‘‘…নিন্দুক লক্ষ্মীছাড়া রটাইল ‘পাখি মরিয়াছে’৷ রাজা কহিলেন ‘ভাগিনা, এ কী কথা শুনি’ ভাগিনা বলিল, ‘মহারাজ পাখিটার শিক্ষা পুরা হইয়াছে’৷’’
রবীন্দ্রনাথের ‘তোতা কাহিনী’ সবারই পড়া৷ পশ্চিমবঙ্গ সরকারের নেতা–মন্ত্রীদের অবস্থাটা ওই রাজার মতো৷ তাঁরা এতদিন ভাগিনাদের মাধ্যমেই শিক্ষার খোঁজ নিতেন৷ ভাগিনারা মন্ত্রীদের কানে সব সময় শোনাতেন, দারুণ শিক্ষা হচ্ছে৷ এখন পরিদর্শকরা গিয়ে দেখলেন রাজ্য জুড়ে ছাত্রদের অবস্থা ওই মৃত পাখির মতোই৷
ইসলামপুরের দাড়িভিটে একটি স্কুলে শিক্ষক নিয়োগের দাবিতে আন্দোলনকে কেন্দ্র করে দু’জন ছাত্রের মর্মান্তিক মৃত্যুর পর পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষামন্ত্রীর হঠাৎই বোধোদয় হয় এবং ছাত্রছাত্রীরা কেমন পড়াশোনা করছে তা দেখার জন্য তিনি স্কুলে স্কুলে পরিদর্শক দল পাঠান৷ পরিদর্শকরা স্কুলে স্কুলে ঘুরে যে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছেন তাতে তাঁদের চক্ষু চড়কগাছ৷
মন্ত্রীর গালভরা প্রতিশ্রুতি আছে, সাইকেল আছে, কন্যাশ্রী আছে, মিড ডে মিল আছে, অনেক কিছুই আছে৷ কিন্তু যে জন্য এত কিছু– সেই ‘শিক্ষা’টাই নেই৷ ছাত্রছাত্রীরা যে কিছু শিখছে না, তা স্কুল পরিদর্শকদের রিপোর্টেই বেরিয়ে এসেছে৷ বৃত্তের সংজ্ঞা জানতে চাওয়ায় এক ছাত্রী বলে, ‘বৃত্ত হল গোল গোল জিনিস৷ এটুকুই জানি৷’ আহ্ণিক ও বার্ষিক গতি সম্বন্ধে প্রশ্নের উত্তর দেয় এক ছাত্র, আগেরটা বইয়ে আছে বলে মনে পড়ছে না৷ কিন্তু বার্ষিক গতিটা খুব চেনা৷ পরিদর্শকদের রিপোর্টে স্কুলগুলি আলাদা হলেও উত্তরের মান একই রকম৷ দেখা গেছে, ক্লাসে যে বিষয়টি পড়ানো হচ্ছে তার সম্পর্কে কোনও ধারণাই ছাত্রদের নেই৷ অথচ তারা একাধিক গৃহশিক্ষকের কাছেও পড়ে৷
সিপিএম সরকার প্রাথমিক স্তরে ইংরেজি ও পাশ–ফেল তুলে দিয়ে শিক্ষার যে সর্বনাশটা শুরু করেছিল, কেন্দ্রীয় সরকারকে সামনে রেখে তৃণমূল সরকারও ক্লাস এইট পর্যন্ত পাশ–ফেল তুলে দিয়ে সেই বৃত্তটা সম্পূর্ণ করেছে৷ ছাত্র অভিভাবক বুদ্ধিজীবী শিক্ষক সমাজ এবং এস ইউ সি আই (সি)–র দেশজোড়া আন্দোলনের চাপে সম্প্রতি কেন্দ্রীয় সরকার কিছুটা পিছিয়ে এসে মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে যে, পাশ–ফেল তুলে দিয়ে শিক্ষার মান অত্যন্ত নেমে গেছে৷ রাজ্য সরকার পাশ–ফেল চালু করার যৌক্তিকতা মানলেও চালু করতে টালবাহানা করে চলেছে৷ এর ফল হিসাবে প্রতিদিন যে শিক্ষার মান পড়তে পড়তে একেবারে তলানিতে এসে ঠেকেছে, তা আজ দিনের আলোর মতো পরিষ্কার৷ এরই কিছু কিছু নমুনা সংবাদপত্রের পাতায় মাঝে মাঝে উঠে আসে৷ বাস্তব অবস্থাটা আরও অনেক বেশি ভয়ানক৷ আশ্চর্যের ব্যাপার হল, কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের উপর–উপর কিছু বিষয়ে দ্বন্দ্ব থাকলেও জনসাধারণকে প্রকৃত শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করার বিষয়ে দুই সরকারের মিল চোখে পড়ার মতো মনে পড়ে যায় বিশ্বখ্যাত রুশ সাহিত্যিক টলস্টয়ের কথা – ‘শাসকের শক্তি নিহিত থাকে জনগণের অজ্ঞতার মধ্যে’৷
(৭১ বর্ষ ১১ সংখ্যা ১২ – ১৮ অক্টোবর, ২০১৮)