বিদ্যুৎ মাশুল ৫০ শতাংশ কমানোর দাবিতে বিদ্যুৎ গ্রাহক সংগঠন অ্যাবেকা আন্দোলনের ডাক দিয়েছে৷ এ বিষয়ে তাঁদের বক্তব্য গণদাবীতে পাঠানোর জন্য আমরা অনুরোধ জানাই, লেখাটি অ্যাবেকার তরফ থেকে পাঠানো হয়েছে৷
এ কথা সকলেই স্বীকার করেন যে, পশ্চিমবঙ্গ এক সময় ভারতের মধ্যে অন্যতম উন্নত রাজ্য ছিল৷ সেই পশ্চিমবঙ্গ আজ সব দিক দিয়েই পিছিয়ে পড়েছে৷ অস্বাভাবিক হারে মূল্যবৃদ্ধি, ভয়াবহ বেকার সমস্যায় জর্জরিত জনজীবন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য সবই আজ পণ্যে পরিণত৷ রাজ্যের প্রায় সব কটি বড় শিল্পই বন্ধ৷ পূর্ববর্তী এবং বর্তমান কোনও সরকারের পক্ষেই বন্ধ শিল্পের দরজা খোলা সম্ভব হয়নি৷ শুধু নতুন বিনিয়োগ ধরার নাম করে চলেছে সরকারি কোটি কোটি টাকার অপচয়৷ আর চলছে এই সব বন্ধ কারখানার জমি ও যন্ত্রপাতি বিক্রি করে কোটি কোটি টাকা পকেটস্থ করার খেলা৷
এ কথা অনস্বীকার্য যে, কৃষি, ক্ষুদ্র–শিল্প ও ক্ষুদ্র ব্যবসার উপর নির্ভর করেই বেঁচে আছে রাজ্যের বেশির ভাগ মানুষ৷ সেই কৃষি, ক্ষুদ্র–শিল্প, ক্ষুদ্র ব্যবসাও আজ ধুঁকছে৷ যুব–জীবনের গভীর অনিশ্চয়তা, অস্থিরতা এবং ভোগসর্বস্বতার ফলে রাজ্যে বেড়ে চলেছে খুন, ধর্ষণ, রাহাজানি, দেহব্যবসা, নারী পাচার, শিশু পাচার প্রভৃতি অসামাজিক কাজ৷ এই দুঃখজনক পরিস্থিতির পরিবর্তনের জন্য প্রয়োজন অব্যাহত গতিতে কৃষি ও শিল্পের উন্নতি৷ সে উন্নয়ন ঘটানোর একটা প্রধান উপাদন হল বিদ্যুৎ৷ সেই কারণেই সমাজতান্ত্রিক রাশিয়া থেকে শুরু করে সব উন্নত দেশেই সকলের জন্য বিদ্যুৎ, ২৪ ঘন্টা উন্নত মানের এবং কম দামে বিদ্যুৎ সরবরাহের ব্যবস্থা করা হয়েছে৷ এখনও বহু দেশে, এমনকী ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে মাত্র ৫০ পয়সা ইউনিটে কৃষিতে বিদ্যুৎ দেওয়া হচ্ছে৷ আশ্চর্যের কথা হল, সমস্যা জর্জরিত পশ্চিমবঙ্গে কিন্তু বিদ্যুৎ মাশুল কমার পরিবর্তে লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েই চলেছে৷ বিগত সরকারের মতো বর্তমান সরকারও ইতিমধ্যেই ১৫ বার বিদ্যুৎ মাশুল বাড়িয়েছে৷
পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বিদ্যুৎ নীতির ফলে ভারতের মধ্যে এই রাজ্যেই বর্তমানে বিদ্যুতের মাশুল সব থেকে বেশি৷ সি ই এস সি–তে গড় ইউনিট ৭৩১ পয়সা আর সরকারি বিদ্যুৎ বণ্ঢন কোম্পানিতে ৭১২ পয়সা৷ এই অস্বাভাবিক বিদ্যুৎ বিল মেটাতে সকলেরই প্রাণান্তকর পরিস্থিতি৷ গরিব, মধ্যবিত্ত, গৃহস্থ, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, ক্ষুদ্র শিল্প সকলেরই বেহাল দশা৷ বিদ্যুৎ বিলের চাপে ক্ষুদ্র শিল্প বন্ধ হচ্ছে, এ রাজ্যেও কৃষক আত্মহত্যা করতে বাধ্য হচ্ছে৷ ফুলে ফেঁপে উঠছে বিদ্যুৎ ব্যবসায়ীরা৷
একদা ডানকানের কর্মচারী আর পি গোয়েঙ্কার পুত্র সঞ্জীব গোয়েঙ্কা বিদ্যুৎ বিক্রি করে হাজার হাজার কোটি টাকার মালিকে পরিণত হয়েছেন৷
আমরা দীর্ঘদিন ধরেই বলে আসছি, এই সংকটজনক পরিস্থিতির পরিবর্তনের জন্য রাজ্যে বিদ্যুৎ মাশুল কমানো প্রয়োজন৷ কৃষিতে ৫০ পয়সা ইউনিট, গৃহস্থ–ক্ষুদ্র শিল্প–ক্ষুদ্র ব্যবসায়ে ১ টাকা ইউনিটে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা দরকার৷ আমরা দেখিয়েছি, বিশ্বায়নের অর্থনীতির পরিপূরক বেসরকারিকরণ ও বাণিজ্যিকীকরণের নীতিকে কার্যকর করার জন্যই বিদ্যুৎ আইন–২০০৩ চালু করা হয়েছে– যার ফলে বিদ্যুৎও পণ্যে পরিণত হয়েছে৷ তা সত্ত্বেও সরকার সততা, নিষ্ঠার সাথে, কঠোর হস্তে এই আইনের কিছু বিষয় প্রয়োগ করলে বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলির আইনানুগ লভ্যাংশ রেখেই পশ্চিমবঙ্গে গড়ে ২৫০ পয়সা ইউনিটে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা যেতে পারে৷ বহু বছর ধরেই আমরা এই দাবিতে আন্দোলন করে চলেছি৷ লাঠি, গুলি, জেল কোনও কিছুই আমাদের পিছু হটাতে পারেনি৷
অবশেষে পরিস্থিতির কিছুটা পরিবর্তনের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে৷ কেন্দ্রীয় বিদ্যুৎ মন্ত্রী এবং রাজ্য বিদ্যুৎ নিয়ন্ত্রণ কমিশন বিদ্যুৎ মাশুল কমাতে বলেছেন কেন্দ্রীয় বিদ্যুৎমন্ত্রী৷ রাজ্যগুলিতে বিদ্যুৎ মাশুল যাতে ৩ টাকার মধ্যে রাখা যায় সেটা নিশ্চিত করতে বলেছেন এবং তা সব বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রেই (ইকনমিক ব্যুরো, নিউদিল্লি, ৩০–৪–২০১৭)
রাজ্য বিদ্যুৎ নিয়ন্ত্রণ কমিশন ২৮.১০.২০১৬–এর আদেশে বলেছে বিদ্যুৎ বন্টনের ব্যয় ইউনিট প্রতি ১ টাকা কমাতে হবে৷ কারিগরি ও বাণিজ্যিক ক্ষতি বড় শহরে ৪ শতাংশ, মফস্বল শহরে ৫ শতাংশ এবং গ্রামীণ এলাকায় ৮ শতাংশ কমাতে হবে৷ এ ছাড়া বাণিজ্যিক ক্ষতির পরিমাণ কমাতে হবে ২ শতাংশ৷
কারণ, বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রধান উপাদান কয়লার দাম কমে গিয়েছে ৪০ শতাংশ৷ দ্বিতীয়ত, কয়লার উপর জিএসটি ১২ শতাংশ কমে হয়েছে ৫ শতাংশ৷ কয়লার দাম কমার কারণ কী? কেন্দ্রীয় কয়লা সচিব অনিল স্বরূপ বলেছেন, কয়লার ৫০ মিলিয়ন টন অতি উৎপাদনের জন্য কোল ইন্ডিয়া কয়লার দাম ৪০ শতাংশ কমিয়েছে৷ কেন্দ্রীয় সরকার কোল ইন্ডিয়াকে কয়লার দাম কমিয়ে রাখতে বলেছে যাতে দেশে বিদ্যুৎ মাশুল কম রাখার বিষয়টি নিশ্চিত করা যায়৷
বিদ্যুৎ বিভাগের একজন সিনিয়র অফিসার বলেছেন, কয়লার দাম কমার এই সুযোগ সারা আর্থিক বছরেই পাওয়া যাবে৷ যে বিদ্যুৎ নিয়ন্ত্রণ কমিশন এত দিন বিদ্যুৎ কোম্পানির স্বার্থ রক্ষা করে এসেছে তারাও এই অবস্থায় বলতে বাধ্য হয়েছে, সিইএসসি এবং রাজ্য বিদ্যুৎ লিমিটেডের বন্টন ব্যয় প্রতি ইউনিটে ১ টাকা কমানো উচিত৷ কারিগরি ও বাণিজ্যিক ব্যয় কমানো উচিত বড় শহরে ৪ শতাংশ, মফস্বলে ৫ শতাংশ, গ্রামে ৮ শতাংশ৷ কারিগরি ও বাণিজ্যিক ক্ষতি যে কমেছে তা স্বীকার করে কোম্পানিগুলি সিক্সথ স্টেট অ্যাডভাইসরি কমিটি মিটিংয়ে বলেছে, পশ্চিমবঙ্গের কিছু শহরে আরএপিডিআরপি প্রয়োগ করার ফলে ২০১৬–র অক্টোবরে কারিগরি ও বাণিজ্যিক ক্ষতির পরিমাণ অনেকটাই কমেছে৷ গ্রাহকরা কি জানেন, ২ শতাংশ কারিগরি ও বাণিজ্যিক ক্ষতি কমার অর্থ কী? অর্থ হল, সিইএসসি–তে প্রায় ১৫০ কোটি, আর বন্টন কোম্পানিতে প্রায় ৫০০ কোটি টাকা সাশ্রয় হয়েছে৷ এই টাকা কোথায় গেল? এই বিপুল পরিমাণ টাকা মাশুল থেকে বাদ যাওয়ার কথা, তাতে মাশুল কমে যাওয়ার কথা৷
বর্তমান পরিস্থিতি হল বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলোর লাভের অংশ ঠিক রেখেই এবং কোনও ভর্তুকি না দিয়েই বিদ্যুতের মাশুল কমানো যায়, যদি সরকার চায়৷ অ্যাবেকা মনে করে, উপরোক্ত কারণে ৫০ শতাংশ বিদ্যুৎ মাশুল কমানো যেতে পারে৷ সরকার ও বিদ্যুৎ নিয়ন্ত্রণ কমিশন এ কথা ভাল করেই জানে৷ সেই কারণে ২০১৭–’১৮ সালের বিদ্যুৎ মাশুল এখনও ঘোষণা করেনি৷ কিন্তু বিদ্যুৎ আইন অনুযায়ী এই মাশুল ২০১৭ সালের এপ্রিল মাসের প্রথমে বা আবেদনের ১২০ দিনের মধ্যে ঘোষণা করার কথা ছিল৷ কারণ রাজ্য সরকার মাশুল না কমিয়ে কোম্পানিগুলোকে আরও মুনাফা বৃদ্ধির সুযোগ করে দিতে চাইছে৷ তাই সময় নিচ্ছে যাতে মাশুল কমাতে না হয়৷ জনসাধারণকে বিভ্রান্ত করার জন্য তাই বিদ্যুৎমন্ত্রী বলেছেন, বর্ষায় খনি থেকে কয়লা তোলা যায়নি৷ সেই কারণে বিদেশ থেকে বেশি দামে কয়লা কিনতে হবে৷ দ্বিতীয়ত, সেস ও পরিবহণ খরচ বেড়েছে৷ তৃতীয়ত ক্যাপটিভ খনি থেকে কয়লা উত্তোলন বন্ধ আছে ইত্যাদি৷ কিন্তু কয়লার দাম কমা, জিএসটি কমা এবং কারিগরি ও বাণিজ্যিক ক্ষতি কমার বিষয়ে নীরব রয়েছেন৷ বিদ্যুৎমন্ত্রীর এই চালাকির সুযোগ নিয়ে বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলোকে দিয়ে মাশুল বৃদ্ধির আবেদন করানো হয়েছে এবং জ্বালানি খরচ বৃদ্ধির অজুহাতে বিদ্যুৎ বিল বৃদ্ধির ব্যবস্থা করা হয়েছে৷ সরকারি প্রচারে বিভ্রান্ত না হয়ে কয়লার ৪০ শতাংশ দাম কমা, জিএসটি ৭ শতাংশ কমা এবং কারিগরি ও বাণিজ্যিক ক্ষতি ২ শতাংশ কমে যাওয়ার বিষয়টিকে ব্যাপক প্রচারে এনে দলমত নির্বিশেষে রাজ্যের দেড় কোটি বিদ্যুৎ গ্রাহক ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলন গড়ে তুললে বর্তমানে বিদ্যুৎ মাশুল অবশ্যই কমানো যায়৷ মাশুল কমলে মূল্যবৃদ্ধি কমবে, ক্ষুদ্র শিল্প, কৃষি, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা উপকৃত হবে৷
এমএলএ, এমপিরা কিছু করে দেবেন সেই ভরসায় না থেকে আসুন আন্দোলন গড়ে তুলি৷ রাজ্যের বিদ্যুৎ গ্রাহকদের প্রতি অল বেঙ্গল ইলেকট্রিসিটি কনজিউমার্স অ্যাসোসিয়েশন (অ্যাবেকা)–র এটাই আবেদন৷