অভিন্ন দেওয়ানি বিধিঃ সাধারণ সংসারেও ভিন্ন ভিন্ন নিয়ম আছে

অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালু আরএসএস তথা বিজেপির একটি মূল রাজনৈতিক কর্মসূচি। সেই কর্মসূচিকেই দেশে চালু করতে উঠেপড়ে লেগেছেন প্রধানমন্ত্রী। অভিন্ন দেওয়ানি বিধির প্রয়োজনীয়তা বোঝাতে তিনি দলের এক কর্মীসভায় বলেছেন, ‘‘কোনও পরিবারের যদি প্রত্যেক সদস্যের জন্য আলাদা আইন থাকে, তা হলে কি সেই সংসার চালানো যায়?” প্রধানমন্ত্রী ভেবেছেন বোধহয় একটি জবরদস্ত উদাহরণ তিনি দিয়েছেন। কথাটি হঠাৎ শুনলে তা মনে হতেও পারে যে, ঠিকই তো, যদি একই পরিবারের প্রত্যেকের জন্য আলাদা আইন থাকে তা হলে মুহূর্তে মুহূর্তে সংঘর্ষ বাধবে এবং সংসারও অচল হয়ে পড়বে। কিন্তু একটু গভীরে ভাবলেই বোঝা যাবে কথাটি প্রধানমন্ত্রী সস্তা হাততালি পাওয়ার জন্যই বলেছেন।

সবাই জানেন, পরিবারে কতগুলো নিয়ম বা অলিখিত বিধি থাকে এবং তা প্রত্যেক সংসারেই থাকে। তা না থাকলে সংসার চলে না এবং সেই বিধি সংসারের সব সদস্যের জন্য এক নয়। সংসারে একজন শিশুকে যে ভাবে দেখা হয় সে ভাবে অন্যদের দেখা হয় না। আবার প্রবীণদের জন্য সংসারে কতগুলো বিধি থাকে যা অন্যদের জন্য থাকে না। ছোটদের চলাফেরা নিয়ে যে বিধিনিষেধ থাকে তা বড়দের জন্য থাকে না। কারও হয়তো সন্ধ্যা আটটার মধ্যে বাধ্যতামূলক বাড়ি ফেরার নিয়ম, আবার রোজগেরে কাউকে গভীর রাত পর্যন্ত কর্মক্ষেত্রে থাকতে হয়। খাওয়াদাওয়ার ক্ষেত্রেও দেখা যায় শিশুদের জন্য একরকম খাবার, বয়স্কদের জন্য আর এক রকম, আবার বাকিদের জন্য আর একরকম। পরিবারের সবচেয়ে দুর্বল সদস্য যে, তার জন্য একটু বিশেষ ব্যবস্থা করা পরিবারের বাঁধুনি শক্ত করে। এই যে পার্থক্য, এটা প্রয়োজন থেকেই। সেই প্রয়োজনটা সংসারের সদস্যদের কল্যাণের জন্যই। তাতে কখনও সংসারে সংঘর্ষ বাধে না। বরং এমন বিধিনিষেধ যে-সংসারে নেই, সেই সংসারই আর সংসার থাকে না, মেসবাড়ি হয়ে যায়। ফলে এক দেশ এক আইন বোঝাতে প্রধানমন্ত্রী যে সংসারের যুক্তি দিয়েছেন তা নেহাতই ছেঁদো।

সংসার কী ভাবে চলে প্রধানমন্ত্রী বোধহয় তার খোঁজই রাখেন না। ফলে এই তুলনা বাদ দেওয়াই ভাল। কিন্তু যেটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন, তা হল, প্রধানমন্ত্রী কি নিজে দেশটাকে একটা সংসারের মতো ভাবেন, যার কর্তা তিনি? তিনি কি সত্যিই মনে করেন, হিন্দু, মুসলমান, খ্রিস্টান, অন্য ধর্মাবলম্বীরা, আদিবাসী, বনবাসী, জনজাতি, পাহাড়বাসী সবাই সেই এক পরিবারের সদস্য? আর সেই সব সদস্যের মঙ্গলের জন্যই তিনি অভিন্ন আইন আনতে চাইছেন? প্রধানমন্ত্রী তথা বিজেপির গত এক দশকের শাসনের দিকে তাকালে কি তাই মনে হয়?

বিজেপির গত এক দশকের ইতিহাস আসলে মুসলিম এবং অন্য ধর্মের মানুষদের বিরুদ্ধে লাগামহীন বিদ্বেষ তৈরির ইতিহাস। ইতিহাসে মুসলিম যুগকে মুছে ফেলতে উঠেপড়ে লেগেছেন তাঁরা। তাদের খাদ্যের অধিকার, ধর্মাচরণের অধিকার, ভারতীয় হিসাবে গণতান্ত্রিক অধিকার নিয়ে বসবাসের অধিকার একের পর এক কেড়ে নিচ্ছেন তাঁরা। খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধেও একই রকমের আচরণ তাঁদের। প্রধানমন্ত্রীরা তো হিন্দুরাষ্ট্র কায়েম করার কথা বলেন? তবে হিন্দুসমাজের মধ্যে যে হাজারটা বিভাজন-বৈষম্য রয়েছে সেগুলি দূর করতেই বা তৎপর হন না কেন তাঁরা? তিনি তো সদ্য আমেরিকায় গিয়ে গলার শির ফুলিয়ে বলে এলেন, ভারতের শিরায় শিরায় নাকি গণতন্ত্রের প্রবাহ চলেছে। তা হলে এ কেমন গণতন্ত্র যেখানে জন্মের ভিত্তিতে অধিকার নির্ধারিত হয়? গণতন্ত্রে তো সকল নাগরিকের সমান অধিকার। কিন্তু এখনও কেন হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মধ্যেই উঁচু জাত নিচু জাত টিকে রয়েছে? কেন তথাকথিত নিচু জাতের একটা বড় অংশের মানুষ তাঁদের ইচ্ছামতো সব হিন্দু মন্দিরে ঢোকার অনুমতি পান না। কেন আজও বহু প্রদেশে ব্রাহ্মণ এলাকার কুয়ো বা পুকুরে জলপানেরও অধিকার নিম্নবর্ণের মানুষের নেই? কেন আজও পরিবারের সম্মান রক্ষায় হত্যা বহাল তবিয়তে চলছে? কেন নিম্নবর্ণের উপর উচ্চবর্ণের মানুষের অত্যাচার ধারাবাহিক ভাবে চলতে পারছে? এ-সব বন্ধ করতে নরেন্দ্র মোদির সরকার কী ব্যবস্থা নিয়েছে? সমাজ জুড়ে যুগ যুগ ধরে যে হাজারটা বৈষম্য অনড় হয়ে রয়েছে, যার জন্য নতুন করে আইন করতে হবে না, আবার এমন বহু বৈষম্যের বিরুদ্ধে আইন রয়েছে অথচ কার্যকর হয় না, সেই সব বৈষম্য দূর করতে এই তৎপরতার ছিটেফোঁটাও দেখা যায় না কেন?

নাগরিক পরিচয়ই তো গণতন্ত্রের মূল কথা। তবে ধর্মের ভিত্তিতে রাষ্ট্র তৈরির ডাক তাঁরা দিচ্ছেন কীসের ভিত্তিতে? তাঁরা তাঁদের এক দশকের শাসনে সংখ্যলঘু মুসলমানদের প্রায় দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত করে দিয়েছেন। তা হলে দেশের মানুষ যদি এ আশঙ্কা করে যে, বিজেপির অভিন্ন দেওয়ানি আইন তৈরির ডাক আসলে লোকসভা নির্বাচনের আগে অভিন্নতার নামে ভিন্নতাকে আরও খুঁচিয়ে তুলে হিন্দু ভোটকে একজোট করার উদ্দেশ্যেই, তার কী উত্তর দেবেন বিজেপি নেতারা?