সাম্প্রদায়িক আক্রমণে উত্তর-পূর্ব দিল্লি যখন জ্বলছে, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ঘর-বাড়ি দোকানপাটে অবাধে লুটতরাজের সংবাদ যখন ক্রমাগত আসছে, চলছে হত্যা তখন সেই অশান্তির মধ্যেও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির নজির আমরা দেখতে পেয়েছি দিল্লির মাটিতে।
ঘটনা ১
উত্তর-পূর্ব দিল্লির গোকুলপুরী। হিন্দু অধ্যুষিত এই এলাকায় বসবাসকারী মুসলিমদের বাড়িতে অজ্ঞাতপরিচয় দুষ্কৃতীরা হামলা চালাচ্ছে বলে খবর পান মহিন্দর সিং। সঙ্গে সঙ্গে ছেলে ইন্দ্রজিৎকে নিয়ে পৌঁছে যান সেখানে। তারপর ছেলের মোটরবাইক আর নিজের স্কুটিতে চড়ে ৮০ জন মুসলিম প্রতিবেশীকে এক এক করে কিছুটা দূরে মুসলিম অধ্যুষিত এলাকা কদরপুরের নিরাপদ আশ্রয়ে পৌঁছে দিয়ে আসেন। দিল্লিতে ১৯৮৮ সালের শিখ নিধন যজ্ঞ দেখা মহিন্দার সাংবাদিকদের বলেন, ‘‘হিন্দু, মুসলমান কিছুই চোখে পড়েনি। আমার চোখে শুধু ভাসছিল মানুষের মুখ।” এটাই আমাদের ভারত। এ ভারতে একজন সাধারণ মানুষ ধর্মের ভিত্তিতে মানুষের বিচার করেন না। এই ভারতের খবর নরেন্দ্র মোদী, অমিত শাহ, মোহন ভাগবতের মতো সাম্প্রদায়িক নেতারা রাখেন না।
ঘটনা ২
দিল্লির সংঘর্ষে আখ ব্যবসায়ী আহমেদের পিঠে গুলি লেগেছে। দ্রুত অপারেশন না করালে বিপদ। দরকার রক্ত। সেই রক্তের জন্য হন্যে হয়ে ঘুরছে আহমেদের প্রতিবেশী গোপাল। ‘‘আরে ভাই, গন্না বওসায়ি (আখ ব্যবসায়ী) আহমেদ কো গোলি লাগা হ্যায়, অপারেশন হোগা। খুন চাহিয়ে। কোই হ্যায়?” এগিয়ে এলেন রাজেশ। হিন্দু যুবক রাজেশের রক্তে প্রাণ ফিরে পেলেন মুসলমান আহমেদ।
ঘটনা ৩
সরকারি হাসপাতালে শুয়ে কাতরাচ্ছে মরণাপন্ন মানুষ। কারোর লেগেছে গুলি, কেউ বা ছুরি বা অস্ত্রের আঘাতে মারাত্মক আহত। এক কোণে শুয়ে ছুরিতে আহত বিহারের অনিল, জ্ঞান নেই। পাশে বসে দিল্লির গোকুলপুরের মুসলমান পড়শি আবেদ। তিনিই নিয়ে আসেন রক্তাক্ত অনিলকে। বলেন, ‘‘জানেন অনিল খুব ভাল ছেলে। ওর ছোট ছেলে-মেয়ে আছে। আল্লাহ! দোয়া করো, বাঁচালো ইস বন্দে কো।” তারপরই দু’চোখ বেয়ে অঝোর জলের ধারা। এটাই আমার ভারত, আমাদের ভারত।
ঘটনা ৪
হিংসাদীর্ণ দিল্লির মৌজপুরে তখন একই অবস্থা। উন্মত্ত জনতা বাড়ির মালিক রাম শর্মার কাছে জানতে চায় বাড়িতে কোনও মুসলমান আছে কিনা। বাড়ির সদর দরজা আগলে দাঁড়ান রাম, পাশে ছেলে চিনু। ‘আমার বাড়িতে কে থাকবে সেটা আমি ঠিক করব। বাড়িতে ঢুকতে গেলে আগে আমাদের মারতে হবে।’ বলে উঠলেন রাম। নিজেদের জীবন বাজি রেখে দিল্লির রাম আর তার ছেলে ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনি দেওয়া একদল উগ্র ধর্মান্ধকে রুখে দিয়ে প্রাণ বাঁচালেন বাংলার কেতুগ্রামের বাসিন্দা মনিরুল আর তাঁর পরিবারকে। এই হত্যালীলায় মুসলমানদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য আহত হয়েছেন এনডিটিভি-র পাঁচজন সাংবাদিক। দলিত হিন্দুরা রাত জেগে পাহারা দিয়েছে আক্রান্ত মুসলমান এলাকা। শিখ সম্প্রদায় তাদের প্রতিবেশী মুসলমানদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে খুলে দিয়েছেন গুরুদোয়ারার দরজা। প্রশাসন ও দিল্লি সরকার নিশ্চুপ থাকলেও সাধারণ দিল্লিবাসীরা মোমবাতি জ্বালিয়ে শান্তির আহ্বান জানিয়েছেন। কোথাও মসজিদে আগুন দিলে সেটা নেভাতে এগিয়ে এসেছেন হিন্দু প্রতিবেশীরা। কোথাও বা হিন্দু মন্দিরকে আগুন থেকে বাঁচাতে রুখে দাঁড়িয়েছেন মুসলমানরা।
আসলে হিন্দু হোক বা মুসলমান, সাধারণ মানুষ প্রকৃতপক্ষে অ-সাম্প্রদায়িক। তার মধ্যে সাম্প্রদায়িকতার বীজ বুনে দেয় ধুরন্ধর শয়তানরা। সাম্প্রতিককালে ‘বজরঙ্গি ভাইজান’ সিনেমায় আমরা দেখি ভারতে এসে হারিয়ে যাওয়া পাকিস্তানের এক মূক ও বধির ছোট্ট মুসলিম মেয়ে মুন্নিকে তার দেশে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য হনুমান ভক্ত, ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনি দেওয়া হিন্দু যুবক পবন চতুর্বেদীর মরণপণ প্রচেষ্টা। নিজের প্রাণ বাজি রেখে সে যখন ওই বাচ্চা মেয়েটিকে নিয়ে ঘুরপথে পাকিস্তানে পৌঁছায় তখন পাকিস্তানের প্রশাসন তাকে ভারতের চর মনে করে তার ওপর চালায় অকথ্য নির্যাতন।
কিন্তু পাকিস্তানের সাধারণ মুসলিম জনগণ যখন সত্যটা জানতে পারে তখন তারা সেই মানবদরদি হিন্দু যুবকের পাশে শুধু দাঁড়ায় তাই না, তাকে ভারতে নির্বিঘ্নে পৌঁছে দেওয়ার জন্য কাঁটাতারের বেড়া ভেঙে ফেলার উপক্রম করে। এটাই বাস্তব। সরকার এবং প্রশাসন না চাইলে সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ হতে পারে না। অবস্থা যখন এই তখন ভরসা তো মানুষের এই শুভবুদ্ধির উপরই, অ-সাম্প্রদায়িক মনোভাবের উপরই। যা দেখা গেল দিল্লিতে। এই ঐতিহ্যকে অভিনন্দন।