নিরুপমাকে মনে পড়ে? রবীন্দ্রনাথের ‘দেনা-পাওনা’ গল্পের নিরুপমা, যার বাবা রায়বাহাদুরের ঘরে মেয়েকে পাত্রস্থ করেছিলেন, কিন্তু পণের দশ হাজার টাকার সবটা জোগাড় করে উঠতে পারেননি। প্রায় ভাঙতে ভাঙতেও সে বিয়েটা কোনওমতে হয়ে যায়, কিন্তু শ্বশুরবাড়িতে প্রতিনিয়ত অপমান-অসম্মান সহ্য করে নিরুপমাকে পড়ে থাকতে হয় একটা মূল্যহীন বস্তুর মতো। আর একটি দিনও নিজের বাড়ি যাওয়ার অনুমতি পায়নি সে। দুঃখে যন্ত্রণায় নিজের শরীরের প্রতি অবহেলা করে একরকম আত্মহত্যার পথই বেছে নিয়েছিল নিরুপমা, এ দেশের হাজার হাজার মেয়ের মতোই। তার মৃত্যুর পরেই আর একটি সম্বন্ধ স্থির করে প্রবাসী ছেলেকে চিঠি লেখেন বাবা-মা। গল্পের শেষ লাইনটা ছিল চাবুকের মতো, ‘এবারে বিশ হাজার টাকা পণ এবং হাতে হাতে আদায়’।
রবীন্দ্রনাথ ‘দেনা-পাওনা’ লিখেছিলেন ১৮৯১ সালে। এটা ২০২২ সাল। দিন দশেক আগে সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। বিয়ে করতে আসা বর বলছেন, ‘পণ কেন নেব না? এতে ভুল কোথায়?’ হবু স্ত্রী’র পাশে বসে তিনি জানাচ্ছেন, চাহিদামতো সব টাকা পেলে তবেই তিনি বিয়ে করবেন, নয়তো ফিরে যাবেন। বধূবেশে সজ্জিত মেয়েটি খানিকটা অনুরোধের সুরে বলছে, তার বাবা বকেয়া টাকা পরে দিয়ে দেবেন। কিন্তু পাত্রের হাবভাবে মনে হচ্ছে না এ কথায় চিঁড়ে ভিজবে।
আন্তর্জাতিক নারী দিবসের ঠিক পরের দিন একটি বহুল প্রচারিত বাংলা দৈনিকের ভেতরের পাতার এক কোনায় এই খবরটি বেরিয়েছে। তার ঠিক নিচেই আছে আরেকটি খবর। নারী দিবসে রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী দেশের মহিলাদের উদ্দেশ্যে শুভেচ্ছাবার্তা জানিয়েছেন। রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রী কি এই ভিডিওটি দেখেছেন? সম্ভবত না। চব্বিশ ঘণ্টা দেশের মানুষের সেবায় ব্যস্ত থাকতে হয় যাঁদের, ধরে নেওয়া যায় এমন একটি সামান্য ভিডিও তাঁদের নজরে আসবে না। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী এবং রাষ্ট্রপতি নিচয়ই জানেন, স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরেও পণপ্রথা আজও ভারতবর্ষের একটি ভয়ঙ্কর সামাজিক ব্যাধি। পণ দিতে গিয়ে বহু সংসার আজও আর্থিক ভাবে পঙ্গু হয়ে যায়, প্রতিশ্রুতি মতো পণ মেলেনি বলে পাত্র বিয়ের আসর থেকে উঠে যায়। পণ আদায়ের জন্য শ্বশুরবাড়িতে সদ্য বিবাহিত মেয়ের় ওপর চলে নানারকম অত্যাচার। সংবাদপত্রে চোখ রাখলে বোঝা যায়, কটু কথা, অপমান, মানসিক নির্যাতন থেকে শুরু করে শারীরিক নিগ্রহ, বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া, এমনকি বধূহত্যার মতো মর্মান্তিক ঘটনা প্রায়শই ঘটে, যার মূলে আছে এই অন্যায় প্রথা। অথচ সব জেনেও কোনও দলের নেতা-মন্ত্রীকে এর বিরুদ্ধে কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে দেখা যায় না।
দেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতায় বসে স্লেগান তুলেছিলেন, ‘বেটি বাঁচাও বেটি পড়াও’। যদিও সম্প্রতি সংবাদে প্রকাশ পেয়েছে এই প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ বিপুল পরিমাণ অর্থের সিংহভাগই খরচ হয়েছে বিজ্ঞাপনী প্রচারে। পণপ্রথার অত্যাচার থেকে বেটিদের বাঁচানো এই প্রকল্পের আওতায় ছিল কিনা, তা সরকারি কর্তারাই ভালো বলতে পারবেন। তবে চারপাশে চোখ মেলে তাকালে বোঝা যায়, কেন্দ্রের ‘বেটি বাঁচাও বেটি পড়াও’ হোক বা রাজ্যের কন্যাশ্রী-রূপশ্রী মেয়েদের জীবনের প্রকৃত সমস্যায় আঁচড় কাটতে পারেনি। সত্যিই কী নেতা-মন্ত্রীরা পণপ্রথার অবসান চান? ভিডিওটিতে ওই যুবক বলেছেন, কে বলল পণপ্রথা নেই? সবাই জানে পণপ্রথা আছে। কথাটা মিথ্যে নয়। পণপ্রথা বিরোধী আইন থাকা সত্ত্বেও পণপ্রথা যে আছে এবং রমরমিয়ে চলছে এ তো সবাই জানে। সরকার জানে, পুলিশ জানে, মন্ত্রী-আমলা-পঞ্চায়েত সদস্য সকলেই জানেন। সবাই জানা সত্ত্বেও এরকম ঘৃণ্য প্রথা দিনের পর দিন চলছে কী করে?
কেন্দ্র-রাজ্য সব সরকারেরই নারীকল্যাণ, সমাজকল্যাণ দপ্তর রয়েছে, তার নানা স্তরের মন্ত্রীরা রয়েছেন, ডজন ডজন আমলা-অফিসার-কর্মচারী রয়েছেন, তাঁদের পিছনে শত শত কোটি টাকা প্রতি বাজেটে বরাদ্দ হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে তাঁদের ভূমিকা কী? কেন পণপ্রথা বিরোধী আইন কার্যকর করা হয় না? কেন নিষ্ঠুর এই প্রথার বিরুদ্ধে লাগাতার প্রচার চালানো হয় না? কেন এটিকে একটি সামাজিক আন্দোলনের রূপ দেওয়া হয় না?
নবজাগরণের মনীষীরা ও স্বাধীনতা সংগ্রামীরা চেয়েছিলেন নারীরা স্বাধীন দেশে মর্যাদাময় জীবন পাবে। রামমোহন, বিদ্যাসাগর, বেগম রোকেয়া, জ্যোতিবারাও ফুলের মতো মানুষরা আন্দোলন গড়ে তুলে নারীদের জন্য বেশ কিছু দাবি আদায় করেছিলেন। তাঁদের অপূরিত স্বপ্ন পূরণ করার দায়িত্ব তো ছিল স্বাধীন দেশের সরকারের। ৭৫ বছরেও তা পূরণ হল না কেন? এক নারী দীর্ঘ সময় ধরে দেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, রাজ্যে রাজ্যে কত মহিলা মুখ্যমন্ত্রী হলেন, কিন্তু নারীত্বের তথা মানবতার চরম অপমান পণপ্রথা বন্ধ হল না কেন? আজও তো কত মহিলা বিধায়ক, সাংসদ, মন্ত্রী হয়ে রয়েছেন, তাঁরা এই প্রথা অবিলম্বে বন্ধের দাবিতে বিধানসভায়, লোকসভায় ঝড় তোলেন না কেন?
সরকারে যারাই থাকুক, নারীদের জীবনের অবহেলা-অত্যাচারের ছবিটা কমবেশি একই থেকে যায়। ১৯৬১-তে পণপ্রথা বিরোধী আইন হয়েছে। ২০২০-তে পণের নথিভুক্ত অভিযোগ ১০৩৬৬টি এবং এই কারণে মৃত্যুর সংখ্যা ৬৯৬৬। ‘লিঙ্গ বৈষম্যের’ তালিকায় ১৫৬টি দেশের মধ্যে ভারত ১৪০তম। অবশ্য হবে নাই বা কেন ? দেশের যারা পরিচালক, লোকসভার সেই ৫৪৩ জন সদস্যের মধ্যে ২৩৩ জনের বিরুদ্ধে নানা অপরাধমূলক কাজের অভিযোগ আছে এবং অনেকগুলোই ধর্ষণ বা নারী নির্যাতনের অভিযোগ। প্রধানমন্ত্রী যতই ‘বেটি বাঁচাও’ স্লেগান দিন, তাঁর দলের নেতাকর্মীরাই তো কাঠুয়ায় ধর্ষকদের সমর্থনে মিছিল করেছে, উন্নাও, হাথরসে নির্যাতিতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে, বারবার নির্যাতিতার পরিবারের ওপর আক্রমণ করেছে, প্রমাণ লোপাটের চেষ্টা করেছে। বিজেপি-আরএসএস এর বিভিন্ন নেতা-মন্ত্রীরা নারীদের সম্পর্কে যা মন্তব্য করেছেন বা করছেন, তাতেই বোঝা যায় তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গি এবং মানসিকতা অন্ধকারাচ্ছন্ন সামন্ততান্ত্রিক যুগেরই। অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলিও মুখে যতই নারী প্রগতির কথা বলুক, বাস্তবে নারীদের প্রতি সমাজ মানসিকতা পরিবর্তনের জন্য, মর্যাদা ও সমানাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য যে সামাজিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তোলার প্রয়োজন ছিল তার কিছুই করেনি। তাই আজও সমাজে পণের দাবিতে বধূ হত্যা, কন্যাভ্রূণ হত্যা, বাল্যবিবাহ, নারী-শিশু পাচার, কর্মস্থলে যৌন হয়রানি, ধর্ষণ, গণধর্ষণ, হত্যার মতো জঘন্য অপরাধমূলক ঘটনার প্রবাহ বন্ধ হয়নি, বরং বেড়ে চলেছে।
আসলে সমাজ মানসিকতায় গেড়ে বসা পুরুষতন্ত্রকে সমূলে উচ্ছেদ করতে হলে পুঁজিবাদী সমাজকাঠামোকে অক্ষুণ্ন রেখে তা কখনই সম্ভব নয়। একটি সামাজিক কুপ্রথার মূলে গিয়ে জোরালো আন্দোলন শুরু করতে গেলে তা আরও অনেকগুলো অন্যায়ের গোড়া ধরে নাড়া দেবে এবং শেষপর্যন্ত এই পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার বিপক্ষে জনমত তৈরি করবে। যেমন, পণপ্রথা নির্মূল করতে যথাযথ আইনি পদক্ষেপ এবং সামাজিক আন্দোলন যদি করতে হয়, তাহলে একদিকে বহু তথাকথিত প্রভাবশালী লোকজনের শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে, অন্যদিকে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে যথার্থ আধুনিক গণতান্ত্রিক চেতনা গড়ে তুলতে হবে। মানুষ তখন শুধু পণপ্রথাই নয়, নারীদেহের পণ্যায়ন, নারীর সার্বিক অবদমনের মতো জিনিসগুলোর বিপক্ষে সরব হবে, এর আসল কারণ খুঁজতে চাইবে। মানুষকে মদ-জুয়া-ফুর্তিতে মাতিয়ে রেখে তার ওপর লাগামছাড়া শোষণ চালিয়ে যাওয়া তখন সহজ হবে না। তাই পুঁজিপতিদের আশীর্বাদ নিয়ে ক্ষমতায় বসা কোনও দলই যথার্থ নারীমুক্তি চাইতে বা দিতে পারে না। আবার এই ব্যবস্থার মধ্যেও যদি রুখে দাঁড়াতে হয়, সেখানে মেয়েদের শিক্ষা এবং আত্মমর্যাদার প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ণ। রবীন্দ্রনাথের নিরুপমা তার বাবাকে বলেছিল, ‘টাকা যদি দাও তবেই অপমান। তোমার মেয়ের কি কোনও মর্যাদা নেই। আমি কি কেবল একটা টাকার থলি, যতক্ষণ টাকা আছে ততক্ষণ আমার দাম। না বাবা, এ টাকা দিয়ে তুমি আমার অপমান কোরো না’। এই মর্যাদাবোধ সঞ্চারিত করতেই ‘স্বদেশ ও সাহিত্য’ প্রবন্ধে শরৎচন্দ্র লিখেছিলেন, ‘‘আসল প্রতিকার মেয়ের বাপের হাতে, যে টাকা দেবে তার হাতে। অধিকাংশ কন্যাদায়গ্রস্তই আমার কথা বোঝে না, কিন্তু কেউ কেউ বোঝেন। তারা মুখখানি মলিন করে বলেন – সে কি করে হবে মশাই, সমাজ রয়েছে যে! সমস্ত মেয়ের বাপ যদি এ কথা বলেন তো আমিও বলতে পারি, ‘কিন্তু একা তো পারিনে’ কথাটা তার বিচক্ষণের মতো শুনতে হয় বটে, কিন্তু আসল গলদও এইখানে। কারণ, পৃথিবীতে কোনও সংস্কারই কখনও দল বেঁধে হয় না। একাকীই দাঁড়াতে হয়। এর দুঃখ আছে। কিন্তু এই স্বেচ্ছাকৃত একাকীত্বের দুঃখ একদিন সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে বহু-র কল্যাণকর হয়। মেয়েকে যে মানুষ বলে নেয়, কেবল মেয়ে বলে, দায় বলে, ভার বলে নেয় না, সে-ই কেবল এর দুঃখ বইতে পারে, অপরে পারে না”। যুগ পাল্টেছে নিচয়ই, মেয়েরাও অনেকাংশে অর্থনৈতিক ভাবে স্বাধীন সচেতন হয়েছেন, পণ নেওয়া বা দেওয়া অনুচিত এটাও তারা বোঝেন, কিন্তু সত্যের জন্য একা দাঁড়ানোর এই যে শিক্ষা বা জোর, এর থেকে আজও আমরা অনেক দূরে। যে স্বপ্ন নিয়ে নবজাগরণের যুগে নারীমুক্তির আন্দোলন শুরু হয়েছিল, তার সম্যক রূপ সম্পর্কে আজও বেশিরভাগ মানুষ সচেতন নন।
দীর্ঘদিনের পিতৃতান্ত্রিক মনন, মেনে চলা ও মানিয়েচলার অভ্যাস থেকে আজও নারীরা বেরিয়ে আসতে পারছে না। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সুযোগ মেয়েরা পেয়েছে অনেক দিন, বাইরের জগতের কাজও করছে অনেকেই। কিন্তু অভাব থেকে যাচ্ছে প্রকৃত শিক্ষার যা মর্যাদাবোধ জাগায়, দায়িত্ব কর্তব্যবোধ শেখায়, যথার্থ অর্থে মানুষ হতে শেখায়। গতানুগতিকতা থেকে বেরিয়ে মাথা উঁচু করে অন্যায়ের প্রতিবাদ করার বলিষ্ঠতা দেখাতে পারছেন কজন মহিলা? সামাজিক এই অবস্থার পরিবর্তনে মহিলা সংগঠনগুলির ভূমিকা অনস্বীকার্য। কিন্তু বেশির ভাগ মহিলা সংগঠনই নিয়মমাফিক কিছু কর্মসূচি পালন করেই দায়িত্ব শেষ করছে। অল ইন্ডিয়া মহিলা সাংস্কৃতিক সংগঠন যথার্থ চেতনা ও আত্মমর্যাদার ভিত্তিতে নারীদের সংগঠিত করে সামাজিক সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তোলার প্রচেষ্টা করে চলেছে সারা দেশ জুড়ে। উপযুক্ত শক্তি অর্জন করতে, তার সাথে সোচ্চার হয়ে দাঁড়াতে হবে সমস্ত শিক্ষক-অধ্যাপক-কর্মচারী সংগঠনগুলিকেও। ভুললে চলবে না, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে চালাতে হবে লড়াই। সমাজ অগ্রগতির পরিপূরক এই নারীমুক্তি আন্দোলনই পণপ্রথার মতো কুপ্রথার অবসান ঘটাতে পারে, দিতে পারে আলোর ঠিকানা।