একের পর এক ভেঙে পড়ছে ব্রিজ৷ চাপা পড়ে মারা যাচ্ছেন, আহত হচ্ছেন অসংখ্য মানুষ৷ উল্টোডাঙা এবং বিবেকানন্দ উড়ালপুলের পর ভেঙে পড়ল মাঝেরহাট ব্রিজ৷ মারা গেলেন ৩ জন মানুষ, আহত হলেন অনেকে৷ বেহালা, মহেশতলা, বজবজ, আমতলা, ফলতা সহ দক্ষিণ ২৪ পরগণার বিস্তীর্ণ অঞ্চলের মানুষের সঙ্গে কলকাতার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ল৷ ফলে চরম দুর্ভোগে পড়তে হচ্ছে লক্ষ লক্ষ মানুষকে৷ ঘুরপথে যাতায়াত করতে গিয়ে অফিসযাত্রী, স্কুল–কলেজের পড়ুয়ারা, হাসপাতালের রোগী সহ নিত্যযাত্রীরা এক ঘন্টার পথ চার ঘন্টায় যাচ্ছেন৷অথচ দুর্ঘটনা, এই মৃত্যু, দুর্ভোগ অনিবার্য ছিল না৷
বিশেষজ্ঞরা বছর দুই আগে থেকেই মাঝেরহাট ব্রিজটির বেহাল অবস্থার কথা বলে আসছেন৷ বলেছেন, বারবার সাময়িক গর্ত বোজাতে গিয়ে বিটুমিনের পুরু আস্তরণে ব্রিজের ওজন বেড়ে গিয়েছিল৷ নিয়মিত নজরদারির অভাবে ৫৪ বছরের পুরনো ব্রিজটির কংক্রিটের গার্ডারগুলির স্থিতিস্থাপকতা নষ্ট হয়ে পড়েছিল৷ ভার বহনের ক্ষমতা কমে যাচ্ছিল৷ তৈরি হওয়ার সময় যান–চলাচলের যে সংখ্যা ধরা হয়েছিল, বর্তমানে তার বহু গুণ বেশি বাস, ট্যাক্সি, মালবাহী ট্রাক চলাচল করে৷ ধীরে ধীরে ক্ষয়রোগের শিকার হয় ব্রিজটি৷ এ সব কোনও কিছুই পূর্ত দপ্তরের দায়িত্বজ্ঞানহীন দুর্বল নজরদারিতে ধরা পড়েনি৷ এলাকার মানুষজন বারবার বলা সত্ত্বেও কোনও তৎপরতাও এই দপ্তরের দেখা যায়নি৷ অথচ দপ্তরের মন্ত্রী রয়েছেন, আমলা–ফিসাররা রয়েছেন, রয়েছেন বিশেষজ্ঞ ইঞ্জিনিয়াররা৷ দপ্তরের জন্য সরকারের বাজেটে প্রতি বছর শত শত কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়৷ এরপরও এসব দেখা হবে না কেন? কেন ভেঙে পড়বে একের পর এক ব্রিজ? তা হলে এইসব মন্ত্রী আমলা অফিসার ইঞ্জিনিয়ারদের কাজটা কী?
প্রশাসনের কর্তাব্যক্তি এবং মন্ত্রীরা দুর্ঘটনার পর যে তৎপরতার সাথে নানা বিবৃতি দিয়ে চলেছেন তার একাংশও ব্রিজের রক্ষণাবেক্ষণের ক্ষেত্রে দেখা যায়নি৷ মুখ্যমন্ত্রী নির্মীয়মাণ মেট্রো রেলের কর্তৃপক্ষের দিকে আঙুল তুলেছেন৷ দুর্ঘটনা এই নির্মাণের কারণে কি না, তা তদন্ত সাপেক্ষ৷ কিন্তু এই নির্মাণকাজ তো গোপনে হয়নি বা দুর্ঘটনার আগে হঠাৎ হয়নি৷ প্রশাসনের কর্তাব্যক্তি, মুখ্যমন্ত্রী সহ মন্ত্রীবর্গ, তাঁদের এই আঙুল এতদিন ওঠেনি কেন?
২০১৬–তে বিবেকানন্দ উড়ালপুল ভেঙে পড়ে ২৭ জনের মৃত্যুর পর সরকার রাজ্যের মানুষকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, কলকাতা সহ রাজ্যের সেতুগুলির অবস্থা দ্রুত পর্যবেক্ষণ করা হবে এবং সেই অনুযায়ী দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে৷ রাজ্যের মানুষ অভিজ্ঞতা থেকেই জানেন, মন্ত্রীদের প্রতিশ্রুতি ভুলতে বেশিক্ষণ লাগে না৷ ফলে কোনও ব্রিজের খবরই কেউ নেয়নি৷ যতক্ষণ না আবার একটি ব্রিজ ভেঙে পড়ছে এবং মানুষের প্রাণ যাচ্ছে, ততক্ষণ এগুলি আলোচ্য বিষয় হয় না৷ ফলে কেউ জানে না আবার কখন কোন ব্রিজ কাদের মাথায় ভেঙে পড়বে৷ অবশ্য ব্রিজের দুরবস্থার খোঁজ না নিলেও নিয়মিত তাতে নীল–সাদা রঙ করতে ভুল হয় না৷ তার কারণ কি এই যে তাতে নিয়মিত কাটমানির বখরা চলে আসে?
তা হলে এই যে মুখ্যমন্ত্রী প্রতিটি সভাতে বলেন, উন্নয়নের সব কাজ তাঁদের সব সময় নির্দিষ্ট সময়ের অনেক আগেই সম্পন্ন হয়ে যায়, সর্বত্র সেই উন্নয়নের বহর কি এমন ধরনেরই? তবে এমন উন্নয়ন থেকে রাজ্যের মানুষের সাবধান থাকাই বোধহয় মঙ্গল– অন্তত চাপা পড়ার হাত থেকে রেহাই পাবেন৷
(৭১ বর্ষ ৭ সংখ্যা ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৮)