রাজ্য সরকার অষ্টম শ্রেণির নিচের ছাত্রছাত্রীদের জন্য ‘পাড়ায় শিক্ষালয়’ প্রকল্প ঘোষণা করেছে। একে কেউ বলছেন ‘হাস্যকর’, কেউ বলছেন ‘প্রহসন’, কেউ বলছেন ‘দুয়ারে সরকারের মতো চটকদারি’। অল বেঙ্গল সেভ এডুকেশন কমিটি এর মধ্যে বড় বিপদের আশঙ্কা করছে।
‘পাড়ায় শিক্ষালয়’ প্রকল্প ঘোষণা করে শিক্ষামন্ত্রী বলেছিলেন, রাজ্যে ৫০ হাজারের বেশি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ১৫ হাজার ৫৯৯টি শিশু শিক্ষাকেন্দ্র, ১ লক্ষ ৮৪ হাজার প্রাথমিক শিক্ষক, ২১ হাজার প্যারাটিচার, ৩৮ হাজার সহায়ক-সহায়িকা রয়েছে। যদি সত্যিই এই পরিকাঠামো থেকে থাকে তা হলে তাকে বসিয়ে রেখে খোলা মাঠে শিক্ষার কথা বলছেন কেন?
বৃষ্টি হলে, রোদ চড়া হলে, ঝড় এলে কোথায় যাবে ছাত্ররা? খোলা পরিবেশে ছাত্রছাত্রীরা মনঃসংযোগই বা করবে কী করে? ক্লাস করাতে চাইলে খোলা মাঠে ক্লাসের সব পরিকাঠামো নতুন করে আনতে হবে। এর জন্য বিপুল খরচ হবে। স্কুল বন্ধ রেখে এই প্রহসনের প্রয়োজন কী?
আরও গুরুতর প্রশ্ন হল, প্রাক প্রাথমিক (পিপি) থেকে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত ক্লাসের কী হবে? এটাই তো ভিত্তি নির্মাণের অন্যতম স্তর। সরকার সংক্রমণের দোহাই দিয়ে ক্লাস বন্ধ রেখে শিক্ষার ভিত্তি ধসিয়ে দিচ্ছে। উদ্দেশ্য– সরকারি শিক্ষা ব্যবস্থাকে দুর্বল করে বেসরকারি অনলাইন শিক্ষা ব্যবসার বিরাট বাজার তৈরি করে দেওয়া। জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০ এবং এবারের কেন্দ্রীয় শিক্ষা বাজেটে এই অনলাইন শিক্ষার উপরই জোর দেওয়া হয়েছে।
অল বেঙ্গল সেভ এডুকেশন কমিটির রাজ্য সম্পাদক অধ্যাপক তরুণকান্তি নস্করের মতে ‘পাড়ায় শিক্ষা’র মধ্যে কেন্দ্রীয় সরকারের জনবিরোধী শিক্ষানীতিরই কৌশলী প্রয়োগ রয়েছে। তিনি বলেন, মোদি সরকার স্কুলে নিয়মিত শিক্ষকের সংখ্যা কমানোর উপর জোর দিচ্ছে। জাতীয় শিক্ষানীতির ২.৭ অনুচ্ছেদে পরিষ্কার করেই বলেছে, ‘‘…এলাকার বা এলাকার বাইরের কোনও ব্যক্তি স্বেচ্ছায় এই মিশনকে সফল করার জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলে তা সাদরে গ্রহণ করা হবে। যদি প্রত্যেক শিক্ষিত ব্যক্তি অন্তত একজন ছাত্র বা ছাত্রীর দায়িত্ব নেন, তবে দেশের বর্তমান পরিস্থিতি খুব তাড়াতাড়ি পাল্টে যাবে। …প্রতিটি রাজ্য ‘পিয়ার লার্নিং’ এবং স্বেচ্ছাসেবকদের দ্বারা ছাত্রছাত্রীদের পাঠদানের ক্ষেত্রে নতুন পদ্ধতি উদ্ভাবন করার কথা ভাবতে পারে।” শ্রেণিকক্ষ বন্ধ রেখে স্বেচ্ছাসেবকদের সাহায্যে সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত ‘পাড়ায় শিক্ষালয়’ চালুর ঘোষণা মোদি সরকারের শিক্ষক ছাড়া শিক্ষা চালানোর দুরভিসন্ধিরই নজির।
শিক্ষকদের বাদ দিয়ে স্বেচ্ছাসেবকদের দ্বারা শিক্ষা পরিচালনার যে কথা মোদি সরকার জাতীয় শিক্ষানীতিতে বলেছে, তার মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে শিক্ষক নিয়োগ না করার বিপদ। অনলাইন শিক্ষার উপর যে জোর দেওয়া হয়েছে তাতেও পরিষ্কার, ভবিষ্যতে শিক্ষকের বিশেষ প্রয়োজন থাকবে না। অথচ শিক্ষক ছাড়া যে শিক্ষা হয় না, তা বোঝা যায় রবীন্দ্রনাথের একটি উক্তির দিকে তাকালেই। তিনি লিখেছেন, ‘‘ঘুরিয়া ফিরিয়া যেমন করিয়া চলি না কেন শেষকালে এই অলঙ্ঘ্য সত্যে আসিয়া ঠেকিতেই হয় যে, শিক্ষকের দ্বারাই শিক্ষা বিধান হয়, প্রণালীর দ্বারা হয় না” (পথের সঞ্চয়, শিক্ষাবিধি)
শিক্ষা আজ সঙ্কটে। করোনার সুযোগ নিয়ে শিক্ষা ব্যবসার প্রসার ঘটাতে পুঁজিপতিদের সেবাদাস সরকার উঠে পড়ে লেগেছে। এদের দৌলতে শিক্ষা আজ মুনাফার পণ্য। সরকারি শিক্ষা রুগ্ন হলে এদের ব্যবসার বাজার খুলে যাবে। তখন শিক্ষা কিনতে হবে উচ্চমূল্যে। ধনীরা তা কিনতে পারবে। সাধারণ মানুষের সে সামর্থ্য কোথায়? শিক্ষা থেকে সাধারণ মানুষকে বঞ্চিত করার এই ষড়যন্ত্র আটকাতে হলে পাড়া থেকেই প্রতিবাদ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। পাড়ায় পাড়ায় গড়ে তুলতে হবে অভিভাবকদের কমিটি।