প্রতিটি দিন তাঁর কাছে সমান৷ সকাল পৌনে সাতটায় ঘুম ভাঙার বিশ মিনিট পর প্রাতঃরাশ৷ আটটার সময় কাজের রিপোর্ট৷ তবুও জেল যেন তাঁর কাছে মরূদ্যান৷ নানা বিধিনিষেধেও স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন৷ পরিবার–পরিজন ছেড়েও একাকীত্ব অনুভব করেন না৷ জেলে বন্দি ৮০ বছরের বৃদ্ধা সম্ভ্রান্ত পরিবারের শিজুকা সাংবাদিককে শোনালেন তার নিদারুণ অভিজ্ঞতা৷ বাড়িতে স্বামী, দুই ছেলে, নাতি–নাতনি সবাই থাকা সত্ত্বেও তিনি ইচ্ছা করে তিন–তিন বার চুরি করে জেল খাটছেন৷ কেন? পুলিশের কাছে দেওয়া জবানবন্দিতে জানা যাচ্ছে, বাড়িতে সবার মাঝেও তিনি ছিলেন একা৷ মনের কথা বলার কেউ নেই৷ ১৩ বছর আগে একটি দোকান থেকে বই চুরি করেন৷ থানায় নিয়ে যাওয়া হলে পুলিশ অফিসার তাঁর কথা মন দিয়ে শোনেন৷ মনে হয় এই প্রথম তার কথা কেউ মন দিয়ে শুনল৷ অফিসার বলেন, ‘আমি আপনার নিঃসঙ্গতার যন্ত্রণা অনুভব করতে পারছি৷ কিন্তু এই ধরনের কাজ আর করবেন না’৷ বৃদ্ধা শোনেননি তাঁর কথা৷ তৃতীয়বার একই ধরনের অপরাধের পর তিন বছর দু’মাসের জেল হয় তাঁর৷
শিজুকা একা নন৷ পরিবারের মাঝে থেকে একাকীত্ব কাটাতে জাপানে বৃদ্ধ–বৃদ্ধাদের ছোটখাটো অপরাধ করে জেলে যাওয়ার প্রবণতা ক্রমাগত বাড়ছে৷ একটি তথ্যে দেখা যাচ্ছে জাপানে জনসংখ্যার ২৭ ভাগের বয়স ৬৫ বছরের উপর৷ এঁদের অনেকেই দোকানে চুরি করে স্ব–ইচ্ছায় জেলে গেছেন একাধিকবার৷ ১৯৯৮ সালে এই ধরনের অপরাধের সংখ্যা ছিল ১৩,৭৩৯, বর্তমানে তা ৪৮,৫৯৭টি৷
জাপান পারস্পরিক বোঝাপড়া, ভদ্র মার্জিত আচরণের জন্য বিশ্বে সমাদৃত৷ পরিবার ও সমাজে বয়স্করা শ্রদ্ধা পেতেন৷ পরিবারের সবাই তাদের খোঁজখবর রাখত৷ সেবা–যত্ন, সহযোগিতা করত৷ কিন্তু এখন অনেকেই তাঁদের কোনও খোঁজই রাখে না৷ সমাজ–পরিবার থেকে বিচ্যুত হয়ে আজ তাঁরা একা হয়ে পড়েছেন৷ শুধু তাই নয়, প্রযুক্তি নির্ভর জাপানে দ্রুত হারে বাড়ছে ‘কোডাকুশি’ বা ‘একাকী মৃত্যু’৷ সাংবাদিক নোরিসিৎসু ওনিশি লিখছেন – এই সব বয়স্ক্দের সন্তান হয় অন্য দেশে না হয় অন্য শহরে থাকে৷ ঘরে একাকী বৃদ্ধ বাবা–মা৷ শেষ বয়সে সঙ্গীহীন, স্বজনহীন অসহায় জীবন৷ একাকীত্ব হতাশা গ্রাস করেছে তাঁদের৷ সকলের অজ্ঞাতে একদিন একা একা মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছেন৷ মৃতদেহ থেকে পচা দুর্গন্ধ বের হলে তবে জানা যাচ্ছে৷ ভারতেও এখন এমন মৃত্যুর ঘটনা আকছার ঘটছে৷ প্রায়ই সংবাদমাধ্যমে উঠে আসছে এমন মৃত্যুর খবর৷
জাপানেরই ৮৫ বছরের অসুস্থ কানামোতো আশঙ্কিত তাঁর মৃত্যুর পর স্ত্রীর কী হবে? এই দুশ্চিন্তা থেকে তিনি তার স্ত্রীকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করেন৷ বছর কয়েক আগে এই রকম এক হৃদয়বিদারক ঘটনা আমরা দেখেছিলাম উত্তর ২৪ পরগণার সোদপুরে৷ এক সময়ের সরকারি অফিসার বৃদ্ধ শ্যামাপদ বাবুর প্রবাসী পুত্র শুধু দেশ ভোলেনি, ভুলেছে তার জন্মদাতা–জন্মদাত্রী৷ শ্যামাপদ বাবুর এক রাশ উদ্বেগ, তাঁর মৃত্যুর পর স্ত্রীকে কে দেখবে দুশ্চিন্তা দূর করতে সারা জীবনের সুখ–দুঃখের সঙ্গী অশীতিপর স্ত্রীকে হাতুড়ির এক আঘাতে শেষ করে দিলেন৷ তারপর নিজেই পুলিশ ডেকে চোখের জল মুছতে মুছতে বললেন, ‘কেউ কোথাও নেই, সব অন্ধকার৷ কে দেখবে ওকে আমার মৃত্যুর পর তাই …৷’ অসহায় বৃদ্ধের এই আর্তনাদ অনেককে আলোড়িত করেছিল৷ দুপুরের খাওয়ার পর দিল্লির করোলবাগের ৭৫ বছরের কুসুমলতা দেবী যখন জানতে পারলেন ছেলে অমিত নিজে গাড়ি চালিয়ে তাঁকে গাজিয়াবাদে আত্মীয়ের বাড়ি নিয়ে যাবে আনন্দে তিনি আত্মহারা হয়ে পড়েন৷ বহুদিন পর ছেলের সঙ্গে বেরোলেও সে যেন কেমন গম্ভীর, যেন কিছু ভাবছে৷ প্রায় চল্লিশ মিনিট গাড়ি চালানোর পর পার্শ্বস্থ একটা ফলের দোকানের সামনে গাড়ি থামে৷ অমিত মাকে আত্মীয়ের জন্য কিছু ফল নেওয়ার কথা বলে৷ ফল নিতে নামার সময় কুসুমলতা দেবী ভাবতেও পারেননি এই শেষ৷ নামার সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি স্টার্ট৷ ৭৫ বছরের বৃদ্ধা মাকে ফেলে উধাও সন্তান৷ বর্তমানে কুসুমলতা দেবীর ঠিকানা স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা পরিচালিত একটি বৃদ্ধাশ্রম৷ একটা দুটো নয়, এই রকম শত শত মর্মান্তিক ঘটনা ঘটছে প্রতিদিন, শুধু জাপানে বা আমাদের দেশে নয়, গোটা বিশ্বজুড়ে৷
এগুলি কি কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা? না, তা নয়৷ সমাজের একটা বড় অংশকে গ্রাস করছে একাকীত্ব–নিঃসঙ্গতা৷ প্রযুক্তি পারস্পরিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে প্রায় বিপ্লব ঘটিয়ে আমাদের মোবাইল, ইন্টারনেট, ফেসবুক, টুইটার, হোয়াটস্যাপ দিয়েছে৷ তবুও হারিয়ে যাচ্ছে নৈকট্য৷ একটি হাতের উপর আর একটি উষ্ণ হাতের পরশে ভালবাসা, সহানুভূতির তরঙ্গ ছড়িয়ে পড়ে দেহের প্রতিটি অনুতে৷ কাটিয়ে তোলে একাকীত্ব–নিঃসঙ্গতা৷ তাকে বলে, ‘তুমি কিছু ভেবো না, আমি তোমার পাশে আছি’৷ এটাই তো জীবনের পরশ৷ আজ তার বড্ড অভাব৷
প্রতিটি পিতা–মাতা তাঁদের সন্তানকে লেখাপড়া শিখিয়ে বড় করতে চান৷ বলেন, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, প্রফেসর, সরকারি অফিসার হও৷ কোনও দিকে তাকিও না, কারও কথা ভেবো না, শুধু নিজের অভীষ্ট লক্ষ্যে এগিয়ে যাও৷ ভাবেন না, এই শিক্ষা তাদের হয়ত বড় রোজগেরে করে তুলছে, কিন্তু বড় মানুষ করে তুলছে কি? তারপর সন্তান যখন শুধু নিজেরটা দেখতে গিয়ে এমনকী বাবা–মাকেও দেখে না, তখন আমরা ভাবতে থাকি, বড় করে তোলায় কোথায় ফাঁকি থেকে গেল অনেকটা স্বগতোক্তির মতোই জিজ্ঞাসা করি, ‘ও কেন এমন করল’?
এক সময় সমাজে যৌথ পরিবার ছিল৷ বাবা–মা ছাড়াও দাদু–ঠাকুমা, কাকা–জ্যাঠা, কাকিমা–জেঠিমা, খুড়তুতো জ্যাঠতুতো ভাইবোনেদের সঙ্গে একসঙ্গে বড় হতে হতে ছেলেমেয়েরা ভাগ করে খেতে, একসঙ্গে থাকতে শিখত৷ পরিবারের জ্যেষ্ঠরা জানতেন তাঁদের ভবিষ্যৎ পরবর্তী প্রজন্মের হাতে সুরক্ষিত৷ তাঁরা সন্তানদের শিক্ষা দিতেন, ‘পরের কারণে স্বার্থ দিয়া বলি, এ জীবন মন সকলি দাও/ তার মতো সুখ কোথাও কি আছে? আপনার কথা ভুলিয়া যাও’৷ এই ছিল সে সময়ের মূল্যবোধ৷ অর্থনীতির নিয়মেই পুরনো যৌথ পরিবার ভেঙেছে৷ ভেঙেছে মূল্যবোধ৷
পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় মানুষের মূল্য নির্ধারণ হয় তার উৎপাদন ক্ষমতা দিয়ে৷ তাই উৎপাদন ক্ষমতা হারিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষ হিসাবে তাঁর যাবতীয় মূল্য হারিয়ে ফেলেন প্রবীণরা৷ পৌনে দু’শো বছর আগে মার্কস–এঙ্গেলস তাঁদের ঐতিহাসিক কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টোতে দেখিয়েছিলেন, পুঁজিবাদ মানুষের ব্যক্তিগত সম্পর্কগুলিকে পর্যন্ত পণ্যে পরিণত করেছে৷ মুনাফাই যেহেতু এই সমাজের ভিত্তি তাই পুঁজিবাদ রেনেসাঁসের যুগে, সামন্ততন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সময়ে যে উন্নত মূল্যবোধগুলির জন্ম দিয়েছিল, সেগুলিকে ধরে রাখতে পারল না৷ ফলে আদর্শ ও নৈতিকতার ক্ষেত্রে শূন্যতার সৃষ্টি হল৷ এই শূন্যতা মানুষকে ক্রমাগত স্বার্থপর, আত্মকেন্দ্রিক এবং সমাজবিচ্ছিন্ন করে তুলল৷ তারই প্রভাব পরিবারগুলিতে পড়ছে৷ সবার মাঝে থেকেও মানুষ যেমন একা হয়ে পড়ছে, তেমনই বাবা–মা সহ প্রবীণরা পরিবারে হয়ে পড়ছেন ব্রাত্য৷
ইতিহাসের নিয়মেই যৌথ পরিবার আর ফিরবে না৷ কিন্তু এই একাকীত্ব থেকে মুক্তির পথ একমাত্র যৌথতাতেই৷ ব্যক্তিমালিকানার অবসানের মধ্য দিয়ে যৌথ মালিকানা প্রতিষ্ঠার মধ্যেই অবসান হবে আত্মকেন্দ্রিকতা, স্বার্থপরতা, লোভ, হিংসার৷ ফিরে আসবে সহমর্মিতা, সহানুভূতি, ভালবাসা৷ তার জন্য প্রয়োজন পুঁজিবাদী এই সমাজটাকে বদলানোর লক্ষ্যে সামাজিক সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তোলা৷
(৭১ বর্ষ ৯ সংখ্যা ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৮)