মারণ রোগে আক্রান্ত কোনও শিশুর মাকে সেই মর্মান্তিক সংবাদটি দিতে গিয়ে দরদি চিকিৎক ভাবেন, ‘আমার ভুল হলেই খুশি হতাম’৷ কিন্তু কঠিন সত্যকে অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই৷ এমনই এক পরিস্থিতির সামনে আজ দাঁড়িয়ে আমরা৷
পাশ–ফেল নিয়ে ১৯৮০ থেকে এস ইউ সি আই (সি) ক্রমাগত যে হুঁশিয়ারি দিয়ে এসেছে, দেখা যাচ্ছে তা অক্ষরে অক্ষরে মিলে গেছে৷ কিন্তু আমরা গভীরভাবে দুঃখিত, ব্যথিত শুধু নয় অত্যন্ত উদ্বিগ্ন৷ কারণ টালবাহানা করতে করতে যত দিনে কেন্দ্রীয় মানব সম্পদ উন্নয়নমন্ত্রী ঘুম ভেঙে উঠে আগামী শিক্ষাবর্ষ থেকে পঞ্চম আর অষ্টম শ্রেণিতে পাশ–ফেল চালু করার কথা বলছেন, ততদিনে কোটি কোটি ছাত্র–ছাত্রীর শিক্ষা জীবনের চরম ক্ষতি হয়ে গেছে৷ তার প্রমাণ মিলেছে ন্যাশনাল অ্যাচিভমেন্ট সার্ভে নামক সম্প্রতি প্রকাশিত সমীক্ষার রিপোর্টে৷
সমীক্ষায় দেখা গেছে, প্রথম শ্রেণি থেকে পাশ–ফেল প্রথা তুলে দিয়ে সারা দেশের কোটি কোটি ছাত্র–ছাত্রীর ভবিষ্যতকে চরম অন্ধকারের মধ্যে ঠেলে দিয়েছে কেন্দ্রীয় এবং রং–বেরঙের ঝান্ডাধারী হরেক দলের রাজ্য সরকারগুলি৷ বিরাট একটা প্রজন্মের শিক্ষার ভিতটাকেই সম্পূর্ণ নড়িয়ে দেওয়া হয়েছে৷ অথচ ১৯৮১ সালে পশ্চিমবঙ্গে যখন প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পাশ–ফেল প্রথা তুলে দেওয়ার ঘোষণা করেছিল সিপিএম পরিচালিত তৎকালীন রাজ্য সরকার, সে সময় তাদের যুক্তি ছিল এতে ড্রপআউট কমবে, শিক্ষার মান বাড়বে৷ ২০০৯ সালে কেন্দ্রের কংগ্রেস সরকার শিক্ষার অধিকার আইনের নাম করে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত এই নো–ডিটেনশন অর্থাৎ শিখুক না শিখুক সকলেই পাশ, এই ব্যবস্থা চালু করার সময়েও একই যুক্তি দিয়েছিল৷ কিন্তু এস ইউ সি আই (সি) দল ১৯৮১ সাল থেকেই বলে আসছে এদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় সকলকেই নির্বিচারে উপরের ক্লাসে তুলে দেওয়ার নীতি চালু হলে তা সাধারণ গরিব–মধ্যবিত্ত ঘরের ছাত্র–ছাত্রীদের শিক্ষার ভিতকে নষ্ট করে দেবে৷ সারা দেশের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, বিজ্ঞানী, বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে গড়ে ওঠা সেভ এডুকেশন কমিটিও একই আশঙ্কা বারবার ব্যক্ত করেছে৷ এই সর্বনাশা নীতি বাতিলের দাবিতে প্রায় ৩৭ বছর চলছে আন্দোলন৷
কেন্দ্রীয় মানব সম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রক গত বছর নভেম্বরে সারা দেশের ৩৬টি রাজ্য ও কেন্দ্র–শাসিত অঞ্চলের ৭০০ জেলার সরকারি, সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত এবং বেসরকারি স্কুলের ২৫ লক্ষ ছাত্র–ছাত্রীকে নিয়ে যে সমীক্ষা চালিয়েছে (ন্যাশনাল অ্যাচিভমেন্ট সার্ভে) তার সাথে পুরোপুরি মিলে যাচ্ছে এই আশঙ্কা৷ ইংরেজি, অঙ্ক, পরিবেশ বিজ্ঞান, সমাজ বিদ্যা এবং ভারতীয় ভাষায় ছাত্র–ছাত্রীদের শিক্ষা কেমন হচ্ছে তা যাচাই করতে গত নভেম্বরে এনসিইআরটি তার পরীক্ষা নেয় তৃতীয়, পঞ্চম এবং অষ্টম শ্রেণিতে৷ পরে দশম শ্রেণিকে যুক্ত করেও একটি সমীক্ষা হয়৷ তাতে দেখা যাচ্ছে ছাত্র–ছাত্রীরা যত উপরের ক্লাসে গেছে তত তাদের শিক্ষার মান নেমেছে৷ তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র–ছাত্রীরা যেখানে গড়ে ৬৪ শতাংশ প্রশ্নের উত্তর করতে পেরেছে, পঞ্চম শ্রেণিতে গিয়ে তা দাঁড়িয়েছে ৫৪ শতাংশ, অষ্টম শ্রেণিতে ৪২ শতাংশ, দশমে গিয়ে তা ৪০ শতাংশের নিচে৷ সবচেয়ে শোচনীয় ফল হয়েছে অঙ্ক এবং ইংরেজির৷ যদিও এই গড় দেখে সবটা বোঝা যাবে না৷ কারণ বেসরকারি নামী–দামি স্কুলগুলি যে বোর্ডের অধীনে সেই আইসিএসই এবং সিবিএসই বোর্ডের ছাত্র–ছাত্রীদের ফল অনেক ভাল৷ খুব খারাপ ফল হয়েছে রাজ্য বোর্ডগুলির ছাত্র–ছাত্রীদের৷
নামী–দামি বেসরকারি স্কুলে নানাভাবে পাশ–ফেল প্রথা চালু আছে৷ এদের অনেকগুলিই ক্রিশ্চিয়ান মিশনারি পরিচালিত হওয়ায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায় পরিচালিত স্কুলের মর্যাদা পায়৷ ফলে সেখানে শিক্ষার অধিকার আইনের সব ধারা কার্যকরী নয়৷ তারা যথাযথ পরীক্ষা নিচ্ছে৷ সে কারণেই এইসব স্কুলের খুব কদর৷ এছাড়াও উচ্চবিত্ত ঘর থেকে ছাত্র–ছাত্রীরা যে সমস্ত স্কুলে আসে তাদের ক্ষেত্রে বাড়ির পরিবেশ পড়াশোনার অনেকটা অনুকুল, প্রাইভেট টিউটরের সাহায্য তারা অনেক বেশি নিতে পারে৷ ফলে তাদের ফলও হয়েছে ভাল৷ সমীক্ষা দেখিয়েছে সাধারণ সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত বা সরকারি স্কুলে পাশ–ফেল প্রথাহীন পরীক্ষা ক্রমাগত গুরুত্ব হারিয়েছে৷ শিক্ষক এবং ছাত্র উভয়ের কাছেই তথাকথিত মূল্যায়নের কোনও মানে নেই৷ অভিভাবকরাও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এনিয়ে মাথা ঘামাননি৷ কারণ নম্বর যাই হোক পরের ক্লাসে উঠতে তো কোনও অসুবিধা নেই ফলে যত উপরের দিকে গেছে তত ছাত্র–ছাত্রীরা খুঁটিয়ে শেখার আগ্রহ হারিয়েছে৷ তৃতীয় শ্রেণিতে যাও বা একটু শিখেছে ক্রমাগত উপরের দিকে তার প্রায় সবটাই ভুলে বসে আছে৷ এক সমীক্ষক বলেছেন, বহু ক্ষেত্রে শিক্ষকরা এবং স্কুল কর্তৃপক্ষ যেন ‘বাতিল ক্যানেস্তারার মতো’ কোনও মতে একেক দল ছাত্রকে একেকটা ক্লাসের গণ্ডির বাইরে ছুঁড়ে দিয়েই দায়িত্ব সেরেছেন৷ এর থেকে বেশি কোনও দায়বদ্ধতার দায় শিক্ষামন্ত্রকেরও নেই৷
এর আগেও পশ্চিমবঙ্গে পাশ–ফেল তুলে দেওয়ার শোচনীয় ফলের কথা এসেছিল অশোক মিত্র শিক্ষা কমিশনের রিপোর্টে৷ কমিশনের মাথায় সিপিএম দলের প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী থাকলেও কমিশন অস্বীকার করতে পারেনি যে পাশ–ফেল তুলে দিয়ে শিক্ষার মান নেমেছে৷ কিছুদিন আগেও প্রতীচী ট্রাস্টের রিপোর্ট দেখিয়েছে পশ্চিমবঙ্গে সাধারণ স্কুলের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রদের অনেকেই দ্বিতীয়–তৃতীয় শ্রেণির অঙ্ক করতে পারে না৷ শুদ্ধ বাংলা বাক্যও লিখতে পারে না৷ মানুষ অভিজ্ঞতা দিয়েও দেখছেন, বেশিরভাগ বাংলা মাধ্যম বা হিন্দি–উর্দু ইত্যাদি মাধ্যম স্কুলে পড়াশোনার পাট প্রায় উঠে যেতে বসেছে৷ ফলে একেবারে মধ্যবিত্ত এমনকী নিম্নমধ্যবিত্ত বহু মানুষও আধপেটা খেয়েও সন্তানের শিক্ষার কথা ভেবে ছুটছেন বেসরকারি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের দিকে৷ সেই সমস্ত স্কুলের মান কেমন এটুকুও বিচার কেউ করছেন না৷ পশ্চিমবঙ্গে বর্তমান রাজ্য সরকারও এই ব্যবসার সন্ধানে বাংলা মাধ্যম স্কুলে ইংরেজি মাধ্যম চালু করতে চাইছে৷ তাই তারাও পাশ–ফেল চালু নিয়ে টালবাহানা করে চলেছে৷ পরিকল্পিত ভাবেই সরকারি এবং সাহায্যপ্রাপ্ত স্কুলগুলির মান পুরোপুরি ধ্বংস করে দেওয়ার ফলে বেসরকারি স্কুলের যথেচ্ছ ব্যবসা রমরমিয়ে চলছে৷ তাতে মার খাচ্ছে সামগ্রিকভাবে শিক্ষার মান৷ দেশের কয়েকটি প্রজন্মের কোটি কোটি সন্তান শিক্ষাগত দিক থেকে পঙ্গু হয়ে গেল শুধু এই একটি নীতির ফলেই৷
এই মারাত্মক পরিণতি যে অবশ্যম্ভাবী তা বারবার বলেছে এস ইউ সি আই (সি)৷ মার্কসবাদ–লেনিনবাদ-শিবদাস ঘোষের শিক্ষার আলোকে এই দলের নেতৃত্ব একেবারে প্রথমেই সরকারের অভিসন্ধিকে ধরতে পেরেছিল৷ তাই যেদিন সিপিএম ফ্রন্ট সরকারের সিদ্ধান্ত জানা গিয়েছিল, ঠিক সেদিন থেকেই শুরু হয়েছিল আন্দোলন৷ এস ইউ সি আই (সি) দলের আন্দোলনের পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবীরাও রাস্তায় নামেন ইংরেজি ও পাশ–ফেল পুনঃপ্রবর্তনের দাবিতে৷ সরকারি নীতিকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে শুরু হয় চতুর্থ শ্রেণির বেসরকারি বৃত্তি পরীক্ষা৷ ১৯ বছর আন্দোলন চলার পর ১৯৯৮ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি এই দাবিতে বাংলা বনধে অভূতপূর্ব জনসমর্থন দেখে সিপিএম ফ্রন্ট সরকার প্রাথমিক স্তরে ইংরেজি ফিরিয়ে আনতে বাধ্য হয়েছিল৷ কিন্তু নানা অজুহাতে পাশ–ফেল প্রথাকে ফেরায়নি৷ আবার কংগ্রেস সরকার যখন শিক্ষার অধিকার আইনের নামে সংসদে পাশ–ফেল তুলে দেওয়ার সর্বনাশা সিদ্ধান্তকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত বর্ধিত করার কথা বলে, সেদিন সংসদে একমাত্র প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর হিসাবে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন এস ইউ সি আই (সি)–র প্রতিনিধি ডাক্তার তরুণ মণ্ডল৷ তৃণমূল, সিপিএম, বিজেপি যারা তখন সরকারের পক্ষে বা বিরোধী আসনে, সকলেই সমর্থন করেছিল এই সর্বনাশা সিদ্ধান্তকে৷
এই অবস্থায় এস ইউ আই (সি) সারা দেশজুড়ে আন্দোলনে নামে৷ পাশাপাশি শিক্ষাবিদদের উদ্যোগে সেভ এডুকেশন কমিটির নেতৃত্বে শিক্ষাবিদ ও শিক্ষাপ্রেমী মানুষও রাজ্যে রাজ্যে আন্দোলনে নেমেছেন, দাবি তুলেছেন– এক মুহূর্তও আর বিলম্ব নয়, এখনই প্রথম শ্রেণি থেকে পাশ–ফেল প্রথা চালু কর৷ আন্দোলন রাজ্যে রাজ্যে আলোড়ন তুলেছে৷ পশ্চিমবঙ্গে ২০১৭ সালের ১৭ জুলাই এই দাবিতে বাংলা বনধের পক্ষে ব্যাপক জনসমর্থন দেখে রাজ্যের তৃণমূল সরকার লিখিত প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল এই দাবি তারা এখনই মানবে৷ অন্যান্য রাজ্যেও এই দাবিতে আন্দোলন ব্যাপক মানুষের সমর্থনে বলীয়ান৷ অথচ এখনও কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকারগুলি জনমতের কোনও মূল্য না দিয়ে নানা অজুহাতে পাশ–ফেল প্রথা ফিরিয়ে আনার কাজে টালবাহানা চালিয়ে যাচ্ছে৷ করছি–করব বলে সময় নষ্ট করছে, যাতে প্রকৃত উচ্চমানের শিক্ষা থেকে গরিব মধ্যবিত্ত ঘরের কোটি কোটি ছাত্র–ছাত্রী বঞ্চিতই থেকে যায়৷ বুর্জোয়া শাসকরা জনগণের শিক্ষাকে ভয় পায়, তাই এই অপচেষ্টাকে তারা সহজে ছাড়তে চাইছে না৷
সরকারের এই টালবাহানা বন্ধ করে অবিলম্বে প্রথম শ্রেণি থেকেই পাশ–ফেল প্রথা চালু করতে হবে এই দাবি আজ সারা ভারতের সাধারণ গরিব–মধ্যবিত্ত খেটেখাওয়া মানুষের৷ কোনও সরকারের সাধ্য নেই তাকে উপেক্ষা করার৷ কোনও সরকারই শেষ কথা বলে না, বলে সুসংবদ্ধ সচেতন জনগণ৷ পাশ–ফেল প্রথা ফিরিয়ে আনার আন্দোলন আবার তা প্রমাণ করেছে৷
(৭০ বর্ষ ৪২ সংখ্যা ৭জুন, ২০১৮)