আধুনিক সভ্যতায় তেল প্রাণিদেহে রক্তের মতো গুরুত্বপূর্ণ। এর গতি যত অপ্রতিহত থাকে সভ্যতাও ততখানি সচল থাকে। পরিবহণ জ্বালানি হিসাবে তেল প্রত্যক্ষ এবং অপ্রত্যক্ষ দু’ভাবেই গভীর প্রভাবিত করে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রাকে। অথচ সেই তেল নিয়ে কী করছে রাষ্ট্রায়ত্ত এবং বেসরকারি তেল কোম্পানিগুলি? সরকারি মদতে দেশের মানুষের উপর কার্যত অবাধ লুঠ চালাচ্ছে তারা।
তিন রাষ্ট্রায়ত্ত তেল সংস্থা–ইন্ডিয়ান অয়েল (আইওসি), ভারত পেট্রলিয়াম (বিপিসিএল) এবং হিন্দুস্তান পেট্রলিয়ামের (এইচপিসিএল) মিলিত মুনাফা ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে পৌঁছল ৮১ হাজার কোটি টাকায়। বেসরকারি কোম্পানিগুলি মুনাফা করেছে আরও বেশি। বাস্তবে নজিরবিহীন এই মুনাফা। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের নিচু দাম এবং রাশিয়ার তেল অতি সস্তায় পাওয়ার সুবাদেই কোম্পানিগুলির এই বিপুল মুনাফা। স্বাভাবিক ভাবেই সরকারের কাছে দেশজুড়ে সাধারণ মানুষের দাবি, আন্তর্জাতিক বাজারে সস্তা তেলের সুবিধা সাধারণ মানুষকেও একই রকম ভাবে পেতে দিতে হবে। তেলের দাম কমলে পরিবহণ খরচ কমে গিয়ে যেমন তা মুল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে এনে সঙ্কটগ্রস্ত জনজীবনে অনেকখানি সুরাহা আনতে পারত, তেমনই কৃষিক্ষেত্রেও সেচের খরচ কমলে কৃষকদের চাষের খরচ অনেকখানি কমত।
২০২২-এ ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর মার্চে অশোধিত ব্রেন্ট ত্রুডের দাম ব্যারেল প্রতি ১৪০ ডলারে পৌঁছয়। সেই সময়ে তেল কোম্পানিগুলি ভারতীয় বাজারে ডিজেলের দাম লিটার প্রতি ৯০ টাকার আশেপাশে এবং পেট্রলের দাম বাড়িয়ে লিটার প্রতি ১০০ টাকার আশেপাশে তুলে নিয়ে যায়। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম গত বছরের এপ্রিল-সেপ্টেম্বরে অর্ধেকে (৭২ ডলার) নেমে আসে এবং পরে তা সামান্য বাড়লেও ৮০ থেকে ৮৫ ডলারের মধ্যেই ঘোরাফেরা করে। অথচ দেশের বাজারে কোম্পানিগুলি তেলের দাম একই রকম চড়া রেখে দেয়। ফলে জনগণ কম দামের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়। কিন্তু কোম্পানিগুলি বিপুল মুনাফা লুটে নেয়।
এ তো গেল আন্তর্জাতিক বাজারে সস্তা তেলের সুবিধা থেকে সাধারণ মানুষকে বঞ্চিত করার বিষয়টি। এ ছাড়াও রয়েছে রাশিয়া থেকে অতি সস্তায় তেল আমদানি করে মুনাফা লুটের আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ২০২২-এর ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরই আমেরিকা রাশিয়ার অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দেওয়ার লক্ষ্যে তার তেল-গ্যাস রফতানিতে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। ফলে ন্যাটোর আওতাভুক্ত ইউরোপের দেশগুলি, যারা রাশিয়ার তেল-গ্যাসের উপর প্রায় পুরোপুরি নির্ভরশীল ছিল সেখানে রাশিয়ার তেল রফতানি বন্ধ হয়ে যায়। অথচ রাশিয়ার অর্থনীতি তেলের ব্যবসার উপর অনেকখানিই নির্ভরশীল। এই পরিস্থিতিতে রাশিয়া ভারতকে আন্তর্জাতিক বাজারের থেকে অনেক কম দামে তেল বিক্রির প্রস্তাব দেয়। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম ব্যারেল পিছু ১৪০ ডলারে পৌঁছে গেলেও রাশিয়া ভারতীয় কোম্পানিগুলিকে মাত্র ৪০ ডলারে, এমনকি তার থেকেও কম দামে তেল দিতে রাজি হয়। এই সুযোগ কাজে লাগায় ভারত সরকার। বেসরকারি তেল কোম্পানিগুলি রাশিয়ার তেল অতি সস্তায় আনতে থাকে।
ভারত তার প্রয়োজনের ৮৫ শতাংশ তেল বিদেশ থেকে আমদানি করে। যুদ্ধের আগে পর্যন্ত ভারত ইরাক এবং সৌদি আরব থেকেই বেশির ভাগ তেল আমদানি করত। রাশিয়া থেকে আমদানি করত মাত্র ০.২ শতাংশ তেল। আর ২০২২-২৩ অর্থবছরে ভারতের ৩৫ শতাংশ তেলই এসেছে রাশিয়া থেকে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এসেছে আগের বছরের থেকেও ৫৭ শতাংশ বেশি। এই অতি সস্তার তেল শোধন করে বেসরকারি কোম্পানিগুলি আন্তর্জাতিক বাজারের দামে ইউরোপ সহ বিভিন্ন দেশে বিক্রি করেছে। ফলে বেসরকারি তেল কোম্পানিগুলির মুনাফা আকাশ ছুঁয়েছে। অথচ কেন্দ্রের বিজেপি সরকার এই সস্তা তেলের কোনও সুবিধা দেশের জনগণকে পেতে দেয়নি।
দেশের অভ্যন্তরের খনিগুলি থেকে যে সব সরকারি-বেসরকারি কোম্পানিগুলি তেল তুলে আন্তর্জাতিক বাজারের চড়া দামে দেশে এবং বিদেশে বিক্রি করে তাদের সেই বিপুল মুনাফার উপর সরকার মাঝে মাঝে ‘পড়ে পাওয়া’ (উইন্ড ফল) ট্যাক্স চাপায়। জনগণের চোখে ধুলো দিতে এই ট্যাক্স মাঝেমধ্যে চাপালেও প্রায় তা তুলে নেওয়া হয়, না হলে নামমাত্র নেওয়া হয়।
কারও কারও ধারণা, রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানিগুলির মুনাফা তো দেশের কল্যাণে তথা জনগণের কল্যাণের কাজেই লাগে। ফলে ঘুরপথে তা জনগণকেই সুরাহা দেয়। বাস্তবে যারা এমন করে ভাবেন, পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের চরিত্র সম্পর্কে তাঁদের কোনও ধারণা নেই, থাকলেও তা অত্যন্ত ভাসাভাসা। একটি পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের প্রশাসন পরিচালনার জন্য যতটুকু প্রয়োজন সেটুকু বাদ দিলে রাষ্ট্রীয় পুঁজির বাকি সমস্ত অর্থই খরচ হয় পুঁজিপতি শ্রেণি, মূলত একচেটিয়া পুঁজির সেবায়। সরকার এই টাকায় পুঁজিপতিদের কর ছাড় দেয়, ব্যাঙ্ক থেকে বিপুল পরিমাণ ঋণ নিয়ে তাদের শোধ না করা বিরাট অঙ্কের এনপিএ মিটিয়ে দিতে প্রতি বাজেটে বিপুল পরিমাণ বরাদ্দ করে এবং এই ঋণ খেলাপির হিসাব ব্যাঙ্কের খাতা থেকেও মুছে ফেলে। এই টাকায় সরকার পুঁজিপতি-শিল্পপতিদের ব্যবসার জন্য, শিল্প স্থাপনের জন্য সস্তায় বা বিনামূল্যে জমি, জল, বিদ্যুৎ, রাস্তঘাট, রেললাইন প্রভৃতি নানা ভাবে পরিকাঠামো গড়ে দেয়। পুঁজিপতিরা প্রায়ই আর্থিক সঙ্কটের মায়াকান্না কাঁদে এবং সরকার সেই সঙ্কট থেকে উদ্ধারের নামে লক্ষ কোটি টাকার ‘ত্রাণ-প্যাকেজ’ ঘোষণা করে রাষ্ট্রীয় ভাণ্ডার থেকে তাদের খয়রাতি দেয়।
লক-ডাউনের সময়ে যখন বিশ্বজুড়ে তেলের ব্যবহার প্রায় শূন্যে নেমে এসেছিল, তখন বিদেশ থেকে বিনা খরচে তেল আমদানির সুযোগ পেয়েছিল তেল কোম্পানিগুলি। সেই তেল মজুত রাখার জন্য ভারত সরকার বিরাট আয়তনের দুটি ভূগর্ভস্থ তেল মজুত ভাণ্ডার গড়ে দিয়েছিল। একটি অন্ধ্রপ্রদেশের বিশাখাপত্তনম বন্দরে এবং অপরটি কর্ণটকের ম্যাঙ্গালোর বন্দরে। সম্প্রতি সরকার রাশিয়ার সস্তা তেল মজুত করার জন্য আরও বড় একটি মজুত ভাণ্ডার গড়ে দিচ্ছে বেসরকারি কোম্পানিগুলিকে পিপিপি মডেলে। যার আনুমানিক খরচ ধরা হয়েছে ৫৫১৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকার তার রাষ্ট্রীয় ভাণ্ডার থেকে মিটিয়ে দেবে ৩৩০৮ কোটি টাকা। বিপরীতে জনগণের জন্য সরকার ব্যয় করে ছিটেফোঁটা। এমনকি শিক্ষা-স্বাস্থ্যের জন্য এতদিন যতটুকু বরাদ্দ করছিল এখন সেটুকুও বাতিল করে দিচ্ছে।
স্বাভাবিক ভাবেই রাষ্ট্রায়ত্ত তেল কোম্পানিগুলির মুনাফার সঙ্গে জনস্বার্থের কোনও সম্পর্ক নেই। আর বেসরকারি তেল কোম্পানিগুলি, যারাই তেল থেকে সবচেয়ে বেশি মুনাফা করছে, কার্যত তারাই সরকারের তেল-নীতি তৈরি করে দেয়, এমনকি তেলমন্ত্রী কে হবে, তা-ও তারা ঠিক করে দেয়। বাস্তবে সরকারগুলি এই সব কোম্পানি তথা ধনকুবেরদের তল্পিবাহক মাত্র। তাই সরকার তাদের মুনাফা ছেঁটে জনগণকে সুবিধা দেওয়ার কথা বলতেই পারে না। কারণ, সরকার কোম্পানিগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করে না, উল্টেকোম্পানিগুলিই সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করে। এটাই পুঁজিবাদ।