১৪ জানুয়ারি কলকাতা জেলা এনআরসি–সিএএ–এনপিআর বিরোধী নাগরিক কনভেনশনে যোগ দিতে কলকাতায় এসেছিলেন মোদি সরকারের কাশ্মীর নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে পদত্যাগী আইএএস অফিসার কান্নন গোপীনাথন৷ কলকাতা ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউটে সভার ফাঁকে তিনি গণদাবীকে একটি সাক্ষাৎকার দেন৷ সেটি এখানে প্রকাশ করা হল৷
গণদাবী : এই আন্দোলনে আপনি একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন৷ বিশেষত ভারতের বহু জায়গায় আপনিই এই এনআরসি বিরোধী আন্দোলনের সূচনা করেছেন৷ আন্দোলন শুরুর কথা কীভাবে মনে এল?
কান্নন গোপীনাথন : আমি তা মনে করি না৷ বস্তুত কাশ্মীরের প্রশ্নেও আমি ভেবেছি গণতন্ত্রে বিরুদ্ধ মতের একটা প্রকাশ অবশ্যই ঘটা দরকার৷ বহু মানুষ সরকারের এই পদক্ষেপকে ভ্রান্ত মনে করেছিলেন৷ কিন্তু বেশিরভাগই তা জনসমক্ষে প্রকাশ করেননি৷ এনআরসি নিয়ে বিভিন্ন শহরে নানা জায়গায় বহু জনের কাছে আমি অনুরোধ করেছি প্রতিবাদ শুরু করার জন্য৷ কিছু মানুষ এগিয়ে এসে প্রতিবাদ করেছেন৷ নানা ভাবে প্রতিবাদ হয়েছে৷ এটাই ছিল সূচনা৷
কাশ্মীর নিয়ে সরকার যা করেছে তার তুলনায় এনআরসি এবং নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন আরও বড় বিপদ ডেকে আনছে৷ আমি মনে করি এমনকি সরকারও জানে, এনআরসি এবং নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন একত্রে খুবই বিপজ্জনক৷
আমার একটা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা এই আন্দোলনের কথা ভাবার ক্ষেত্রে সাহায্য করেছে৷ এক সভায় কাশ্মীর প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার উপর আমি কিছু কথা বলেছিলাম৷ এক ছাত্রী আমায় প্রশ্ন করল, কী বাক স্বাধীনতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতার কথা বলছেন– আমি আজ নাগরিক, কাল নাগরিক থাকব কি না তারই কোনও নিশ্চয়তা নেই! আমার নাগরিকত্বই প্রশ্নের মুখে দাঁড়িয়েছে৷ তখনই আমি বুঝলাম আমার কাছে এর কোনও উত্তর নেই৷ নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়ার হুমকির ফলে মানুষ বিপন্ন বোধ করছে৷ এই অভিজ্ঞতা আমাকে ভাবায় যে, কিছু একটা করা দরকার৷
কলকাতায় এই আন্দোলন আগেই শুরু হয়েছে৷ কিন্তু সারা দেশে মানুষের মধ্যে এনআরসি–সিএএ ইত্যাদি নিয়ে সচেতনতা ছিল না৷ মানুষ বিষয়টা বুঝতে শুরু করতেই তাদের ভাবনা আসে যে একে রুখতে হবে৷ এটা এত বড় এক বিপদ যে, আপনি যদি একবার বিষয়টা বোঝেন তাহলে ঘরে আরামে বসে থাকা আপনার পক্ষে কোনওমতেই সম্ভব নয়৷
আপনি কি মনে করেন ৩৭০ ধারা বিলোপ, এনআরসি–সিএএ চালু এগুলি একই পরিকল্পনার অংশ?
আমার মনে হয় সাধারণ মানুষ জীবনের মূল সমস্যা বলে যা মনে করে, বিজেপির কাছে সেগুলি মূল নয়৷ মানুষের জীবনে মূল বিষয় হচ্ছে কর্মসংস্থান, অর্থনীতি এই সমস্ত৷ অন্যদিকে বিজেপি বা আরএসএসের সামনে মুখ্য বিষয় হচ্ছে ৩৭০ ধারা, এনআরসি, সিএএ ইত্যাদি৷ তাদের লক্ষ্য হিন্দু রাষ্ট্রের পথে হাঁটা৷ তারা আমাদের জীবনের মূল বিষয়গুলি থেকে আমাদের দৃষ্টি সরিয়ে দিতে চাইছে৷ এ জন্যই তাদের থামাতে হবে৷
শুধু ভোটের কথা ভেবে ওরা করছে এমন ভাবলে ভুল হবে৷ চাকরি বা অন্যান্য সুবিধা দিতে পারলে তো ওরা ভোট পেতই৷ কিন্তু আমাদের দেশের এবং জাতির ভিত্তিগত ক্ষেত্রেই ওরা আঘাত করেছে৷ একে যে কোনও মূল্যে রুখতে হবে৷ এটা শুধু ভোট রাজনীতির বিষয় নয়৷ ভারত বলতে যা আমরা বুঝি, সেই ধারণাটাকেই বদলে দেওয়ার, সেকুলার ভারতের ধারণাকেই ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা করছে৷ এর ফলে কে কিছু বেশি ভোট পাবে, কে ভোট হারাবে, এসব প্রশ্ন এখন অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেছে৷
আমার মনে হয় স্বাধীনতার পর কনস্টিটুয়েন্ট অ্যাসেমব্লির বিতর্কেই বিষয়টির সূচনা৷ যে সমস্ত মুসলমান ধর্মাবলম্বী মানুষ পাকিস্তানে চলে গিয়েও পরে ফিরে এসেছিলেন, তাঁদের প্রথমে যেতে বলা হয়েছিল, কিন্তু সেখানে কিছুই না পেয়ে তাঁরা ফিরে আসেন৷ প্রশ্ন উঠেছিল তাঁদের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে কি না? কনস্টিটুয়েন্ট অ্যাসেমব্লিতে বিতর্ক হয়েছিল আমরা কি কেবলমাত্র পাকিস্তান থেকে আসা হিন্দুদের নাগরিকত্ব দেব, না সকলকে দেব? কিন্তু সেখানে এমন মানুষ ছিলেন, যাদের এই দেশের মূল ধারণার সাথে সম্যক পরিচিতি ছিল৷ তাঁরা সিদ্ধান্ত করেন, আমরা এভাবে ভাগ করতে পারি না৷ সিদ্ধান্ত হয়, যাঁরাই ভারতে বাস করছেন, ভারতে জন্মেছেন, তাঁরাই ভারতের নাগরিক৷ তাঁদের ধর্মপরিচয় কী, পাকিস্তানে কী ঘটছে এগুলি আমাদের দেখার দরকার নেই৷ কিন্তু দু’জন মানুষ এই প্রশ্নগুলি তুলতে থাকলেন৷ সেই দু’জনের আদর্শগত উত্তরাধিকারীরাই এখন ক্ষমতায় বসেছেন৷ তাঁদের সামনে এখন এই কর্মসূচি পূরণ করাটা আবশ্যক হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ কিন্তু সেদিন যুক্তির সামনে এই চিন্তা পরাজিত হয়েছিল, ওরা পারেনি৷ এখন সরকারে বসে করার চেষ্টা করছে৷ কিন্তু সরকার যা ভাবে মানুষের শক্তি তার থেকে অনেক বেশি৷
৩৭০ ধারা বিলোপের বিরুদ্ধে আজকের মতো জোরালো প্রতিবাদ হল না দেখেই কি এই পদক্ষেপ নিতে সরকার সাহস পেয়েছে?
ঠিকই, এটা ছিল পরীক্ষামূলক পদক্ষেপ৷ এই দেখেই ওরা ভেবে নিয়েছিল ভারতীয় গণতন্ত্র এখন তাদের হাতের মুঠোয় এসে গেছে৷ ওরা ভেবেছিল সব ভারতীয়ই হয় লোভী, না হলে সরকারকে দেখে ভীত৷ ভেবেছিল মানুষকে কিছু পাইয়ে দেওয়ার লোভ দেখালে আর ভয় দেখালেই তাদের বশ করা যাবে৷ কিন্তু একবার যখন মানুষ সিদ্ধান্ত নেয়– আমরা জেলকে ভয় করি না, তারা যখন টাকার লোভকে জয় করে, তখন সরকারের হাতে করবার মতো কিছুই থাকে না৷
এই আন্দোলনে অনেক দিন পর আবার হাজারে হাজারে মানুষ বাড়ি ছেড়ে রাস্তায় নামছে৷ মায়েরা শিশু সন্তান কোলে রাস্তায় রাত কাটাচ্ছেন৷ শিক্ষকরা ছাত্রদের বলছেন, বই মুখে দিয়ে বসে থাকার সময় নয় এটা, রাস্তায় যাও৷ আপনার কী মনে হয়?
শিক্ষার উদ্দেশ্য কী? শিক্ষার উদ্দেশ্য তো নিছক অধ্যয়ন নয়৷ এর উদ্দেশ্য হল সমাজের চলার প্রক্রিয়াকে জানা, সমস্ত কাজের পিছনে যুক্তিকে বোঝা৷ যুক্তি দিয়ে সব কিছু বুঝতে পারা৷ ভুল ঠিককে বুঝতে শেখা, যে কোনও সিদ্ধান্তকে বিশ্লেষণ করা শুধু নয়, অন্যায় হলে তাকে প্রতিরোধ করতে শেখাও শিক্ষার উদ্দেশ্য৷ ভুল–ঠিক বিচার করতে সবচেয়ে ভাল পারে ছাত্ররাই৷ কারণ তারা নিঃস্বার্থভাবে কেবলমাত্র ঠিক–বেঠিক ধারণার ভিত্তিতেই তা করতে পারে৷ কিন্তু বয়স হলে চাকরির ভয়, ট্রান্সফারের ভয়, ব্যবসার ক্ষতির ভয়, আমার সুনির্দিষ্ট জীবযাত্রায় ছেদ পড়ার ভয়, ঠিক–বেঠিক বিচারের মাঝখানে এসে দাঁড়ায়৷ বলব, কি বলব না, ভাবনা এসে যায়৷ কিন্তু ছাত্ররা এ বিষয়ে খুব পরিষ্কার৷ তাদের হারাবার কিছু নেই, কিন্তু পাওয়ার আছে অনেক কিছু৷
আপনি কি মনে করেন এই আন্দোলন জয়ী হবে?
আন্দোলন হচ্ছে, এটাই গণতন্ত্রের একটা নিশ্চিত জয়৷ কিন্তু আমাদের আত্মপ্রসাদ লাভের সুযোগ নেই৷ শহরে বসে আমরা যা ভাবছি, তাকে গ্রামেও নিয়ে যেতে হবে৷ আমাদের বিপরীত পক্ষও বসে নেই৷ তারা বিভাজনকে বাড়ানোর চেষ্টাই করছে, আরও বেশি করবে৷
সরকারকে মানুষ প্রশ্ন করতে শুরু করেছে৷ এটাই এই আন্দোলনের বিরাট সাফল্য৷ স্বাধীনতা আন্দোলন এবং জয়প্রকাশ নারায়ণের আন্দোলনের পর এই আন্দোলনে সমস্ত স্তরের মানুষ রাস্তায় নেমেছেন৷ বুদ্ধিজীবী, ছাত্র, খেটে–খাওয়া মানুষ, সিনেমার তারকা, শিল্পী, হিন্দু–মুসলমান–শিখ সকলেই রাস্তায়৷ আমি গর্বিত যে আমি এই জাগরণের একটা অংশ হতে পেরেছি৷ এই জাগরণটাই সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ৷
একটা অসাধারণ ছবি দেখা যাচ্ছে, একজন ভারতীয় মুসলমান একই সাথে ভারতীয়ত্ব এবং তাঁর মুসলমানত্ব প্রকাশ করছেন৷ দেশে ২০ কোটি মুসলমান আছেন কিন্তু সাধারণ সময় তাঁরা যেন অদৃশ্য হয়ে থাকেন৷ আমরাও এটাকে স্বাভাবিক বলে মেনে নিই৷ আমরা তাঁদের এগিয়ে আসতে দিই না৷ কিন্তু এখন আমরা পরস্পর কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়ছি৷ বলি হিন্দু মুসলিম ভাই ভাই, কিন্তু দশজন মুসলমানের সাথে এক ঘরে থাকতে হলে আমরা অস্বস্তি বোধ করি৷ কিন্তু এখন তা কেটে যাচ্ছে৷ অন্তত বলা যায়, এসব জিনিস থেকে মুক্ত হতে শুরু করেছি আমরা৷ এটা একটা বিরাট পাওনা৷ ছাত্ররা এগিয়ে এসে নতুন করে ভাবাচ্ছে– কাকে বলে গণতন্ত্র৷ এই সমস্ত কিছুর সদর্থক প্রভাব আমাদের উপর পড়ছে৷ আমাদের সারা দেশের উপরই এই সদর্থক প্রভাব কাজ করবে৷ এই দিক থেকে দেখলে এই আন্দোলনের মূল্য আমাদের কাছে অসীম৷ এবং আমি পুরোপুরি নিশ্চিত আমরা সফল হব৷
কনভেনশনে আপনি বলেছেন, আইনি পথটাই সব নয়, নির্ণায়ক শক্তি হল জনগণ৷ এই প্রসঙ্গে একটা কথা মনে পড়ছে, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর কথা– তিনি বলতেন, মনুষ্যত্ব অর্জনের একমাত্র রাস্তা প্রতিবাদ করতে এগিয়ে আসা৷ আপনি কী মনে করেন?
ঠিক বলেছেন৷ আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি প্রতিবাদী আন্দোলনের মধ্য দিয়েই৷ জরুরি অবস্থার থেকে স্বাধীনতা পেয়েছি এই প্রতিবাদী আন্দোলনের মধ্য দিয়েই৷
প্রতিবাদ শুরু হয়েছে, তাকে চালিয়ে নিয়ে যেত হবে৷ এর যে গতিশীলতা তাকে ব্যবহার করেই আমরা সব মানুষের কাছে পৌঁছতে পারি৷ এর মধ্য দিয়েই বোঝানো যাবে কেন আমাদের বাঁচতে হলে ঐক্যবদ্ধ হতেই হবে৷ দুনিয়ার কোনও শক্তি নেই যা এই ঐক্যবদ্ধ ভারতের ধারণাকে আটকাতে পারে৷