দেশজোড়া উগ্র হিন্দুত্ববাদ সভ্যতার অগ্রগতি, শোষিত মানুষের মুক্তির পথে এক গুরুতর বাধা হিসাবে দেখা দিয়েছে। ধর্মান্ধতা ছড়িয়ে ধর্মের ভিত্তিতে মানুষকে বিভক্ত করে তাদের বাঁচার দাবিগুলিকে পিছনে ঠেলে দিচ্ছে বিজেপি। পুঁজিপতিদের স্বার্থকে দেশের স্বার্থ বলে প্রতিপন্ন করছে এবং পুঁজিপতিদের স্বার্থে কাজ করাকেই দেশপ্রেম বলে জাহির করছে। বাস্তবে বিজেপি কতবড় দেশপ্রেমিক তা তাদের অনুসৃত হিন্দুত্ববাদের উদগাতা সাভারকরের দেশপ্রেমের দিকে তাকালেই স্পষ্ট হয়ে যায়।
১৯১১ সালের জুন মাসে সাভারকর আন্দামানের সেলুলার জেলে এসে পৌঁছন। বছর ঘোরবার আগেই তিনি ভারতের ব্রিটিশ সরকারের কাছে একটি ‘ক্ষমাভিক্ষার আবেদনক্স জমা দেন। এরপর যথাক্রমে ১৯১৩, ১৯১৪, ১৯১৮ এবং ১৯২০ সালে একের পর আবেদনপত্র জমা দেন। প্রথম আবেদনপত্রটির বিষয়টি পাওয়া যায়নি। সাভারকর তাঁর পাঠানো ১৪ নভেম্বর, ১৯১৩ সালের পরবর্তী আবেদনপত্রে এই প্রথম আবেদনটির উল্লেখ করেন। আবেদনপত্রের শেষ এবং প্রকাশিত অনুচ্ছেদটি নিচে দেওয়া হল।
‘…পরিশেষে ক্ষমাভিক্ষার আবেদনটি অত্যন্ত সহৃদয়তার সঙ্গে পাঠ করার সময় মহামান্য হুজুরকে আমি এ কথা স্মরণ করিয়ে দিতে পারি কি যে, অনুমোদনের জন্য এটিকে ভারত সরকারের কাছে পাঠানো হবে? ভারতীয় রাজনীতির বর্তমান অগ্রগতি এবং সরকারের সামঞ্জস্যপূর্ণ নীতি আরও একবার সাংবিধানিক পথটিকে উন্মুক্ত করে দিয়েছে। ১৯০৬-১৯০৭ সালের ভারতবর্ষের উত্তেজনাময় এবং আশাহীন পরিস্থিতিতে যে ভাবে শান্তি ও অগ্রগতির পথ আমাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছিল আজ সেই রকম কণ্টকময় পথে ভারতবর্ষ ও মানবতার কল্যাণকামী কোনও মানুষ অন্ধের মতো পা ফেলবে না।
কাজেই সরকার যদি তাঁদের বহুমুখী দয়ার দানে আমাকে একটু মুক্ত করে দেন তবে আমি আর কিছু পারি বা না পারি চিরদিন সাংবিধানিক প্রগতি এবং ব্রিটিশ সরকারের প্রতি আনুগত্যের অবিচলিত প্রচারক হয়ে থাকব। যত দিন আমরা জেলে থাকব, তত দিন ভারতে মহামান্য হুজুরের শতসহস্র অনুগত প্রজার গৃহে প্রকৃত সুখ আর আনন্দ থাকতে পারে না। রক্ত জলের চেয়েও গাঢ়। কিন্তু আমরা যদি মুক্তি পাই তা হলে জনতা স্বতঃস্ফূর্তভাবে আনন্দধ্বনি তুলবে, এই সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবে যে, সরকার কেমন করে প্রতিহিংসা নিতে হয় এবং শাস্তি দিতে হয় এ কথার চেয়ে কেমন করে ক্ষমা করতে হয়, সংশোধন করতে হয় এ কথা আরও বেশি ভাল করে জানে।
উপরন্তু দেশে ও বিদেশে অনেক বিপথগামী যুবক, যারা একসময় পথপ্রদর্শক হিসেবে আমার দিকেই তাকিয়ে থাকত, আমার সাংবিধানিক পথে ফিরে আসা তাদের শান্তির পথে ফিরিয়ে আনবে। সরকার আমাকে যে কাজ করতে বলবে সেই মতোই প্রায় সব করতে আমি প্রস্তুত। কেন না আমার আজকের পরিবর্তন যেহেতু বিবেকের দ্বারা পরিচালিত, তাই আমার ভবিষ্যতের আচরণও সেই রকমই হবে। অন্য ভাবে যা পাওয়া যেতে পারে সে তুলনায় আমাকে জেলে আটকে রাখলে কিছুই পাওয়া যাবে না। শক্তিশালীর পক্ষেই একমাত্র ক্ষমাশীল হওয়া সম্ভব। কাজেই অনুতপ্ত সন্তান পিতৃতুল্য সরকারের দরজায় ছাড়া আর কোথায় ফিরে যাবে? মহামান্য হুজুর অনুগ্রহ করে বিষয়গুলি বিবেচনা করবেন এই আশা রইল।’
সাভারকরের আবেদন মঞ্জুর করে কয়েকটি শর্তে তাঁকে মুক্তি দেয় ব্রিটিশ সরকার। এর মধ্যে একটি শর্ত ছিল যে, সরকারের অনুমতি ছাড়া সাভারকর প্রকাশ্যে বা গোপনে কোনওরকম রাজনৈতিক কার্যকলাপে যোগ দিতে পারবেন না।
কারামুক্তির সময়ে কৃতজ্ঞ, বিজেপি-কথিত ‘বীর’ সাভারকর জেল সুপারিন্টেন্ডেন্টের উদ্দেশে নিচের বয়ানটি জমা দেনঃ
‘আমি এই মর্মে স্বীকার করছি যে, আমার বিচার ছিল সঠিক এবং শাস্তিও ছিল যথাযথ। আমি অতীতে যে হিংসার পথ গ্রহণ করেছিলাম, সেটি আন্তরিকভাবে ঘৃণায় পরিহার করছি এবং সর্বশক্তিতে আইন এবং সংবিধানকে সমর্থন করার কর্তব্যের দায়বদ্ধতা আমি অনুভব করছি এবং ভবিষ্যতে আমাকে যতদূর অনুমতি দেওয়া হবে ততদূর পর্যন্ত সংস্কারকে সফল করে তুলতে আমি ইচ্ছুক।’
(ফ্রন্টলাইন পত্রিকায় প্রকাশিত দলিল, ৭ এপ্রিল, ১৯৯৫)