তেলের দাম বৃদ্ধি নিয়ে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারগুলি সাধারণ মানুষকে আর আগের মতো বিভ্রান্ত করতে পারছে না৷ এতদিন পেট্রল–ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধির বিরুদ্ধে আন্দোলনের জবাবে ক্ষমতাসীন ডান–বাম সব সরকারের বুলি ছিল, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেড়েছে, আমরা কী করব? সাধারণ মানুষ অনেক সময়ই এই বক্তব্যের জবাব দিতে পারত না৷ এখন সাধারণ মানুষের কাছে এটা দিনের আলোর মতো স্পষ্ট, আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বাড়লেও বা ডলারের সাপেক্ষে টাকার দাম কমলেও দেশের বাজারে পেট্রোপণ্যের দাম এত বাড়ত না, যদি না কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারগুলি এমন বিপুল পরিমাণে ট্যাক্স চাপাত৷
কত ট্যাক্স নেয় কেন্দ্র ও রাজ্য? কেন্দ্রীয় সরকার প্রতি লিটার পেট্রলে উৎপাদন শুল্ক্ নেয় ১৯.৪৮ টাকা, রাজ্য সরকার ভ্যাট আদায় করে ১৬.৮৫ টাকা৷ দুই ট্যাক্স মিলে দাঁড়ায় ৩৬.৩৩ টাকা৷ ১০ সেপ্ঢেম্বর ভারত বনধের দিন পেট্রল পাম্পে এক লিটার পেট্রলের দাম ছিল ৮৩.৬১ টাকা৷ কেন্দ্র ও রাজ্যের ট্যাক্স বাদ দিলে সাধারণ মানুষ পেট্রল কিনতে পারত ৪৯.২৮ লিটার দরে৷ ডিজেলের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় উৎপাদন শুল্ক লিটার প্রতি ১৫.৩৩ টাকা৷ রাজ্যের ভ্যাট ১১.২৯ টাকা৷ দুই ট্যাক্স মিলে দাঁড়ায় ২৬.৬২ টাকা৷ ভারত বনধের দিনে ১ লিটার ডিজেলের দাম ছিল ৭৫.৬৮ টাকা৷ এই ট্যাক্স বাদ দিলে সাধারণ মানুষ ৪৯.০৬ টাকা দিয়ে ডিজেল কিনতে পারত৷ তা হলে পেট্রল–ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধির জন্য এক তরফা আন্তর্জাতিক বাজারকেই ‘কেষ্টা ব্যাটা’ বানানোর কোনও মানে নেই৷ আসল দায়ী কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারগুলি৷
পেট্রল–ডিজেলের দাম যেমন যেমন বাড়ে সেই মতো বেড়ে চলে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারগুলির আয়৷ গত সাড়ে চার বছরে মোদি সরকার তেল থেকে ১১ লক্ষ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় করেছে৷ ২০১৬–’১৭ সালে রাজ্যগুলি তেল থেকে আয় করেছিল ১.৭ লক্ষ কোটি টাকা৷ পশ্চিমবঙ্গ সরকার আয় করেছিল প্রায় ৬.৫ হাজার কোটি টাকা৷ ভারতীয় স্টেট ব্যাঙ্কের হিসাব বলছে, সাম্প্রতিক এই মূল্যবৃদ্ধিতে রাজ্যগুলি তাদের নিয়মিত কর আদায়ের থেকে অতিরিক্ত ২২,৭০০ কোটি টাকা বেশি আদায় করবে৷ এই অতিরিক্ত আয় রাজ্য সরকারের বাজেটের হিসাবের বাইরে৷ স্বাভাবিকভাবেই এই টাকা ধরে রাজ্যের উন্নয়নমূলক কাজের পরিকল্পনা হয়নি৷ ফলে সরকার জনস্বার্থের কথা বিন্দুমাত্র চিন্তা করলে এই টাকা জনগণের কাছে ফিরিয়ে দিতে পারে৷ কীভাবে দিতে পারে? পেট্রোপণ্যের দাম কমিয়ে অথবা সম পরিমাণ টাকা ভর্তুকি দিয়ে৷ মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী ভারত বনধের চাপে তেলে লিটার প্রতি মাত্র ১ টাকা ছাড় ঘোষণা করেছেন, যা নামমাত্র৷ কেন্দ্রীয় সরকারের উচিত এই মুহূর্তে তেলের উপর চাপানো যথেচ্ছ কর কমিয়ে জনজীবনে সুরাহা আনা৷ অথচ উভয় সরকারই জনগণের দুর্ভোগ নিয়ে নীরব৷ কারণ তেলের দাম যত বাড়ছে ততই কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের আয় বেড়ে চলেছে৷ এই বাড়তি আয়ের অধিকাংশ জনকল্যাণে খরচ না করে হয় পুঁজিপতিদের করছাড় হিসাবে দিচ্ছে, না হয় ব্যাঙ্কগুলি থেকে পুঁজিপতিদের লোপাট করা টাকার ঘাটতি হিসাবে ব্যাঙ্কগুলিকে মিটিয়ে দিচ্ছে৷ অন্য দিকে পেট্রোপণ্যের দাম নির্ধারণ থেকে নিয়ন্ত্রণ তুলে নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার তেল কোম্পানিগুলিকে ইচ্ছে মতো দাম বাড়ানোর সুযোগ করে দিয়েছে৷ যার ফলে কোম্পানিগুলি লাগামছাড়া মুনাফা করছে৷ আর এর সমস্ত বোঝা বইতে হচ্ছে দেশের সাধারণ মানুষকে– যারা ইতিমধ্যেই মূল্যবৃদ্ধি, পরিবহণের ভাড়াবৃদ্ধি, বেকারি প্রভৃতি হাজারটা সমস্যায় বিপর্যস্ত৷ এ নিয়ে কেন্দ্র রাজ্য কোনও সরকারেরই কোনও হেলদোল নেই৷ দেশের সাধারণ মানুষ সম্পর্কে সরকারগুলির এই চরম নিস্পৃহ মনোভাবই এগুলির জনবিরোধী চরিত্রকে স্পষ্ট করে দিচ্ছে৷ জনগণ নয়, মালিক শ্রেণির স্বার্থ রক্ষাই এই সরকারগুলির লক্ষ্য৷ নাম আর পতাকার রঙের পার্থক্য যা–ই থাকুক, আসলে ভোটবাজ এই সব দলগুলিই পুঁজিপতি শ্রেণির পলিটিক্যাল ম্যানেজার হিসাবে কাজ করছে৷
(৭১ বর্ষ ৮ সংখ্যা ২১ সেপ্টেম্বর, ২০১৮)