ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলনের বিজয় থেকে শিক্ষা নিয়ে শ্রমিকদের উপরে ক্রমবর্ধমান আক্রমণ প্রতিহত করতে এআইইউটিইউসি সহ ১০টি কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ন ও বিভিন্ন কর্মচারী সংগঠনের ফেডারেশনগুলি ২৩-২৪ ফেব্রুয়ারি সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে। কেন্দ্রের বিজেপি সরকার শ্রমিক স্বার্থের আইনগুলি পাল্টে দিয়ে শ্রমিকদের এতদিনের অধিকারগুলি কেড়ে নিতে চলেছে। মালিক শ্রেণির স্বার্থে শ্রমিকদের অর্জিত অধিকার কেড়ে নিতে ইতিমধ্যেই ২৯টি শ্রম আইন বাতিল করে ৪টি শ্রম বিধি আনা হয়েছে। এই শ্রম বিধি কী? কেন তা আপত্তিজনক? কারণ শ্রম বিধির ফলে বেশিরভাগ শ্রমিক শ্রম আইনের আওতার বাইরে চলে যাবে। এর ফলে মালিকরা অবাধে শ্রমিক ছাঁটাই করতে পারবে, লে-অফ, ক্লোজার, লক-আউট করে শ্রমিকদের পথে বসাতে পারবে। মালিকদের এই সব স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে ধর্মঘট করার যে অধিকার শ্রমিকদের ছিল, এই শ্রম বিধির মাধ্যমে সেই ধর্মঘটের অধিকার অনেকটাই কেড়ে নেওয়া হয়েছে। ফলে শ্রমিকদের পিঠ আজ দেওয়ালে ঠেকে গেছে। ব্যাপক জনগণকে যুক্ত করে সাধারণ ধর্মঘটের মতো প্রতিরোধ গড়ে না তুললে একে প্রতিহত করা কঠিন হবে। তাই এই বনধ অত্যন্ত জরুরি প্রয়োজন হিসাবে দেখা দিয়েছে।
শ্রমিকদের সামনে একটা মারাত্মক বিপদ হল, ফিক্সড টার্ম এমপ্লয়মেন্ট । এতে পূর্বের মতো স্থায়ী কাজ আর থাকছে না। স্থায়ী কাজ না থাকার বিপদ হল মজুরিও অনিশ্চিত। যে কোনও সময় ছাঁটাই করার, বেতন কমিয়ে দেওয়ার বিপদ থাকছে। এই যে মারাত্মক অর্থনৈতিক আক্রমণ দেশের শ্রমজীবী মানুষের উপর মোদি সরকার নামিয়ে আনছে, এর বিরুদ্ধেই এই বনধ।
এরই পাশাপাশি সরকারি ও রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রগুলিকে বেসরকারিকরণের জন্য সরকার উঠে পড়ে লেগেছে। সেই উদ্দেশ্যেই আনা হয়েছে কুখ্যাত ‘ন্যাশনাল মনিটাইজেশন পাইপলাইন স্কিম’। এর মধ্য দিয়ে সরকার রাষ্ট্রায়ত্ত সম্পদগুলি কর্পোরেট সংস্থাকে দেবে, তার বিনিময়ে তারা আগামী চার বছরে ৬ লক্ষ কোটি টাকা আয় করবে।
সরকার কী কী দেবে বেসরকারি সংস্থাকে? রেল, জাতীয় সড়ক, বিদ্যুৎ উৎপাদন ও পরিবহণ, তেল ও গ্যাসের পাইপলাইন, ২৫টি বিমানবন্দর, জাহাজবন্দর, স্টেডিয়াম সহ আরও বহু সম্পদ রয়েছে এই তালিকায়। এগুলি দেশের মানুষের ট্যাক্সের টাকায় গড়ে উঠেছে। বিজেপি সরকার জলের দরে এগুলি বেসরকারি মালিককে বেচে দিচ্ছে।
পশ্চিমবঙ্গ সহ বিভিন্ন রাজ্যের জাতীয় সড়কের বিভিন্ন অংশে টোল আদায় ও দেখাশোনার দায়িত্ব বেসরকারি সংস্থার হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে। এর ফল হবে জাতীয় সড়ক দিয়ে চলাচলের জন্য বেশি ট্যাক্স দিতে হবে। রেলের ৪০০টি স্টেশন, ৯০টি দূরপাল্লার ট্রেন, দার্জিলিং সহ পাঁচটি টয় ট্রেন, ইস্টার্ন ও ওয়েস্টার্ন ডেডিকেটেড ফ্রেট করিডর, কোঙ্কন রেলওয়ে কলোনি ও রেলের স্টেডিয়াম বেসরকারি সংস্থা ব্যবহার করে মুনাফা তুলবে। হাওড়া সহ ১২টি ক্লাস্টারের ১০৯ জোড়া ট্রেন চালাবে বেসরকারি সংস্থা। তারা জনগণকে পরিষেবা দিতে আসবে না, সর্বোচ্চ মুনাফা করবে। সেজন্য সর্বোচ্চ পরিমাণে মাশুল দিতে হবে সাধারণ মানুষকে। এর বিরুদ্ধেই ধর্মঘট।
মানিটারি পাইপলাইনের মধ্যে দিয়ে নতুন করে যে সব রাষ্ট্রায়ত্ত সম্পদ মালিকদের হাতে যাচ্ছে সেগুলিতে অতি দ্রুত ব্যাপক মূল্যবৃদ্ধি এবং পরিষেবা ব্যয়ের বৃদ্ধি ঘটবে। ট্রেন, মেট্রোর ভাড়া বাড়বে, সড়ক পরিবহণের ব্যয় বাড়বে, তেল-বিদ্যুতের দাম বাড়বে, ফোনের খরচ সহ প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষকে ব্যয় করতে হবে আগের থেকে অনেক বেশি। মূল্যবৃদ্ধি আরও ব্যাপক আকার নেবে। চাকরির ক্ষেত্রে ছাঁটাই আরও তীব্র হবে। বিজেপি নেতাদের এই প্রকল্প পুঁজিপতি-কর্পোরেটদের বিপুল মুনাফা এনে দিলেও সাধারণ মানুষের জীবনে চরম সর্বনাশ নামিয়ে আনবে। সমাজের একটা বড় অংশ এই সব পরিষেবা থেকে বঞ্চিতই থেকে যাবে।
উদারিকরণের নামে বেসরকারিকরণ কংগ্রেসের নরসীমা রাও সরকারের সময়েই শুরু হয়। এই উদারিকরণ যে শুধুমাত্র বৃহৎ পুঁজিপতিদের জন্যই উদার এবং জনগণের জন্য চরম সর্বনাশা, তা উদারিকরণ শুরুর তিন দশক পর আজ দেশের মানুষ হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। স্বাধীনতার প্রথম চার দশকে সাধারণ মানুষের ছিটে-ফোঁটা যতটুকু জীবনমানের উন্নয়ন ঘটেছিল, গত তিন দশকের উদারিকরণের ধাক্কায় তা কোথায় তলিয়ে গিয়েছে। ধনী-দরিদ্রে বৈষম্য বেড়েছে রকেট গতিতে। একচেটিয়া পুঁজিপতিদের সম্পদের পরিমাণ আকাশ ছুঁয়েছে, সাধারণ মানুষ দারিদ্রের অতল গহ্বরে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। দেশের এক শতাংশ পুঁজিপতি আজ দেশের মোট সম্পদের ৭৩ শতাংশের মালিক। ২০২০-র তথ্য অনুযায়ী আন্তর্জাতিক ক্ষুধা সূচকের নিরিখে ১০৭টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান ৯৪। অথচ বিগত তিন দশকে বিশ্ব অর্থনীতিতে ভারতের অংশ তিনগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এই বৃদ্ধির সুফল ১ শতাংশ একচেটিয়া পুঁজির মালিকরাই লুঠ করছে। ৯৯ ভাগ সাধারণ দেশবাসী বঞ্চিত হয়ে চলেছে। তাদেরই শোষণ করে, লুঠ করে পুঁজিপতিদের ভাণ্ডারে জমা হয়েছে সব সম্পদ। আর সরকার এই শোষণের কেয়ারটেকার হিসাবে কাজ করছে। যতই বলা হোক ‘রাষ্ট্র সবার’, বাস্তবে তা ধোঁকা ছাড়া কিছু নয়। বাস্তবে এটি একটি পুঁজিবাদী রাষ্ট্র, পুঁজিপতি শ্রেণির স্বার্থরক্ষা করাই যার কাজ এবং সরকারের চরিত্রও পুঁজিপতি শ্রেণির রাজনৈতিক ম্যানেজারের।
যতদিন যাচ্ছে, শাসক দলগুলির জনবিরোধী চরিত্র প্রকট হচ্ছে। এদের জনবিরোধী ভূমিকার জন্যই মালিকরা সংগঠিত শিল্প জুট, চা, ইঞ্জিনিয়ারিং, কয়লা, ইস্পাত সহ সর্বক্ষেত্রে কাজের বোঝা বাড়াচ্ছে ও সামাজিক সুরক্ষা ভেঙে দিতে পারছে। বিড়ি, নির্মাণ শ্রমিক, হকার, মৎসজীবী, মোটরভ্যান, টোটো চালক সহ সকল অসংগঠিত শ্রমিকদের সামাজিক সুরক্ষার বিষয়টি চূড়ান্ত উপেক্ষিত এবং অনেকে বাঁচার মতো মজুরিও পান না। আশা, অঙ্গনওয়াড়ি, মিড-ডে মিল, পৌর স্বাস্থ্য কর্মী, প্রাণীবন্ধু সহ অন্যান্য স্কিম ওয়ার্কারদের সরকারি কর্মীর স্বীকৃতি এবং সামাজিক সুরক্ষার বিষয়টি কেন্দ্র-রাজ্য কোনও সরকারই গুরুত্ব দিচ্ছে না। পরিযায়ী শ্রমিকদের অবস্থা দুর্বিসহ। অতিমারি মোকাবিলার অগ্রণী সৈনিকদের উপযুক্ত নিরাপত্তা এবং বিমার সুবিধা নেই। অতি মুনাফার লক্ষ্যে সরকারি সহ সর্বক্ষেত্রে স্থায়ী কাজে অস্থায়ী কর্মী নিয়োগ করা হচ্ছে।
বারবার কেড়ে নেওয়ার পর সামান্য হলেও দেশে যতটুকু শ্রম আইন আছে মালিকরা প্রতিদিন তা লঙ্ঘন করছে। কিন্তু সরকার মালিকদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নিচ্ছে না। পেনশন সহ সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্প শ্রমিকদের জন্য যতটুকু ছিল তাও কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। এর বিরুদ্ধে যাতে শ্রমিক-কৃষক সহ সাধারণ মানুষের আন্দোলন গড়ে উঠতে না পারে তার জন্য বিভিন্ন কালা কানুনগুলোকে আরও কঠোর করা হচ্ছে। বাস্তবে অর্থনৈতিক রাজনৈতিক সমস্ত দিক থেকে শ্রমজীবী মানুষ এক শ্বাসরোধকারী পরিস্থিতিতে। এর বিরুদ্ধেই ১০টি কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ন ও স্বতন্ত্র জাতীয় ফেডারেশন সমূহের পক্ষ থেকে আগামী ২৩-২৪ ফেব্রুয়ারি ‘২২ দেশব্যাপী দু’দিনের সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দেওয়া হয়েছে। দাবি আদায়ের জন্য লাগাতার আন্দোলনের প্রস্তুতি চলছে।
এআইইউটিইউসি-র রাজ্য সম্পাদক কমরেড অশোক দাস বলেন, শ্রমিক আন্দোলনকে বিজয়ের লক্ষ্যে পৌঁছে দিতে হলে দীর্ঘস্থায়ী আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। সেজন্যই আন্দোলনের হাতিয়ার শ্রমিক সংগ্রাম কমিটি গড়ে তুলতে হবে কারখানায় কারখানায় এবং শ্রমিক বস্তিগুলিতে। অন্যান্য অংশের সাধারণ মানুষকেও এই আন্দোলনে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি।
গণদাবী ৭৪ বর্ষ ২০ সংখ্যা ২৪ ডিসেম্বর ২০২১