলতে লাগল, এতে মোদি সম্প্রদায় তথা ওবিসি গোষ্ঠীভুক্তদের অপমান করা হয়েছে। বিজেপির উদ্দেশ্য ছিল, এ ভাবে ওবিসি তাস খেলে ভোটবাজের ফয়দা নিশ্চিত করা এবং সমস্ত অভিযোগের আঁচ থেকে নরেন্দ্র মোদিকে বাঁচানো। কংগ্রেসও একে কেন্দ্র করে, একটা সহানুভূতির হাওয়া তৈরির চেষ্টা করেছিল। কিন্তু বাস্তবে তা দানা বাঁধেনি। কারণ কংগ্রেস আজ সমস্ত দিক থেকেই একটা ভাঙাহাট।
এই ঘটনা আবারও বুর্জোয়া গণতন্ত্রের আসল চেহারাটা সামনে নিয়ে এল। বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের প্রথম যুগে গণতন্ত্রের মানে ছিল মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, প্রতিবাদের স্বাধীনতা। আজ বুর্জোয়া গণতন্ত্রের অবক্ষয়ের যুগে সেই গণতন্ত্রের পরিসর সঙ্কুচিত হতে হতে কোথায় এসে পৌঁছেছে তা স্পষ্ট হচ্ছে আজকের বুর্জোয়া রাজনীতিকদের আচরণে। শাসক এবং বিরোধী উভয়পক্ষেই পুঁজিপতিশ্রেণির স্বার্থরক্ষায় উদগ্রীব। তাই তাদের একে অপরের বিরুদ্ধে গরম গরম কুকথা আর আস্ফালনই ভরসা। এর মধ্যে সার কথা কম, মন্তব্য বেশি। অন্যদিকে সমালোচনা গ্রহণ করা দূরের কথা, যে কোনও রকম বিরুদ্ধতা বা প্রতিবাদকে যে কোনও উপায়ে দমন করতে বদ্ধপরিকর আজকের শাসকরা। এদের চোখে সরকারের বিরোধিতা মানেই দেশদ্রোহিতা। উত্তরপ্রদেশের হাথরসে একটি দলিত মেয়েকে নির্যাতন ও খুন করে তার দেহ পুড়িয়ে ফেলার ঘটনা জনসমক্ষে আনতে চাওয়ার ‘অপরাধে’ সাংবাদিক সিদ্দিক কাপ্পানকে আড়াই বছর জেল খাটতে হল! নরেন্দ্র মোদিকে নিয়ে বিবিসির তথ্যচিত্র এ দেশে নিষিদ্ধ করা এবং বিবিসি দপ্তরে ৬০ ঘণ্টা আয়কর হানা তো একেবারে সাম্প্রতিক ঘটনা। সুযোগ পেলেই বিরোধী দলের নেতাদের বিরুদ্ধে সিবিআই, ইডির মতো কেন্দ্রীয় এজেন্সিকে লাগিয়ে দেওয়া এবং তাদের উপর চাপ সৃষ্টি করাকে বিজেপি সরকার একটা শক্তিশালী হাতিয়ারে পরিণত করেছে। বিচার বিভাগকেও কুক্ষিগত করতে কলেজিয়াম প্রথা তুলে দিয়ে বিচারপতি নিয়োগের ক্ষমতা কেন্দ্রীয় সরকার নিজের হাতে তুলে নিতে চাইছে। সংসদে বিতর্ক তো প্রায় উঠে যেতে বসেছে। বিরোধী সদস্যরা সংসদে বলার সময় প্রায়ই নাকি মাইক্রোফোন বন্ধ করে দেওয়া হয়। সরকারের অপছন্দের বিষয় সংসদের বিবর;ণী থেকে ছেঁটে ফেলা হয়। এই হল এ দেশে গণতন্তে্রর বর্তমান হাল।
অবশ্য ক্ষেত্র বিশেষে সক্রিয়তার মতো ক্ষেত্র বিশেষে নিষ্ক্রিয়তাও বিজেপি সরকারের আরেকটি বৈশিষ্ট্য। যে সব ঘটনায় অভিযোগের লক্ষ্য তারা নিজেরা, সেখানেই চোখে পড়ে ব্যাপক নিষ্ক্রিয়তা। যেমন গুজরাট গণহত্যা। নরেন্দ্র মোদির মুখ্যমন্ত্রিত্বকালে গুজরাটের সেই ভয়াবহ ঘটনায় প্রায় দু’হাজার মানুষের মৃত্যুর পরেও অভিযুক্তরা বেকসুর খালাস পেয়ে যায়। বিজেপি শাসিত গুজরাটেই বিলকিস বানুর ঘটনায় জেলবন্দি ধর্ষক ও গণহত্যাকারীদের মহা-সমারোহে মুক্তি দেওয়া হয়। গলায় মালা দিয়ে তাদের অভিনন্দন জানিয়ে বিজেপি নেতারা বলেন, এদের জন্ম ভাল সংস্কারের মধ্যে। গুজরাট বিধানসভা ভোটের ঠিক আগে মোরবি সেতু ভেঙে দেড়শোর বেশি মানুষের প্রাণ গেল। প্রধানমন্ত্রী তখন নির্বাচনী প্রচারে গুজরাটে উপস্থিত। তা সত্ত্বেও মোরবি যেতে তাঁর সময় লাগল দেড় দিন। শুধু তাই নয়, এত মানুষের প্রাণহানির পরেও একটা লোকদেখানো তদন্ত ছাড়া আর কিছু করা হল না, শাস্তি তো দূরের কথা। কারণ যে ঠিকাদার সংস্থা ব্রিজ মেরামতির দায়িত্বে ছিল তারা বিজেপির আশ্রয়পুষ্ট। আদানির ক্ষেত্রেও আমরা একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখলাম। এই একচেটিয়া পুঁজিমালিকের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠতার অভিযোগ বার বার উঠেছে।
অভিযোগ উঠেছে, এই ঘনিষ্ঠতার কারণেই আদানির নানা প্রকল্পে স্টেট ব্যাঙ্ক, এলআইসি-র মতো সংস্থা হাজার কোটি কোটি টাকা ঢেলেছে। আদানিরা ভুয়ো বিনিয়োগ দেখিয়ে কৃত্রিমভাবে শেয়ারের মূল্যবৃদ্ধি ঘটিয়েছে, হিন্ডেনবার্গের রিপোর্টে তা সামনে আসায় যখন আদানিদের সংস্থাগুলির শেয়ার-দর হু হু করে পড়ে গেল, তখন সমস্ত মহল থেকে পূর্ণাঙ্গ তদন্তের দাবি উঠল। কিন্তু নরেন্দ্র মোদি নিরুত্তাপ, অবিচল। তিনি সংসদে দাঁড়িয়ে তার ছাপ্পান্ন ইঞ্চি ছাতি ফুলিয়ে ঘন্টার পর ঘণ্টা বত্তৃতা করলেন, কিন্তু আদানি প্রসঙ্গে একটি কথাও উচ্চারণ করলেন না। বিজেপি সরকারের এই স্বেচ্ছাচারী মনোভাব, স্বৈরতান্ত্রিক আচরণ দেশ-বিদেশের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। গণতন্ত্রের গলা টিপে ধরার বিজেপি সরকারের এই অপচেষ্টা প্রতিহত করা না গেলে আগামী দিনে আরও অনেক মূল্য আমাদের দিতে হবে।