সম্প্রতি সেন্ট্রাল অ্যাডভাইসারি বোর্ড অফ এডুকেশনের বৈঠকে কেন্দ্রীয় নারী ও শিশুকল্যাণ মন্ত্রী মানেকা গান্ধী প্রস্তাব দিয়েছেন, পডুয়াদের মধ্যে সহিষ্ণুতা বাডাতে স্কুলে স্কুলে আবার ধর্মীয় নীতিশিক্ষা চালু করা হোক, যাতে এক ধর্মের পডুয়া অন্য ধর্ম সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারবে৷ এতে নাকি পডুয়ারা একে অন্য ধর্মের প্রতি সংবেদনশীল ও শ্রদ্ধাশীল হবে৷ সে জন্য নীতিশিক্ষার নামে অন্য ধর্মভিত্তিক সব বই স্কুলগুলিতে পড়ানো দরকার৷ বিজেপি ও সংঘ পরিবার সবচেয়ে বেশি ধর্মের কথা বলে৷ কিন্তু তাদের মধ্যে সহিষ্ণুতা কোথায়? তারা কি আদৌ অন্য ধর্মের প্রতি সহনশীল? বাস্তবে তারা ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ছডাচ্ছে, সাম্প্রদায়িকতা ছডাচ্ছে, গো–রক্ষার নামে মুসলমান ও দলিতদের ওপর নানাভাবে আক্রমণ করছে, এমনকী তাদের হত্যা করছে৷ তারা যুক্তিবাদী মানসিকতার মানুষদের এবং যাঁরা তাদের উগ্র হিন্দুত্ববাদী উন্মত্ততার বিরোধিতা করছেন তেমন লেখক–বুদ্ধিজীবী–সাংবাদিকদের হত্যা পর্যন্ত করছে৷ এমনকী কে কী খাবে সে বিষয়েও ফতোয়া দিচ্ছে৷ বিজেপির সর্বভারতীয় নেতৃবৃন্দ ও সাংসদ থেকে শুরু করে নানা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীরাও উস্কানি দিয়ে চলেছেন উগ্র সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের বিষ ফেনিয়ে তুলতে৷ সম্প্রতি একটা সিনেমার মুক্তি নিয়েও তারা হাঙ্গামা করছে, স্কুলবাসও তাদের আক্রমণের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না৷ বিজেপি পরিচালিত সরকারগুলি এই হাঙ্গামা দমনে কার্যকরী ভূমিকা নিচ্ছে না৷ এরকম আরও অনেক উদাহরণ দেওয়া যায়৷ তবে শুধু হিন্দু মৌলবাদীরা নয়, যারাই যেকোনও ধর্মীয় মৌলবাদের চর্চা করে তারাও অসহিষ্ণুতার জন্য দায়ী৷ যেমন মুসলিম মৌলবাদীরা ধর্মের নামে মানুষের শিরশ্চেদ করে তার ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে দিচ্ছে৷ অর্থাৎ ধর্মের চর্চা বা ধর্মশিক্ষার সঙ্গে সহিষ্ণুতার কোনও সম্পর্ক নেই৷ এর সঙ্গে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রশ্ন জড়িত৷
কংগ্রেসসহ অন্য দলগুলিও, যারা বিভিন্ন সময় কেন্দ্রে ও বিভিন্ন রাজ্যে ক্ষমতাসীন আছে বা ছিল, তারাও কোথাও উগ্রভাবে আবার কোথাও প্রচ্ছন্নভাবে ধর্মকে ভোটের স্বার্থে কাজে লাগায়৷ অর্থাৎ দেশে অসহিষ্ণুতার পরিবেশ সৃষ্টি হওয়ার জন্য দায়ী ভোটবাজ দলগুলি, আর তার মধ্যে প্রধান ভূমিকা মানেকা গান্ধীর দলের৷ আর একেই অজুহাত করে তিনি স্কুলে ধর্মীয় নীতিশিক্ষা চালু করার প্রস্তাব করছেন৷ কিন্তু সংবিধান অনুযায়ী ভারত একটি ধর্মনিরপেক্ষ দেশ৷ তাই স্কুলে ধর্মশিক্ষা দেবার তাঁর এই প্রস্তাব সংবিধান বিরোধী নয় কি?
অতীতে এক সময় ধর্মের খানিকটা প্রগতিশীল ভূমিকা থাকলেও আজ তা শাসক শ্রেণির হাতে তাদের শাসন–শোষণ টিকিয়ে রাখার হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে৷ ধর্মশিক্ষা ও ধর্মীয় মূল্যবোধ আজ আর মানুষকে প্রগতির পথ দেখাতে পারে না, মানুষকে উন্নত নীতি–নৈতিকতার সন্ধান দিতে পারে না৷ তাই রামমোহন, বিদ্যাসাগর প্রমুখ ভারতীয় নবজাগরণের মনীষীরা ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক শিক্ষা প্রবর্তন করতে চেয়েছিলেন৷ ধর্মবিশ্বাসী না হয়েও যে অত্যন্ত উচ্চ মূল্যবোধের অধিকারী হওয়া যায় আমাদের দেশে তার জ্বলন্ত উদাহরণ বিদ্যাসাগর৷ তা ছাড়া শহিদ–ই–আজম ভগৎ সিং, সাহিত্যিক শরৎচন্দ্র ধর্মবিশ্বাসী ছিলেন না৷ অথচ এঁরা উচ্চ মূল্যবোধের অধিকারী ছিলেন৷
তাই বিজেপির একজন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী যখন স্কুলে ধর্মীয় মূল্যবোধ শিক্ষা দেবার কথা বলেন তখন তার উদ্দেশ্য ধর্মীয় শিক্ষার নামে হিন্দুত্ববাদী চিন্তার প্রসার ঘটানো, ধর্মীয় অন্ধতা সৃষ্টি করা, ধর্মের নামে আরও বিভাজন সৃষ্টি করা– এ সন্দেহ কি অমূলক?
ডঃ প্রদীপ কুমার দত্ত, অবসরপ্রাপ্ত প্রধান
পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, প্রেসিডেন্সি কলেজ