
করোনা অতিমারির প্রকোপে মানুষ যখন ঘরবন্দি, সেই সুযোগে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার যেভাবে অতি দ্রুততার সঙ্গে শিক্ষার প্রাণসত্তা ধবংসকারী জাতীয় শিক্ষানীতি চালু করতে উদ্যোগী হয়েছে, তার বিরুদ্ধে অল বেঙ্গল সেভ এডুকেশন কমিটি ৪ অক্টোবর অনলাইনে এক কনভেনশনের আয়োজন করে। রাজ্যের বিশিষ্ট বক্তারা তাতে বক্তব্য রাখেন। সভাপতিত্ব করেন প্রাক্তন উপাচার্য এবং কমিটির সভাপতি অধ্যাপক চন্দ্রশেখর চক্রবর্তী। মূল প্রস্তাব পাঠ করেন কমিটির সহ সম্পাদক ডঃ মৃদুল দাস।
কেন্দ্রীয় সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রকের প্রাক্তন সচিব জহর সরকার তাঁর আলোচনায় বলেন, ‘খসড়া শিক্ষানীতি’ রচনা কমিটির চেয়ারম্যান কস্তুরীরঙ্গন এই শিক্ষানীতি প্রণয়ন করতে গিয়ে মনে হয় ‘নির্দেশ পালন’ করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকে উপেক্ষা করে এই শিক্ষানীতিতে বিষাক্ত কেন্দ্রীকরণ করা হয়েছে। একটি মাত্র সংস্থা ন্যাশনাল রিসার্চ ফাউন্ডেশন সারা দেশের গবেষণা নিয়ন্ত্রণ করবে– এটা বিপজ্জনক ব্যাপার। ১০ শতাংশ মানুষ যেখানে ৮০ শতাংশ সম্পদ ভোগ করে সেখানে এই শিক্ষানীতি গ্রহণ করা হয়েছে ব্যবসায়ীদের হাতে শিক্ষাব্যবস্থা তুলে দেওয়ার জন্য।
পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন অ্যাডভোকেট জেনারেল বিমল চ্যাটার্জী বলেন, কেন্দীয় সরকার বলছে জিডিপির ৬ শতাংশ শিক্ষায় খরচ করা হবে। অথচ বিজেপি কেন্দ্রের সরকারে আসার আগে যা ৪ শতাংশ ছিল, সেই খরচ কমে ৩ শতাংশেরও নিচে নেমে এসেছে। শিক্ষানীতিতে ছোটবেলা থেকেই হিন্দুত্ববাদী শিক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা তারা করছে এবং বলছে ২০৪০ সাল পর্যন্ত এই শিক্ষানীতি চলবে। এ তো সকলকে হিন্দুত্ববাদী করার আয়োজন! অন্য ধর্মের মানুষকে দেশছাড়া করা, ‘ঘরওয়াপসি’ করা আর প্রতিবাদ করলে জেলে পোরা হচ্ছে এই সরকারের কাজ।
শিক্ষাবিদ অধ্যাপিকা মীরাতুন নাহার বলেন, শিক্ষানীতিতে আছে শুধু বিরক্তিকর ভাল ভাল কথার পুনরাবৃত্তি এবং দ্বিচারিতা। সংবিধানে যা আছে, তা পালনের কথা বলেছে, অথচ সংবিধান অনুযায়ী যুক্ত তালিকায় থাকা শিক্ষানীতি প্রণয়নে কেন্দ্র-রাজ্য যৌথভাবে তা রচনা করল না। বলেছে, সত্যান্বেষী তৈরি করবেন, অথচ নিজেরা প্রতিদিন মিথ্যাচার করে চলেছেন। শিক্ষানীতিতে পাশ-ফেল প্রথা ফিরিয়ে আনার কথা বলেনি, চার বছরের স্নাতকস্তরের লিবারেল এডুকেশন যেন ‘হযবরল’ ছাড়া আর কিছু নয়। এটা একদলীয় শিক্ষানীতি এবং এটা ‘অগণতান্ত্রিক’, ‘অ-শিক্ষানীতি’।
বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য অধ্যাপক অসিত চক্রবর্তী বলেন, ‘এক দেশ-এক বিধান’, ‘এক দেশ-এক ভাষা’, ‘এক দেশ-এক খাদ্য’, এক দেশ-এক পোষাক’-এর মতোই এক দেশ-এক শিক্ষা স্লোগানকেই এরা রূপায়ণ করতে চায়। এই শিক্ষানীতি গৈরিকীকরণের এবং শিক্ষাকে কর্পোরেটের হাতে তুলে দেওয়ার নকশা।
অল ইন্ডিয়া সেভ এডুকেশন কমিটির সাধারণ সম্পাদক এবং প্রেসিডেন্সি কলেজের পূর্বতন অধ্যাপক অনীশ রায় সারা দেশে এই শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে বিশিষ্ট মানুষদের একজোট হওয়ার ঘটনা বিবৃত করেন। তিনি দেখান, এই শিক্ষানীতি সম্পর্কে বলতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী আত্মনির্ভর ভারতের কথা বললেও আসলে প্রাক-প্রাথমিক বা উচ্চশিক্ষায় কেন্দ্রীয় সরকার আমেরিকার মডেল অনুসরণ করছে। শিক্ষা সহ সমস্ত জন-পরিষেবাকে বিশ্বজুড়ে ব্যবসায়িক পণ্যে পরিণত করার চুক্তি ‘গ্যাটস’-এর স্বাক্ষরকারী হয়ে তারা বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়কে এ দেশে ডেকে এনে শিক্ষা নিয়ে ব্যবসা করার দুয়ার খুলে দিচ্ছে।
অল বেঙ্গল সেভ এডুকেশন কমিটির সম্পাদক অধ্যাপক তরুণকান্তি নস্কর বলেন, এই শিক্ষানীতি দ্বিচারিতায় ভরা। একদিকে সরকার বলছে ‘সমমানের শিক্ষা’ নিশ্চিত করবে, অন্যদিকে নিজেরাই উচ্চশিক্ষায় তিনটি ভিন্ন মানের বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি করার কথা ঘোষণা করছে। তিনি এই শিক্ষানীতি প্রতিরোধে লক্ষাধিক গণস্বাক্ষর সংগ্রহ করে রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানো, সর্বত্র আন্দোলনের কমিটি গঠন ও নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে জেলায় জেলায় ধর্না বা অবস্থান আন্দোলনের কথা ঘোষণা করেন।
সভাপতি অধ্যাপক চন্দ্রশেখর চক্রবর্তী সব দিক থেকে সর্বনাশা এই শিক্ষানীতি প্রতিরোধ করার জন্য সকলের কাছে শক্তিশালী আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান জানান।