রাজ্যের চা শ্রমিকদের মজুরি পাঁচটা টাকা বাড়াতেও রাজি হয়নি যে মালিকরা, তারাই চায়ের ব্যবসা করে প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা মুনাফা লোটে৷ যাদের রক্ত–ঘামের বিনিময়ে চা উৎপন্ন হয় সেই শ্রমিকদের দাবি, বর্তমান মজুরি ১৫৯ টাকা থেকে বাড়িয়ে ন্যূনতম মজুরি করা হোক দৈনিক ২৩৯ টাকা৷ বহু আন্দোলন, ধর্মঘটের পর মালিকপক্ষ জানাল মজুরি বাড়বে ৩ টাকা, যা এক কাপ চায়ের দামের চেয়েও কম৷ এই অপমানের প্রতিবাদে চা শ্রমিক সংগঠনগুলির যৌথ মঞ্চ আবার ধর্মঘটের ডাক দিল৷ আন্দোলনের চাপে দুই কিস্তিতে মাত্র ১৭ টাকা মজুরি বৃদ্ধির কথা ঘোষণা করেন শ্রমমন্ত্রী৷ এই বর্ধিত মজুরি যোগ করলে ন্যূনতম মজুরি দাঁড়ায় দৈনিক ১৭৬ টাকা৷ চূড়ান্ত মূল্যবৃদ্ধির বাজারে এই টাকা দিয়ে একটা শ্রমিক পরিবারের ভরণপোষণ চলে? তা হলে চা বলয়ে অনাহারে মৃত্যু, নারী পাচার অবধারিত হবে না কেন?
চা শিল্পে নিযুক্ত সাড়ে ৪ লক্ষ শ্রমিকের নিদারুণ বঞ্চনার ইতিহাস নতুন নয়৷ রাজ্যে শাসক বদলালেও বঞ্চনার ধারাবাহিকতা অব্যাহত৷ গত ১৭ জুলাই উত্তরকন্যায় অনুষ্ঠিত ত্রিপাক্ষিক বৈঠকে রাজ্যের লেবার কমিশনার জানান, চা শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি কী হবে তা ৩০ জুলাই শ্রমমন্ত্রী ঘোষণা করবেন৷ লেবার কমিশনার শ্রমিকদের পক্ষ থেকে পেশ করা দাবি বিবেচনার প্রতিশ্রুতিও দেন এবং এই অনুযায়ী ২৩–২৫ জুলাই প্রস্তাবিত ধর্মঘট প্রত্যাহূত হয়৷ শ্রমিক সংগঠনগুলির যৌথ মঞ্চের পক্ষ থেকে ৩০ জুলাই শ্রমমন্ত্রীর ঘোষণা পর্যন্ত আন্দোলন স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত হয়৷ সেদিন শ্রমমন্ত্রী ঘোষণা করেন, শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ৩ টাকা বৃদ্ধি করা হবে৷ ভিক্ষার সামিল এই মজুরি বৃদ্ধির ঘোষণায় চা শ্রমিকরা ক্ষোভে ফেটে পড়েন৷ প্রতিজ্ঞা নেন তীব্র ও শক্তিশালী আন্দোলন গড়ে তোলার৷ তার পরিপ্রেক্ষিতেই আবারও তিনদিনের ধর্মঘট সর্বাত্মক সফল হয়৷
মজুরি বৃদ্ধির দাবি শুধু ন্যায়সঙ্গতই নয়, আইনসঙ্গতও৷ ১৯৪৮ সালের ন্যূনতম মজুরি আইনকে ভিত্তি করে ১৯৫৭ সালে ইন্ডিয়ান লেবার কনফারেন্সে ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণের পদ্ধতিটি ঠিক হয়৷ সেই সম্পর্কে গণদাবীর ৩–৯ আগস্ট সংখ্যায় আমরা বিস্তারিত আলোচনা করে দেখিয়েছি৷ কিন্তু মালিকরা ন্যূনতম মজুরি আইনের কোনও তোয়াক্কাই করছে না৷ ফলে খাদ্যের অভাবে, অপুষ্টিতে, অর্ধাহারে, অনাহারে শত শত চা শ্রমিকের মৃত্যু ঘটছে৷ পূর্বতন সরকারের মতো এ সরকারও রাজ্যে অনাহারে মৃত্যু দেখতে পায় না৷ কিছুদিন আগে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী উত্তরবঙ্গে চা শিল্পের উন্নয়নের জন্য সরকারি বরাদ্দের কথা ঘোষণা করেছিলেন৷ কিন্তু এই টাকা ওখানে পৌঁছাল কিনা বা কোথায় কীভাবে খরচ হচ্ছে তার কোনও ঠিক–ঠিকানা নেই৷
একদিন দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে লক্ষ লক্ষ মানুষকে তাদের ভিটে–মাটি থেকে উৎখাত করে চা শিল্পে নিযুক্ত করা হয়েছিল৷ চা শিল্প ‘এনক্লেভ ইন্ডাস্ট্রিজ’ হিসাবে গড়ে উঠেছিল৷ এই ধরনের শিল্পের শ্রমিকের সামনে বিকল্প কোনও কাজের সুযোগ থাকে না৷ শ্রমিকের সমস্ত সত্তা যুক্ত থাকে ওই শিল্পের সাথে৷ তাহলে দেশের অন্যতম বৃহৎ এই শিল্পের শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ২৩৯ টাকা দাবি করাটা কি অন্যায়? শ্রমিকদের স্বার্থের কথা বিন্দুমাত্র ভাবলে তৃণমূল সরকারের যেখানে উচিত ছিল এই দাবি মেনে নেওয়া এবং মালিকদের তা মানতে বাধ্য করা, তা না করে তারা ন্যূনতম মজুরি নিয়ে টালবাহানা শুরু করেছে৷ সরকার ঘোষণা করেছে, ২০ আগস্ট কলকাতায় মিনিমাম ওয়েজ অ্যাডভাইসরি কমিটির বৈঠকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে৷ তার আগে শ্রমমন্ত্রী মলয় ঘটক চুপিসারে মালিকপক্ষ ও শাসকদলের তাঁবেদার তৃণমূল প্রভাবিত শ্রমিক সংগঠনকে নিয়ে একটি বৈঠক করেন যেখানে চা শ্রমিকদের আন্দোলনের মূল শক্তি ‘জয়েন্ট ফোরামকে’ ডাকা হয়নি৷ এই সংগঠনকে সম্পূর্ণ অন্ধকারে রেখে একতরফাভাবে মালিকদের স্বার্থকে রক্ষা করে শ্রমিকদের স্বার্থের পরিপন্থী অন্তর্বর্তী মজুরি বৃদ্ধির কথা এই বৈঠকে ঘোষণা করা হয়েছে৷ সেপ্টেম্বরে ১০ টাকা ও অক্টোবরে আরও ৭ টাকা দৈনিক মজুরি বৃদ্ধির ঘোষণার মধ্য দিয়ে অক্টোবর মাস থেকে শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি হবে ১৭৬ টাকা৷ এই সামান্য টাকায় চা শ্রমিকদের জীবন মানের কী সুরাহা হবে?
একসময়ে চা শিল্পে নিযুক্ত শ্রমিকদের জন্য রেশন দেওয়া হত৷ ছিল শিশুদের জন্য বিদ্যালয় ও চিকিৎসার ব্যবস্থা৷ সকলকে ২ টাকা কেজি দরে চাল দেওয়ার ঘোষণার মধ্য দিয়ে ইতিমধ্যেই মালিকরা রেশন ব্যবস্থা তুলে দিয়েছে৷ বিদ্যালয় ও হাসপাতালও অবলুপ্ত৷ এই অবস্থায় ৩ টাকা, ৭ টাকা এবং ১০ টাকা মজুরি বৃদ্ধির মধ্য দিয়ে চা শ্রমিকদের ন্যূনতম খেয়ে পরে বেঁচে থাকা, এদের চিকিৎসা ও ছেলেমেয়েদের শিক্ষার সুযোগ কতটুকু বাড়ানো যাবে?
একথা ঠিক, সরকার ও মালিক পক্ষ তাদের আগের অবস্থান থেকে সরে আসতে বাধ্য হচ্ছে লাগাতার আন্দোলনের চাপেই৷ এটা আন্দোলনের এক ধাপ সাফল্য৷ তারা বাধ্য হয়েছে কিছুটা হলেও মজুরি বৃদ্ধির কথা ঘোষণা করতে৷ এখানেই আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা৷
বর্তমান মালিকি ব্যবস্থায় চা শ্রমিকদের প্রতি সরকার এই উদাসীনতা দেখাবেই৷ মালিকরা সর্বোচ্চ মুনাফার স্বার্থে বারে বারে শ্রমিকদের ন্যায়সঙ্গত ও আইনসঙ্গত অধিকার খর্ব করবে এবং এই প্রশ্নে সরকারি আইনকে লঙঘন করতেও তারা পিছপা হবে না৷ সরকারও করবে মালিকি স্বার্থরক্ষার নজরদারি৷ এই অবস্থায় শুধু ন্যূনতম মজুরিই নয়, সংগঠিত শিল্পের শ্রমিকদের মর্যাদা পাওয়া, বন্ধ চা বাগান চালু করা, প্ল্যান্টেশন লেবার অ্যাক্ট অনুযায়ী সমস্ত প্রাপ্য সুনিশ্চিত করা, শ্রম আইন লঙঘনের জন্য মালিকদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া, প্রভিডেন্ট ফান্ড ও গ্র্যাচুইটি নিয়ে দুর্নীতি বন্ধ করা, পরচা–পাট্টা নিয়ে ধোঁকাবাজি এবং আট ঘন্টা কাজ করা সত্ত্বেও ‘ঠিকা’ সম্পূর্ণ না করার অজুহাতে হাজিরা কেটে নেওয়া– এসব বন্ধের দাবিতে এই আন্দোলনকে আরও দীর্ঘস্থায়ী রূপ দিতে হবে৷
কয়েক বছর আগে সিপিএম–সরকারের আমলে চা শ্রমিকদের ওপর চরম মালিকি জুলুমের প্রতিবাদ জানিয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন দার্জিলিঙের একটি চা–বাগানের শ্রমিক বাবুরাম দেওয়ান৷ শিউরে উঠেছিল গোটা রাজ্যের মানুষ৷ ইতিমধ্যে রাজ্যে সরকার পাল্টেছে৷ কিন্তু এতটুকুও বদলায়নি চা শ্রমিকদের দুর্বিষহ জীবন৷ সরকারের মদতে মালিকি বঞ্চনা দিনে দিনে আরও বেড়েছে৷ সঠিক নেতৃত্বে সংগঠিত ও লাগাতার আন্দোলনই এই অসহনীয় পরিস্থিতি থেকে রেহাই পাওয়ার একমাত্র রাস্তা৷
(৭১ বর্ষ ৪ সংখ্যা ২৪ আগস্ট, ২০১৮)