সংযুক্ত কিসান মোর্চা নয়া কৃষি আইন বাতিল সহ অন্যান্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ দাবিতে ২৭ সেপ্টেম্বর ভারত বনধের ডাক দিয়েছে। দেশের অর্ধেকের বেশি পরিবার কৃষিকাজের সাথে যুক্ত। স্পষ্ট সর্বনাশ বুঝে কৃষকরা কৃষিনীতি প্রত্যাহারের দাবিতে অনড় রয়েছেন। ভারত বনধকে সর্বাত্মক ভাবে সফল করার ডাক দিয়েছেন। কিন্তু দেশের বাকি অর্ধেক মানুষ, তাঁদের সঙ্গে এই আইনের কী সম্পর্ক, কেন তাঁরা এই আইনের বিরোধিতা করে বনধে সামিল হবেন? দেখা যাক, কী রয়েছে কৃষি আইনে? জনজীবনে তার আশঙ্কার দিকগুলিই বা কী?
কী আছে আইনে?
এক, অত্যাবশ্যকীয় পণ্য (সংশোধনী) আইন। এই আইনের বলে যে কোনও বহুজাতিক কোম্পানি বা ব্যবসায়ী কৃষিপণ্য কিনে যত খুশি মজুত করে রাখতে পারবে।
এই আইনের দ্বারা সরকার অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের অবাধ মজুতদারির সুযোগ ও যথেচ্ছ দাম বাড়াবার অধিকার দিয়েছে মজুতদার-কালোবাজারিদের। এই আইনের বলে এখন থেকে আম্বানি-আদানিদের মতো কৃষিপণ্যের একচেটিয়া ব্যবসায়ীরা ফসল ওঠার সময়েই, যখন দেশের নব্বই শতাংশ ছোট চাষি কম দামেই অভাবি বিক্রি করতে বাধ্য হয় তখন বেশির ভাগ ফসল কিনে নিয়ে বিশালাকায় সব হিমঘরে-গুদামে মজুত করে রাখবে। এর ফলে বাজারে কৃত্রিম অভাব তৈরি হবে এবং দাম বাড়বে লাফিয়ে। তখন কোম্পানিগুলি যথেচ্ছ দামে তা বিক্রি করবে। আর সরকারগুলি নিশ্চুপ হয়ে থাকবে। এতদিন মজুতদারির বিরুদ্ধে আইন ছিল। নির্বিষ হলেও কিছু সরকারি ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকি ছিল। আন্দোলন এবং গণবিক্ষোভের চাপে কখনও কখনও কিছু ব্যবস্থাও সরকারকে নিতে হত। কিন্তু এই নতুন আইনের পর আর সে বালাই থাকল না। এর মারাত্মক ফল একদিকে যেমন চাষিদের ভোগ করতে হবে, তেমনই দেশের সমস্ত অংশের সাধারণ মানুষকে ভোগ করতে হবে।
দুই, কৃষকদের (ক্ষমতায়ন ও সুরক্ষা) দামের আশ্বাস ও খামার পরিষেবা চুক্তি আইন। এই আইনের বলে বহুজাতিক কোম্পানিগুলি চুক্তিচাষের মাধ্যমে যে কোনও পণ্য কৃষকদের দিয়ে উৎপাদন করিয়ে নিতে পারবে।
অর্থাৎ চুক্তির মধ্য দিয়ে বহুজাতিক কোম্পানিগুলি চাষির থেকে ফসল কিনবে। বিজেপি নেতারা বলছেন, এর ফলে নাকি চাষিরা ন্যায্য দাম পাবে। বিজেপি নেতাদের কথা অনুযায়ী, আম্বানি-আদানি সহ বহুজাতিক কোম্পানিগুলি বিপুল অঙ্কের পুঁজি কৃষিক্ষেত্রে ঢালতে চলেছে চাষিদের বেশি দাম দেবে বলে। এর থেকে হাস্যকর আর কী হতে পারে! একদিকে দুই বিঘা, চার বিঘা জমির মালিক অসহায় চাষি, যার ঘরে ভাত নেই, পরনে নেই কাপড়। অন্য দিকে বিপুল আর্থিক ক্ষমতাধর বহুজাতিক কোম্পানি– রিলায়েন্স, আদানি, পেপসি, কোকাকোলারা। এদের মধ্যে হবে চুক্তি। চুক্তির অসংখ্য শর্ত, যা অশিক্ষিত বা অল্প শিক্ষিত চাষি ধরতেই পারবে না। শর্তের খেলাপ দেখিয়ে গরিব চাষিকে কোম্পানিগুলি বঞ্চিত করবে। চাষি পড়বে অসম লড়াইয়ে।
তিন, কৃষকের উৎপাদিত, কারবার ও বাণিজ্য (উন্নয়ন ও সুবিধা) আইন। এই আইনের বলে রাজ্য সরকার নিয়ন্ত্রিত রেগুলেটেড মার্কেট বা মান্ডির বাইরেও কৃষকরা যে কোনও ব্যবসায়ী বা বাণিজ্য সংস্থার কাছে তাদের উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করতে পারবে। এর মধ্যেও গভীর বিপদের আশঙ্কা রয়েছে।
এতদিন পর্যন্ত দেশের বেশির ভাগ রাজ্যেই বড় রিটেলারদের কৃষিপণ্য কিনতে হত এপিএমসি মান্ডির মাধ্যমে। নতুন আইন অনুযায়ী সরাসরি চাষির থেকে ফসল কিনতে পারবে কোম্পানিগুলি। প্রথমে বহুজাতিক পুঁজি কৃষককে একটু বেশি দাম দিয়ে প্রলোভিত করবে, আবার সরকারও ফসল কেনার ক্ষেত্রে গড়িমসি করবে, ঠিক মতো টাকা বরাদ্দ করবে না, ন্যূনতম সহায়ক মূল্য ঘোষণা করবে না এবং এমন অবস্থা তৈরি করবে যাতে চাষি সরকারি মান্ডিতে না গিয়ে কোম্পানিগুলির কাছেই ফসল বিক্রি করতে বাধ্য হয়। এইভাবে সরকারি এপিএমসি মার্কেটগুলো রুগ্ন হয়ে বন্ধ হয়ে যাবে এবং সমস্ত কৃষিপণ্যের একমাত্র ক্রেতা হবে কয়েকটি বহুজাতিক কোম্পানি। তারা কম দামে ফসল কিনে ইচ্ছেমতো দামে বিক্রি করবে। এতে চাষি যেমন বঞ্চিত হবে তেমনই সাধারণ ক্রেতারাও অনেক বেশি দামে কৃষিজাত সামগ্রী কিনতে বাধ্য হবে। ভোজ্য তেল, ডাল সহ নানা কৃষিজাত পণ্যে এর মারাত্মক কুফল ইতিমধ্যেই ফলতে শুরু করেছে।
কেন এই ভারত বনধ
করোনা অতিমারিতে বিপর্যস্ত দেশ। জীবিকা খুইয়েছেন কোটি কোটি মানুষ। ব্যবসাপত্রে নিদারুণ মন্দার ছায়া। বন্ধ অধিকাংশ ছাত্রছাত্রীর পড়াশোনা। মানুষের এই চরম দুঃসময়়ে তাদের পাশে দাঁড়ানোর পরিবর্তে পুঁজিপতি শ্রেণির ধূর্ত রাজনৈতিক ম্যানেজার কেন্দ্রের বিজেপি সরকার ঠিক এই সময়টাকেই বেছে নিয়েছে মানুষকে আরও সর্বনাশের দিকে ঠেলে দেওয়ার জন্য। এই সঙ্কটের সময়েও মালিক শ্রেণির মুনাফা আরও বাড়িয়ে তুলতে দেশের মানুষের উপর ব্যাপক মূল্যবৃদ্ধির বোঝা চাপিয়ে চলেছে তারা। মালিকদের অবাধে ছাঁটাইয়ের অনুমতি দিয়েছে, শ্রমিকদের অর্জিত অধিকারগুলি ছিনিয়ে নিয়ে কাজের সময় আট ঘন্টা থেকে বাড়িয়ে বারো ঘন্টা পর্যন্ত করে দিয়েছে। রেল, ব্যাঙ্ক, বিমা, বিদ্যুৎ, তৈলক্ষেত্র, বিমান, খনি ইত্যাদি রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলিকে একে একে পুঁজিমালিকদের কাছে বেচে দেওয়ার কাজ শুরু করে দিয়েছে। পাশাপাশি লক্ষ লক্ষ কোটি টাকার প্যাকেজ ঘোষণা করে তুষ্ট করে চলেছে দেশের পুঁজিপতি-শিল্পপতিদের। সরকারি দপ্তরেও তিন মাসের নোটিশে কর্মীদের ছাঁটাই করা যাবে। মালিকদের স্বার্থে যারা অতি দ্রুত এই আইন পাস করিয়েছে, সেই বিজেপি সরকারই কিন্তু এতগুলি বছরে কোটি কোটি অসংগঠিত শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরিটুকুও নিশ্চিত কর়েনি। নিশ্চিত করেনি দেশের সমস্ত মানুষের দু’বেলা অন্ন, কিংবা রোগের উপযুক্ত চিকিৎসা পাওয়ার অধিকার। এই চরম জনবিরোধী সরকারের সর্বনাশা নীতিগুলির বিরুদ্ধে সর্বশক্তি নিয়ে রুখে দাঁড়ানো ছাড়া মেহনতি মানুষের বাঁচার অন্য কোনও পথ খোলা নেই।
দেশের কৃষকরা এটা স্পষ্ট বুঝেছেন, নতুন এই কৃষি আইনের উদ্দেশ্য হল, খাদ্য সহ সমস্ত নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যকে বহুজাতিক পুঁজির হাতে তুলে দেওয়া। তারা জলের দরে কৃষকের ফসল কিনবে, আর অগ্নিমূল্যে সাধারণ মানুষের কাছে বিক্রি করে মুনাফা লুটবে। ফলে কৃষকদের আত্মহত্যার সংখ্যা বাড়তে থাকবে, সাধারণ মানুষের জীবন হবে আরও দুর্বিষহ। দ্বিতীয়ত, ফসলের দাম পাওয়ার যতটুকু সরকারি ব্যবস্থা দুর্বল হতে হতে এখনও টিকে আছে, তা-ও তুলে দেওয়া হবে। তার দ্বারা কৃষক সমাজ আরও বেশি করে একচেটিয়া পুঁজিপতিদের কৃপার পাত্র হবে। তৃতীয়ত, চুক্তি চাষ চালু করে কৃষকদের পরিণত করা হবে বড় পুঁজিমালিকদের ক্রীতদাসে। তাই পিছু হঠার কোনও জায়গা নেই। এই আইন চালু হলে তাঁরা ধ্বংস হয়ে যাবেন।
এই আইন চালু হলে বাস্তবে রেশন ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে, মজুতদারি-ফাটকাবাজি ব্যাপক ভাবে বাড়বে। যার পরিণতিতে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী সহ সর্বস্তরের ক্রেতারাও চূড়ান্তভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।
মাসের পর মাস লড়ছেন চাষিরা
সিংঘু, টিকরি, পালওয়াল, গাজিপুর প্রভৃতি দিল্লি সীমান্তে সব ধরনার জায়গাতেই লক্ষ লক্ষ কৃষক প্রবল ঠাণ্ডার মধ্যে, প্রখর গ্রীষ্মে খোলা আকাশের নিচে ২৬ নভেম্বর থেকে অবস্থান চালিয়ে যাচ্ছেন। তাঁদের সঙ্গে রয়েছেন পরিবারের মহিলা, শিশু, বৃদ্ধরা পর্যন্ত। ট্রাক্টরে ত্রিপল টাঙিয়ে, কোথাও ট্রাক্টর কিংবা লরির তলায় মাটিতেই ঘুমোচ্ছেন তাঁরা। লক্ষ লক্ষ কৃষক পারস্পরিক সহযোগিতার এক অভূতপূর্ব নজির স্থাপন করেছেন এই আন্দোলনে। ভেঙে গিয়েছে জাত-ধর্মের বেড়া। তাঁদের পাশে দাঁড়িয়েছে সমাজের সব স্তরের মানুষ। কিন্তু আম্বানি-আদানিদের মতো একচেটিয়া পুঁজির কাছে দাসখত লিখে দেওয়া বিজেপি সরকার এমনই অগণতান্ত্রিক, এমনই স্বৈরাচারী যে কৃষকদের দাবিগুলি মেনে নেওয়া দূরের কথা, সরকারের নেতা-মন্ত্রীরা আন্দোলন ভাঙতে কুৎসা রটাতে কখনও বলছেন এই কৃষকরা আসলে খলিস্তানি, কখনও বলছেন পাকিস্তানি। কিন্তু এ লড়াই কৃষকদের বাঁচার লড়াই। তাই পিছু হটার তাঁদের উপায় নেই।
আন্দোলনের ময়দান জুড়ে এখন তাই একটাই স্লোগান– হয় জয়, না হয় মৃত্যু। বাস্তবে কৃষকদের কাছে যেমন, তেমনই দেশের সাধারণ নাগরিকদের কাছেও এটা অস্তিত্বের সংগ্রাম। এই সংগ্রামে পিছু হটলে সর্বনাশ নেমে আসবে প্রতিটি সাধারণ নাগরিকের জীবনে। এই সংগ্রাম তাই শুধু কৃষকের নয়, আপনার-আমার সকলের। এই সর্বনাশ রুখতে ২৭ সেপ্টেম্বরের ভারত বনধ সর্বাত্মক সফল করার দায়িত্ব আজ দেশের সর্বস্তরের মেহনতি মানুষের কাঁধে এসে পড়েছে। সেই দায়িত্ব সর্বশক্তি দিয়ে পালন করতে হবে। এটাই বর্তমান সময়ের আহ্বান।