বহুদিন পর ভারতে বর্তমান ছাত্র আন্দোলন সকলের সমীহ অর্জন করেছে৷ দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্বাভাবিক ফি–বৃদ্ধির বিরুদ্ধে দু’মাসেরও বেশি সময় ধরে আন্দোলন শুধু বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নয়, শাসক বিজেপি সরকারের বুকে কাঁপন ধরিয়েছে৷ পাশাপাশি আমজনতার মধ্যে আশা জাগিয়েছে৷ অন্যান্য উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও ফি–বৃদ্ধির বিরুদ্ধে আন্দোলন হচ্ছে৷ ঠিক একই সময়ে বৈষম্যমূলক নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের বিরুদ্ধে জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলন লক্ষণীয় উচ্চতায় পৌঁছেছে৷ এই আন্দোলন দমনে বিজেপি সরকারের বর্বর আক্রমণ সারা দেশে নিন্দা কুড়িয়েছে৷ মানুষকে আরও বেশি আন্দোলন মুখর করেছে৷ জে এন ইউতে রাতে আলো নিভিয়ে দিয়ে বিজেপি সরকারের পুলিশ এবং আরএসএস–এবিভিপি দুষ্কৃতীদের ফ্যাসিস্ট আক্রমণের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক স্তর পর্যন্ত নিন্দা–ঘৃণা–সমালোচনার ঝড় উঠেছে৷
কিন্তু হঠাৎ ছাত্রসমাজ সরকার–বিরোধী জেহাদ ঘোষণা করেছে কেন? এই আন্দোলন আকস্মিকভাবে ফেটে পড়লেও বাস্তবে বিক্ষোভটা জমেছে দীর্ঘদিন ধরেই৷ এর মধ্যে ফি–বৃদ্ধি এবং সিএএ প্রত্যক্ষ ভূমিকা নিলেও কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের একের পর এক জনবিরোধী নীতি, বিশেষ করে শিক্ষায় গৈরিকীকরণ, ইতিহাস বিকৃতি, বৈজ্ঞানিক ধ্যান ধারণাকে কুসংস্কার বা অন্ধবিশ্বাসের দ্বারা নস্যাৎ করা ইত্যাদি ছাত্র সমাজকে ক্রমাগত ভাবিয়ে তুলেছিল যে, বর্তমান সরকারের হাতে দেশের সমাজের ভবিষ্যৎ বিপন্ন৷ ফলে ক্ষোভের আগুন ধিকিধিকি করে জ্বলছিলই৷ ফি বৃদ্ধি এই আগুনে হাওয়া দিয়েছে৷
ওয়ার্ল্ড ইনইকুয়ালিটি ডেটাবেসের তথ্য বলছে, ভারতে অর্ধেক ছাত্রছাত্রীই ‘ড্রপআউট’ হন অর্থনৈতিক সমস্যার জন্য৷ ছাত্রদের পারিবারিক অর্থনৈতিক অবস্থা তুলে ধরে তথ্য দেখিয়েছে, ৯০ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক ভারতীয়ের মাসে উপার্জন ১২ হাজার টাকার কম৷ এর মধ্যে ৫০ শতাংশেরই মাসিক উপার্জন ৫ হাজার টাকার কম৷ স্বাভাবিকভাবেই এই সব পরিবারের ছেলেমেয়েরা পারিবারিক উপার্জনের ভিত্তিতে ব্যয়বহুল উচ্চশিক্ষা বা প্রযুক্তিগত শিক্ষায় যেতে পারে না৷
এ রাজ্যের মানুষের বাস্তব অভিজ্ঞতা, মাধ্যমিক স্তরেই একজন ছাত্রকে প্রাইভেট কোচিং–এর জন্য বছরে ন্যূনতম ৩০–৪০ হাজার টাকা ব্যয় করতে হয়৷ উচ্চতর শিক্ষার ক্ষেত্রে এই ব্যয় আরও বেশি৷ ফলে শিক্ষা ঋণ ছাড়া বেশিরভাগ ছাত্রছাত্রী এখন উচ্চশিক্ষায় যেতে পারে না৷ তা ছাড়া এত বিপুল খরচ করে শিক্ষার পর চাকরি হবে কি না, তার কোনও নিশ্চয়তা নেই৷ এই প্রেক্ষাপটে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে বিক্ষোভ জন্ম নেওয়া খুবই স্বাভাবিক৷
জে এন ইউতে ফি–বৃদ্ধি নিয়ে কর্তৃপক্ষের অনড় অবস্থানই ছাত্র আন্দোলনকে দীর্ঘায়িত করে চলেছে৷ কর্তৃপক্ষের অনড় অবস্থানের পিছনে রয়েছে কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের ভূমিকা৷ ১৯৮৬ সালে কংগ্রেসের রাজীব গান্ধীর সরকারের নেতৃত্বে গৃহীত জাতীয় শিক্ষানীতি শিক্ষাকে অনন্য লাভজনক ব্যবসা হিসাবে দেখার যে দৃষ্টিভঙ্গি এনেছিল, বর্তমান বিজেপি সরকার সেই পথ ধরেই হেঁটে শিক্ষাক্ষেত্র থেকে আরও বেশি করে মুনাফা লুটের বন্দোবস্ত করে দিচ্ছে৷ এদের দৃষ্টিতে ছাত্র হল ক্রেতা৷ আর শিক্ষা মানে বিক্রয়যোগ্য পণ্য৷ সরকার ছাত্রদের দেশের সম্পদ ভাবতে পারে না৷ তাদের দক্ষ করে তোলার জন্য অবৈতনিক শিক্ষা দেওয়ার কথা এদের ভাবনায় নেই৷ ছাত্ররা যে ক্রমাগত সরকার বিরোধী হয়ে উঠছে তার শিকড় এখানেই নিহিত৷
জে এন ইউ কর্তৃপক্ষ এবং কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী আন্দোলনকারী ছাত্রছাত্রীদের কথা শুনতেই চাইছেন না৷ তারা দেশবাসীর কাছে তুলে ধরছেন তাদের সমস্যার কথা৷ ৯ জানুয়ারি কলকাতার কলেজ স্কোয়ারে গবেষকদের ডাকা এক সভায় জেএনইউ–র ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড লেবার স্টাডিজের ছাত্রী কৃতী ভগত জানালেন, ‘‘আমার বাবার কোনও পাকা চাকরি নেই৷ জে এন ইউয়ে ফি খুব কম৷ তাই পড়াশোনা চালাতে পারছি৷ ফি বাড়লে আর পারব না’’(আনন্দবাজার পত্রিকা–১০.১.২০২০)৷
এই সমস্যা দেশের সিংহভাগ মানুষের৷ সরকার এই সমস্যা সমাধান না করলে আন্দোলন বারবার ফেটে পড়বেই৷